বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা

সেলিনা জাহান প্রিয়াঃ-| ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শনিবার |
গত কয়েক বছরের তুলনায় দেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক রোগী আক্রান্ত হয়েছেন। দিন দিন আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলছে। এ বছর ২২শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে ৩ হাজার ৩৯১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন। এই মাসেই ৭৬৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৬। বাকি ৩ হাজার ২৯৮ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। গত বছর আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন এবং মারা গেছেন ছয়জন। গত বছরের তুলনায় এবার আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে এসেছিলেন। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গু বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু এবার যেহেতু জানুয়ারিতেও বৃষ্টি হয়েছে তাই মশা উপদ্রব আগ থেকেই দেখা গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। জমে থাকা বৃষ্টির পানি থাকলে মশার প্রজনন বাড়ে। তাই বাড়ি বা বাড়ির আঙিনার কোথাও যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতনও সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। এ ছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে অ্যাসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ৪ থেকে ৫ দিন জ্বর থাকলে ঘরে বসে না থেকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। শীতের সময়ে কমে আসবে। তিনি বলেন, এই সময়ে জ্বর বা গায়ে ব্যথা হলে ডেঙ্গুর কথা মাথায় রাখতে হবে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর তেমন মারাত্মক রোগ নয়। অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর যখন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের প্রমাণ মেলে (যেমন মাড়ি বা নাক থেকে রক্তক্ষরণ, মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি) তখন একে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে শরীরের জলীয় উপাদান কমে যায়। এতে রক্তচাপ কমে। এটাই ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে সুপরিচিত রমনা ও ইস্কাটন, ধানমন্ডি, কলাবাগান, গুলশান, বনানী এলাকার বাসিন্দারাই ডেঙ্গু জ্বরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ করেই মশার প্রকোপ মারাত্মক আকারে বেড়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র জানা গেছে, ১লা জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর উপস্থিতি তেমন থাকে না। কিন্তু এবার জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেখা যায়, জানুয়ারিতে ১৩ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৩৮ জন, মে ৭০ জন, জুনে ২৪৬ জন, জুলাইতে ৮৯৬, আগস্ট মাসে ১৩২২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ৭৬৪ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সূত্র মতে, ১লা জানুয়ারি থেকে ২২শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মোট ৩ হাজার ৩৯১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে মে মাসে একজন, জুনে ২ জন, জুলাইয়ে ২ জন, আগস্টে একজন ও সেপ্টেম্বরে একজনের মৃত্যু হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯। মোট রোগীর মধ্যে ঢামেকে ১৬ জন, মিটফোর্ডে একজন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীতে ৯ জন, হলি ফ্যামিলিতে ৯ জন, বারডেমে ৪ জন, মুগদায় একজন, বাংলাদেশ মেডিকেলে দুইজন, ইবনে সিনায় ৭ জন, স্কয়ারে দুইজন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৮ জন, ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে একজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৭ জন, খিদমাহ হাসপাতালে একজন, সালাউদ্দিনে একজন ও পপুলারে ৪ জন ভর্তি রয়েছেন।

স্থাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬২ জন, মারা গেছেন ছয়জন। ২০১৪ সালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৩ জন। কেউ মারে যাননি। ২০১৩ সালে ১৪৭৮ জন, ২০১২ সালে ১২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। ২০১১ সালে ১৩৬২ জন, ২০১০ সালে ৪০৯ জন। এই সালে ছয়জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতলে আসেন।

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, সাধারণত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গু মশার উপদ্রপ বেড়ে যায়। তবে, জুলাই ও আগস্ট মাসে বেশি থাকে। কারণ এই সময়ে বর্ষার পানি জমে। কিন্তু এবার আগেই থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। পানি তিন থেকে ৫ দিন একই স্থানে স্থির থাকলে সেখানে এডিশ মশা ডিম পাড়ে। এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় মশার উপদ্রব বেশি বলে তিনি মনে করেন। গত কয়েক বছরের তুলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তিনি জানান, এ বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাতজন রোগী মারা গেছেন। ডা. আয়েশা আক্তার জানান, নতুন নতুন হাসপাতালও অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার তাদের তথ্য ভাণ্ডারে তথ্য দিচ্ছে। এজন্য সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!