নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে রোজ ভ্যালি কাণ্ডে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, টালিগঞ্জের এক অভিনেত্রী ও তাঁর স্বামীর নাম জড়ালেন তাপস পাল। তৃণমূলের এই সাংসদ-অভিনেতা জেরায় সিবিআইকে জানিয়েছেন, রোজ ভ্যালির কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুকে বিশ্বাস করে তিনি ঠকেছেন। এখন তারই খেসারত দিতে হচ্ছে।

সিবিআই সূত্রের খবর, তাপসকে জেরা করে রোজ ভ্যালির সিনে ডিভিশনের আরও এক পরামর্শদাতা তথা কর্তার হদিস পাওয়া গিয়েছে। টালিগঞ্জের এক জনপ্রিয় অভিনেত্রীর স্বামী তিনি। তদন্তকারীদের তাপস জানিয়েছেন, টালিগঞ্জের ওই অভিনেত্রী রোজ ভ্যালি কর্তার কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য নিয়েছেন। নগদ টাকা, গয়না ও বাড়িও নিয়েছেন। রোজ ভ্যালির টাকা ওই অভিনেত্রী ও তাঁর স্বামীর অ্যাকাউন্টেও গিয়েছে বলে দাবি করছেন তদন্তকারীরা।

বাবুল সম্পর্কে এ দিন সাংবাদিকদের সামনেই মুখ খোলেন তাপস। তাঁর স্ত্রী নন্দিনী গত শুক্রবার বাবুলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। রবিবার তাপস বলেন, ‘‘(সিবিআইকে) বাবুল ও অন্য কয়েক জনের নাম জানিয়েছি। তিনিও জড়িত। গৌতম কুণ্ডু আমাকে বলেছিলেন, ও ঘরের ছেলে।’’ এই অভিযোগের পরেই বাবুল টুইট করেন, ‘‘এখনই তাপস পাল ও নন্দিনী পালের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার নির্দেশ দিয়েছি। ওঁর একটা উচিত শিক্ষা পাওয়া দরকার।’’ পরে যোগাযোগ করা হলে বাবুল বলেন, ‘‘রোজ ভ্যালি অনেক ফিল্ম, গান-বাজনার শো প্রযোজনা করেছে। অনেক শিল্পী সেখানে কাজ করেছেন। আমাকে টার্গেট করা হচ্ছে আমি রাজনীতিতে আছি বলে। তাপসদা যা করেছেন তাঁর খেসারত দিচ্ছেন। অন্যদের জড়িয়ে লাভ হবে না।’’ বাবুলের দল বলছে, এটা বিজেপিকে জড়ানোর একটা কৌশল মাত্র।

সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘তাপসবাবু কবুল করেছেন, শুধু তিনি নন, সিনে ডিভিশনে রোজ ভ্যালি কর্তার ঘনিষ্ঠ একাধিক প্রভাবশালী জড়িত ছিলেন।’’ রবিবার সকালে তাপসকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য স্থানীয় ভুবনেশ্বর স্টেট ক্যাপিটাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বেরোনোর সময় তাপস বলেন, ‘‘আরও অনেক নাম আসছে। দেখতে থাকুন।’’

গত শুক্রবার কলকাতার অফিসে ডেকে পাঠিয়ে রোজ ভ্যালি কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছিল ‘দাদার কীর্তি’-র নায়ককে। সে রাতেই তাঁকে বিমানে ভুবনেশ্বরে নিয়ে যান সিবিআই অফিসারেরা। শনিবার সেখানকার আদালতে তোলার পরে তাপসকে তিন দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে রাখার অনুমতি পায় সিবিআই। শনি ও রবিবার বেশ কয়েক দফায় ভুবনেশ্বরের অফিসে বসিয়ে তাঁকে জেরা করা হয়েছে। সিবিআই সূত্রের খবর, প্রথমে সব অভিযোগই অস্বীকার করে যাচ্ছিলেন তাপস। কিন্তু, যত সময় এগিয়েছে, তদন্তকারীদের সামনে মুখ খুলেছেন তিনি। রোজ ভ্যালি কাণ্ডের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগের কথা তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করে নিলেও তাপস দাবি করেছেন, তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে। রবিবার সকালে ভুবনেশ্বরের হাসপাতালে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমি জানি, আমি নির্দোষ। দল আমার পাশে রয়েছে। আমি আজও নামকরা অভিনেতা।’’

সিবিআই অফিসারেরা জানাচ্ছেন, বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে তাপসকে। এতে যথেষ্টই বিব্রত দেখিয়েছে তাঁকে। তদন্তকারীদের দাবি, এ রকম আরও কিছু তথ্য-প্রমাণ তাঁদের কাছে রয়েছে। ধীরে ধীরে তা তাপসের সামনে তুলে ধরা হবে।

তবে এ দিনও স্বামীর হয়ে সওয়াল করেছেন তাপসের স্ত্রী নন্দিনী। তিনিও ভুবনেশ্বরে রয়েছেন। এ দিন নন্দিনী বলেছেন, ‘‘রোজ ভ্যালির কাছ থেকে অনৈতিক ভাবে কোনও টাকা নেওয়া হয়নি। অভিনয় খাতে টাকা নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই তাপসকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

টালিগঞ্জের যে অভিনেত্রী ও তাঁর স্বামীর কথা তাপস জানিয়েছেন, গৌতম কুণ্ডুর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার কথা জানেন তদন্তকারীরাও। রোজ ভ্যালির প্রযোজিত একাধিক ছবিতে ওই অভিনেত্রী অভিনয়ও করেছেন। তাঁর স্বামীর বিদেশি কিছু যোগসূত্রও পাওয়া গিয়েছে। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর বক্তব্য, রোজ ভ্যালির আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। রোজ ভ্যালির টাকা যে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, ইডি-র তদন্তেও তা উঠে এসেছে। ওই অভিনেত্রীর স্বামী বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বা সম্পত্তি কিনেছেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সিবিআই সূত্রের খবর, রোজ ভ্যালির সিনে ডিভিশনের পরামর্শদাতা থাকাকালীন ওই অভিনেত্রীর স্বামী নিয়মিত বিদেশে যাতায়াত করতেন। বেশ কয়েক বার রোজ ভ্যালি কর্তার সঙ্গেও বিদেশে গিয়েছেন তিনি।

সিবিআইয়ের এক কর্তা জানান, রোজ ভ্যালির টাকা যে নানা ভাবে পাচার করা হয়েছে, সে ব্যাপারে বহু তথ্যই তাঁদের হাতে এসেছে। নগদ টাকার সব ভাউচারই তদন্তকারী সংস্থার নজরে রয়েছে। ফলে কেউই অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পারবেন না। তাপসকে জেরা করে রোজ ভ্যালির সিনে ডিভিশন মারফত মোট কত টাকা পাচার হয়েছে, তারও আঁচ মিলবে বলে মনে করছে সিবিআই।