রথীর হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই

রথীর হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই
সিডনীর কথকতা-১৩
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

আজও বাংলাদেশে মার্চ মাস সর্বাধিক উত্তপ্ত মাস হিসেবে বিবেচিত-স্বীকৃত একটি ঐতিহাসিক মাস হিসেবেও। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের এই মার্চেই বাঙালি জাতি সশস্ত্র পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ লড়াই শুরু করেন এবং নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে অসীম বীরত্বের সাথে ডিসেম্বর মাসে এক অসাধারণ জাতীয় বিজয় ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হন। ১৯৭১ সনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জানান দেয় যে পাকিস্তানকে তাঁরা মানবেন না-পূর্ব পাকিস্তানও আর পূর্ব পাকিস্তান না- সেটি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ-বাংলাদেশ।

হঠাৎ এবার ২০১৮ সালের মার্চের শেষ কটি দিনে এসে যেন এক ছন্দ পতন ঘটে গেল। শত সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রংপুরের প্রখ্যাত আইনজীবী রাজনৈতিক নেতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব, ধর্মীয় বৈষম্য বিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক রথীশ চন্দ্র ভৌমিক একদিন সকালে উধাও হয়ে গেলেন বলে আতংকজনক একটি খবর জাতীয় সংবাপত্রগুলিতে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হলো।

খবরটি পড়ে সারা দেশ উৎকণ্ঠিত হলো। বিশেষ করে এই কারণে যে অত্যন্ত সাহসের সাথে তিনি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী নেতা আজাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত মোকর্দ্দমায় তিনি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বহুল আলোচিত জাপানী নাগরিককে মৌলবাদীদের দ্বারা অপহরণ-হত্যা মামলাটি সরকারী আইনজীবী হিসেবে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করে দেশী-বিদেশী মৌলবাদী জঙ্গীদের কুনজরে পড়েন এবং তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। তদুপরি তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হওয়াতে মৌলবাদীদের কু-নজর তাঁর প্রতি বরাবরই বিদ্যমান ছিল। সবকিছু মিলিয়ে রংপুর শহরের সকল প্রগতিশীল মহলের তিনি অত্যন্ত সমাদৃত ব্যক্তিত্বও ছিলেন।

রথীশ ভৌমিক যে রংপুরের অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন দেশবাসী তা জানতে পারেন তাঁর অপহরনের খবরটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে রংপুর শহরের সকল স্তরের, সকল পেশার নারী-পুরুষ প্রতিদিন তাঁকে খুঁজে বের করার দাবীতে মানবন্ধন ও অন্যান্য ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কয়েকদিন ধরেই এ আন্দোলন চলতে থাকলো।

আইনজীবী রথীশ ভৌমিক আপাততঃ তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মর্মে যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জি.ডি. করা হলো। সবার মনে আশংকা দানা বাঁধতে থাকলো-রথীশ ভৌমিককে জীবিত অবস্থায় আর ফিরে পাওয়া যাবে কি না? এই গভীর আশংকার মধ্যেও ক্ষীণ আশাটিও অনেকে পোষণ করছিলেন – তাঁর মৃতদেহ না পাওয়াতে। ভাবা হচ্ছিল তিনি জীবিতই আছেন হয়তো বা।

কিন্তু না। সে আশায় ছাই দিয়ে কামরুল ইসলাম নামের একজন হাইস্কুল শিক্ষকের ভাই এক নির্মানাধীন বাড়ীর মাটিতে সমাধিস্থ থাকা রথীশের দেহটি অবশেষে উদ্ধার হলো। কোথা থেকে এল এই দেহটি। কোথায় কি অবস্থায় রথীশের মৃত্যু ঘটলো? কে কে তাকে সমাধিস্থ করলো? কোথা থেকে দেহটি আনা হলো? এরকম হাজারো প্রশ্ন মাথায় ভীড় জমাতে থাকলো।

দেশের সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত খবরে সত্বরেই প্রশ্নগুলির উত্তরও মিললো না। সাংবাদিকদের সংগ্রহীত তথ্যের ভিত্তিতে নয়। সেখানে আশুত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব এর ডাইরেক্টর জেনারেল বেনজির আহমেদ স্বয়ং সাংবাদিকদেরকে জানালেন তাঁদের প্রাথমিক বক্তব্য। তবে বিষয়টি আজও তদন্তাধীন।

তিনি জানালেন আইনজীবী রথীশ ভৌমিককে হত্যা করা হয়েছে এবং তিনি অপহৃত হননি।অপহরণের গল্পটি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রচার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

তাহলে কে হত্যা করলো? কিভাবে হত্যা করলো? কেন হত্যা করলো? কোথায় হত্যা করলো?

এই প্রশ্ন চারটির উত্তরও তিনি দিলেন। তিনি বললেনঃ
এক. হত্যাকারী তাঁর স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক। তিনি আইনজীবী রথীশের বাড়ীতেই ২৯ মার্চ তারিখে নৈশকালীন খাবার পরিবেশনের সময় তাঁর স্বামী রথীশের দুধভাতের সাথে ১০ টি ঘুমের বড়ি মিলিয়ে তাঁকে খাইয়ে দেন।

দুই. অত:পর রথীশ ওগুলি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন পাশের রুমে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা স্নিগ্ধার পরকীয় প্রেমিক তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল ইসলাম বেড়িয়ে এসে ওড়না (কিন্তু ওড়নাটা কার?) দিয়ে রথীশের গলা পেঁচিয়ে ধরে স্বাসরোধ করে হত্যা করে। স্নিগ্ধাও একই স্কুলের শিক্ষক। উভয়ে পরস্পর সহকর্মী এবং উভয়কেই চাকুরী দিয়েছিলেন আইনজীবী রথীশ ভৌমিক। তিনি ঐ স্কুলের সভাপতি ছিলেন।

তিন. এ কথাও জানানো হয়, এক মাসে চাকুরী করা কালে উভয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের মধ্যে প্রেমের ও দৈহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই তারা পথের কাঁটাকে সরিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে এই নির্মম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে।

চার. সমাহিত করণের ব্যাপারে ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয় – হত্যার পর ঐ রাত্রিতে কামরুল রথীশের বাসাতেই স্নিগ্ধা সহ থাকে। পরদিন ভোর পাঁচটায় কামরুল বেরিয়ে যায়। বেলা নয়টার দিকে সে ফিরে আসে একটি ভ্যান নিয়ে। অত:পর রথীশের নিথর দেহটি একটি আলমারীর মধ্যে ঢুকিয়ে তার ভাই এর নির্মানাধীন বাড়ীতে কামরুল নিয়ে যায়। সেখানে আগের দিন তার দুই ছাত্রকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে রাখে। ঐ দুই ছাত্রকে গর্ত খোঁড়ার বকশিশ বাবদ ৩০০ টাকা কামরুল দেয় এবং সেখানেই দেহটি সমাধিস্থ করা হয়। লক্ষ্যনীয়, র‌্যাবের বক্তব্য অনুযায়ী রথীশের দেহ প্রকাশ্য দিবালোকেই নিয়ে গিয়ে ঐ নির্মানাধীন বাড়ীতে খুঁড়ে রাখা গর্তে পুঁতে রাখা হয়। ঘটনার রাতে তা করা হয়নি বা পরবর্তী রাত্রের জন্যও অপেক্ষা করা হয়নি। যেন নির্ভয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু করা হচ্ছে।

পাঁচ. এরপর কামরুল ফিরে রথীশের বাসায় এসেছিল কি না জানা যায় নি। তবে স্নিগ্ধা যথারীতি ঐ বাসাতেই থেকে যায়। অবশেষে ঐ যে থানায় জি.ডি. করে অপহরণের কথা বলা হয়েছিল সেই জি.ডি টা করেছিল সম্ভবত: রথীশের ভাই অথবা ভাইপো। ওটাকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করা হয়েছে।

স্নিগ্ধার বয়স ৫০ বছর। তার ছেলে ঢাকায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী রংপুরেই থাকে। তবে মেয়েটি ঘটনার রাতে ছিল তার পিসীর বাড়ীতে।

এই মর্মান্তিক কাহিনী জানার পর দূরদেশে বসে যে সকল জরুরী প্রশ্ন মাথায় ভীড় জমাচ্ছে তা প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে অকপটে তুলে ধরি:
এক. স্নিগ্ধা কেন তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও স্বামী রথীশকে খুন করবেন? তাঁর সামনে তো এই ঝুঁকিপূর্ণ পথ ছাড়াও মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট পথ দিব্যি খোলা ছিল। যেমন, তিনি সহজেই বাড়ী ছেড়ে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কামরুলকে বিয়ে করে ফেলতে পারতেন। তাতে তো খুনের মামলায় পড়ার ঝুঁকি থাকত না?

দুই. যেভাবে হত্যাকান্ডটি ঘটানো হলো বলে দাবী করা হয়েছে তাও কি ঝুঁকিমুক্ত ছিল? ঘুমের বড়ি যে পরিমাণে খাওয়ানো হয়েছে তাতে রথীশ অজ্ঞান বা ঘুমন্ত অবস্থায় পড়ার পর ওড়না দিয়ে তাঁর গলায় পেঁচিয়ে স্বাসরোধ করে হত্যা করা সম্ভব বলে কিভাবে মনে করলো ঐ দুই কথিত খুনী? স্বাসরোধ করার উপক্রম ঘটতেই জেগে উঠে সকল শক্তি দিয়ে চীৎকার করে মানুষ জড়ো করে ফেলতে পারতো রথীশ এবং সেক্ষেত্রে তো খুনের আগেই তাদের ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। এমন আশংকা কি তাদের মনে আদৌ ছিল না?

তিন. পৈশাচিকভাবে খুন করার পর স্বামীর দেহ নিয়ে প্রেমিকের সাথে একই স্থানে বা পৃথক ঘরে একই বাড়ীতে রাত্রি যাপন কি আদৌ স্বাভাবিক?

চার. পরদিন সকাল নয়টায় লাশ নিয়ে গেল কামরুল। তারপর দেহটি পুঁতে রেখে নিজ স্বামীর বাড়ীতে স্নিগ্ধা ও তার নজরে বাড়ীতে কামরুল থাকলেন এটাই বা কতটা স্বাভাবিক? কেউই পালালো না?

পাঁচ. স্নিগ্ধা যদি এতই অভিনয় করে থাকেন তবে লাশ সরানোর পর তার স্বামীর খুনের মামলা নিজেই গিয়ে থানায় দায়ের করা কি স্বাভাবিক ছিল না?

ছয়. স্নিগ্ধা তার কথিক প্রেমিক কামরুলকে বাঁচানোর জন্য অন্য “মিথ্যা আসামী বা অজ্ঞাত নাম খুনীদের কথা বলেই তো দিব্যি এজাহার দিতে পারতেন? কিন্তু সে গেলেন নাই বা কেন?

সাত. রথীশ- স্নিগ্ধার মেয়ে ও ছেলের কোন খবর জানাই যাচ্ছে না এক সপ্তাহেরও বেশী সময় পার হওয়া সত্বেও। তারা কোথায় এমন খবরও পুলিশের বক্তব্যে নেই- নেই তাদের কোন উক্তিও। বিষয়টা একটু অস্বাভাবিক মনে হয়না কি?

আট. ঘটনাটিকে বলা হচ্ছে পারিবারিক খুন। অর্থাৎ সাধারন খুন। অথচ একে কেন্দ্র করে সুদূর ঢাকা থেকে র‌্যাবের ডাইরেক্টর জেনারেল স্বয়ং ছুটে এলেন রংপুরে। বিষয়টা অস্বাভাবিক নয় কি? সাধারণত: এরকমটি তো ঘটতে দেখা যায় না। কোন বিশেষ মহল এ ব্যাপারে তৎপর নয়তো? ভাবলে আরও কিছু প্রশ্ন হয়তো উত্থাপন করা যেতে পারতো। কিন্তু তা থেকে বিরত থাকলাম। তবে ন্যায় (সে স্নিগ্ধা-কামরুল হলেও) যাতে কঠোরতম শাস্তি পায় – আবার জনগণও প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে তাই দুটি দাবী উত্থাপন করে এই নিবন্ধের ইতি টানছি।

(১) এই সমগ্র ঘটনার বিশদ তদন্তের জন্য হাইকোর্টের একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক;

(২) সঠিক এবং প্রভাবমুক্ত ময়না তদন্তের জন্য উচ্চ পর্য্যায়ের মেডিক্যাল টীম ঢাকায় গঠন করে পুন: ময়নাতদন্ত করা হোক।
অভিনন্দন জানাই রংপুরের যাঁরা রথীন হত্যার সাথে সাথে ……….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!