রাখী বৌদি স্মরণে দুটি কথা

রাখী বৌদি স্মরণে দুটি কথা
রণেশ মৈত্র (একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

রাখী বৌদির সাথে সাক্ষাত পরিচয় ঠিক করে কোথায় কিভাবে ঘটেছিল-তা আজ আর স্মরণ নেই। তবে অবশ্যই তাঁর ঢাকাস্থ এক বাসায় বন্ধুবর পংকজ ভট্টাচার্য্যরে মাধ্যমে পরিচয়ের পর থেকে বৌদি আপনাতে আপনি ভাস্বর। কে কার চেয়ে বেশী আদর সম্মান, ভালবাসা দিয়েছেন-তা আলোচনার ব্যাপার। পংকজ বাবু অত্যধিক ঘনিষ্ঠ তবে সেটা মূলত: রাজনৈতিক কারণে। সেই ১৯৭২ সাল থেকে আজতক-অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত এই দলের পতাকাতলে কাজ করে চলেছি সে কারণেই প্রধানত:।

কিন্তু রাখী বৌদি? পংকজবাবুর সহধর্মিনী সেই কারণে কি? সেটা কিছুটা কিন্তু সে পরিচয় মুখ্য থাকে নি বৌদির অতুলনীয় আন্তরিকতায়, সাদা-মাঠা আচার-আচরণে এবং কথাবার্তায়। পরিচয় ঘটার পর কতদিন যে তাঁর বাসায় থেকেছি, খেয়েছি, গল্প করেছি বেদনার সাথেই তা আজ স্মরণে আসছে। যতই তা স্মরণে আসে ততই যেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠছি। অত্যন্ত ব্যথিত বোধ করি যখনই ভাবি অত্যন্ত আপন ঐ বৌদিটিকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলাম না-শেষ শ্রদ্ধা-শেষ বিদায় জানাতে পারলাম না। এ ব্যথা, এ বেদনা শুধু আমার একার নয়-বৌদির হাজার হাজার শুভার্থীর, সহকর্মীর, পরিবার-পরিজনের , বন্ধু-বান্ধবের।

মহিলা পরিষদ নেত্রী লক্ষ্মী চক্রবর্তী ও জুয়েলা জেবুন্নেসা খান এবং তাঁর কনিষ্ঠ বোন বহ্নিদাস পুরকায়স্থ আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন কথ্যাদি দিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে।

সিলেটের প্রখ্যাত আইনজীবী তাঁর জনক এবং বিপ্লবী চেতনার ধারক তাঁর মা। এঁদের এই একটি সন্তানের জন্যেই উভয়কে যথেষ্ট গর্বিত পিতা মাতা বলে মনে হয়। বাদ-বাকী সন্তানেরাও অনেকগুনে গুনী তবে কাউকে এতটা আপন করে কাছে পাওয়ার সুযোগ ঘটেনি তবে শ্রদ্ধাও আন্তরিকতা পেয়েছি সবার কাছেই।

সম্ভবত: ষাটের দশকের শেষ দিকে দু একবার তাঁর নাম চোখে পড়েছে সংবাদপত্রের পাতায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হিসেবে। আজ বলতে দ্বিধা নেই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দশক কোন হিন্দু মেয়ের সক্রিয় রাজনীতিতে ও আন্দোলনে আসার অনুকূল ছির না। তাই, তাঁর নাম যখনই পত্রিকার পাতায় দেখতাম-রীতিমত আনন্দিত হতাম এই অনুভূতিতে যে পাকিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক মধ্য যুগীয় রাষ্ট্রে তা হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একদিন দেশটাকে সবার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। এ নিয়ে মনে মনে গর্ববোধ করতাম যে ছাত্র ইউনিয়নই হয়তো এই মহামিলনের ক্ষেত্র তৈরী করেছে। অনুকূল পরিস্থিতি হিন্দু মেয়েদের চেয়ে কম থাকলেও ছেলেদের জন্যেও কম ছিল না। তা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের তালিকা দেখলেই বুঝা যাবে।

১৯৫২ সালের সংগ্রাম মুখর বছরের ইতিহাসখ্যাত মাসটি ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন। বড় হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এবং অত:পর মহিলা পরিষদের নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গৌরবের মাসে, অসাধরণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে উভয় সংগঠনের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ছিলেন ঈর্ষনীয় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে। একজন মহিলার বন্ধুত্ব অর্জনের সুযোগ ঘটায়।

বাল্যকালে সিলেট শহরেই শিক্ষাঙ্গণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেন রাখী দাশ পুরকায়স্থ। মা ঊষা দাশ পুরকায়স্থ, যাঁকে আমি ও আমার সহধর্মিনী পূরবী মাসিমা বলে ডাকতাম, ছিলেন একজন বিপ্লবী মহিলা-একজন সক্রিয় কর্মী।
একবার সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ বরিশালের মনোরমা মাসিমা ও প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার। সেই সুবাদে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের নানা কাহিনী শুনে আন্দোলন সংগঠনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন রাখী দাস পুরকাস্থ। ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে মনোরমা মাসিমার সাথে।
একজন প্রথম শ্রেণীর সংগঠক ও ছাত্র নেতা হয়ে ওঠায় এবং আন্দোলনমুখীনতার কারণে এক পর্য্যায়ে তাঁকে সিলেট মহিলা কলেজ থেকে টিসি দিয়ে দেওয়া হয় ভাল ছাত্রী হওয়া সত্বেও। তখন শহীদুল্লাহ কায়সার ও জননেত্রী বেগম সেলিনা বানুর সহায়তায় তিনি কুমিল্লায় ভর্তি হতে পেরেও সক্রিয়ভাবে আন্দোলন যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন নি। কুমিল্লা শহরের তৎকালীন সাংস্কৃতিক পরিম-লও তাঁর মানস জগতকে ও জীবনের গতিধারাকে অনেকটা বদলে দেয়। তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে শিরীণ বানু মিতিল, নীলিমা পাল, সুদীপ্তা সিনহা প্রমুখ বিপ্লবী মহিলাদের সাথে।

ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী এবং ঐ অভ্যূত্থানের একজন কর্মী। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে যে অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তিনি তাতেও অংশগ্রহণ করেন।

এক সময় ঢাকা শহর উত্তাল নগরীতে পরিণত হলে বৌদির বাবা নিরাপত্তার কারণে সিলেট নিয়ে যান। তৎকালীন গোপন কর্মীদের সাথে যে মেয়েরা কাজ করতেন-রাখী বৌদির তাঁদের সাথেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ।

২৪ মার্চ, ১৯৭১ সিলেট শহরে এক বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০ এর নির্বাচনের রায় দ্রুত মেনে নেওয়ার এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর হাতে হস্তান্তরের দাবীতে, এর মুখ্য নেতৃত্বে ছিলেন ঊষাদাশ পুরকায়স্থ খোদেজা কিবরিয়া, নীল চৌধুরী, শেফালি চক্রবর্তীং প্রমুখ। পাক-বাহিনী ঢাকাতে গভীর রাতে ঢাকায় গণহত্যা চালায়।

অত:পর রাখী দাস পুরাকয়স্থ ১৯৭১ এক জুন মাসে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জে চলে যান সিলেটের বিয়ানি বাজার এর জকিগক্র বর্ডার দিয়ে। সেখানে তিনি শরণার্থীদের মধ্যে সেবামূূূূলক কাজ, মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সগ্রহ, জনসংযোগ এবং নানা সভা সমিতিতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করেন। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্রইউনিয়নের ভিশেষ গেরিলা বাহিনীর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের করিমগঞ্জ হাসপাতালে সেবাদানেও নিযুক্ত ছিলেন ।
দেশে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়ন ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে বিপুল ভোটে ভি.পি. নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালের ১০ জুলাই রানী দাস পুরসাকায়স্থ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তখন তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সার্ধারণ সম্পাদক।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য ও রাখী দাস পুরকায়স্থের বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল নারায়নগঞ্জ টাউন ক্লাবে। উদ্যোক্তা ছিলেন দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, মুজিবর রহমান, আনোয়ার মুর্দেদ, কাশেম কামাল, কাশেম হুমায়ুন রথীন চক্রবর্তী, নূরুল হক, শ্যামসুন্দর সাহা, এবি সিদ্দিক, আশেক আলী মাস্টার, আবদুল লতিফ, আবদুস সোহবাহন মিয় প্রমুখ। তাঁদের এই নবদম্পত্তিকে প্রদত্ত মানপত্রে লেখা ছিল, পত্নী প্রেম যেন দেশপ্রেমের ঊর্ধে না ওঠে। তাঁদের জীবনে যেন তা ছিল এক ঐতিহাসিক অঙ্গীকার।

রাখী বৌদি এক সময় ছিলেন ঢাকা মহানগর মহিলা পরিষদের সম্পাদিকা। ১৯৮৮ সালে মহিলা পরিষদে ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত ছিলেন মহিলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে তিনি চাকুরী করতেন। পরবর্তীতে আইন পেশায় যুক্ত হন। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভুমিকা ছিল।

রাখী দাস পুরকায়স্থ অনেকদিন যাবত লিভার সিরোসিস রোগে ভুগছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর উন্নততর চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় আসামের গুয়াহাটিতে ভর্তি করা হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিগত ৬ এপ্রিল (২০২০) তিনি পরলোক গমন করেন। করোনার বিভীষিকা জনিত কারণে তাঁর আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব, গুণগ্রাহীদের সাথে শেষ সাক্ষাত ও সৎকারাদির জন্য দেশে আসা সম্ভব হয় নি। স্বামী ও সহযোদ্ধা পংকজ ভট্টাচার্য্যকেই তাঁর শেষ কৃত্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। ৫ জুন পংকজবাবু সহধর্মিনীকে গুয়াহাটির মাটিতে রেখে একাকী দেশে ফিরে আসেন।

রাখী বৌদিকে পাবনাতে সম্ভবত: বার তিনেক পেয়েছি। এসেছেন আমাদের বাসায়। সর্বত্রই তিনি থাকতেন ব্যস্ত-নিজের জন্যে সময় দেন নি কখনও। এই সময়াভাবের কারণেই শুধুমাত্র চা-বিস্কিট খেয়েই বিদায় নিয়েছেন প্রতিবার। দুপুর বা রাতের খাবার খাওয়াতে পারি নি কোনবার। অথচ তাঁর হাতে কত দিন, কত রাত যে খেয়েছি তার কোন হিসেব নেই।

রাখী বৌদি এত সত্বর এত কম বয়সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন তা কখনও ভাবিনি। বয়স তো হয়েছিল মাত্র ৫৭ বছর। করোনার কঠিন পরিবেশের কারণে আজও আমরা কেউ কোথাও মিলিতভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে, স্মরণ করতে, তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে আজও, এই দীর্ঘ সাত মাস পরেও করতে পারলাম না-এ দুঃখ আজীবন পীড়া দেবে।

বৌদি, তোমাকে ভুলবো না। আমরা কেউই না। বাংলাদেশের প্রগতি আন্দোলনের সাথে তোমার নামটি গৌরবের সাথে উচ্চারিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!