বাঙালি শব্দটি জাতীয় ঐকের স্মারক-দুই

 

সিডনীর কথামালা-৪৩

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com

 

“বাঙালি” নিয়ে যে সিরিজটি লিখতে বসেছি-তা সম্ভবত: সিডনীতে থাকা পর্য্যন্ত প্রকৃত প্রস্তাবে শেষ করতে পারব না। কারণ অন্য কিছু না। এ নিয়ে লিখতে আসলেই কিছু বই পুস্তকের সহযোগিতা লাগে। সেগুলি পাবনাতে ফিরে না যাওয়া পর্য্যন্ত সংগ্রহ করার সুযোগ এখানে আমার নেই। তাই আমার প্রিয় পাঠকপাঠিকাদেরকে অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েই হয়তো বলতে হবে তাবে তা এখুনি নয়। কারণ স্মৃতির ভিত্তিতে যতটা সম্ভব তা আমি সিডনীতে বসেই লিখতে চাই-বিশেষ করে এ কারণে যে সিডনীতে আমার হাতে অঢেল সময়। এত সময় যে তা আবার দেশে ফিরে গিয়ে পাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। তাই এ প্রচেষ্টা সাধ্যমত অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট থাকবো।
একটি কথা বোধ হয় উল্লেখ না করলেই নয় যে আজও আমরা পারিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, পণ্ডিত ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর , মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাস প্রমুখ দিকপাল কবি সাহিত্যিকের “বাঙালি” বলতে যা বুঝতেন বা বুঝাতেন তেমন অর্থে আজও বাঙালি হয়ে উঠতে। বাংলা ভাষায় কথা বললেই বা বাংলাদেশে বাস করলেই বাঙালি হওয়া যায় না-লাগে একটি বিশেষ সংস্কৃতি চেতনা, লাগে একটি জীবনাচরণ লাগে সচেতন বাঙালিত্ব বোধ এবং তার নিষ্ঠাশীল ও ধারাবাহিক বাস্তব প্রয়োগ। এগুলির পীড়াদায়ক অনুপস্থিতির কারণেই নিবন্ধটি লেখার তাগিদ জুগিয়েছে। যে সব শীর্ষ কবি, সাহিত্যিকের নাম ইতিপূর্বে উল্লেখ করলাম তাঁরা বিদেশী ইংরেজ শাসকের সুকঠিন আমলে বাঙালিত্বের চর্চা করেছেন-আর সেই চর্চার মাধ্যমেই তাঁরা জাতীয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও গৌরব অর্জন করেছেন।
অত:পর তাঁদের মৃত্যুর পর নদী-মাতৃক বাংলাদেশের নানা নদী দিয়ে বলু-জল গড়ালো-সৃষ্টি হলো বহু ইতিহাসের। আবার সেই ইতিহাসের শ্রষ্ঠাও হলেন বাঙালিরা-বাঙালি তরুণ-তরুণীরা। এঁদের দলে আমিও ক্ষদ্র একজন হলেও আজও জীবিত। সেদিনের সেই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এখন পর্য্যন্ত আরো বেঁচে আছেন বন্ধুবর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান (এমিরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আছেন সু-সাহিত্যিক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আছেন গোলাম আরিফ টিপু (আইনজীবী), সাহিত্যিক ও গবেষক আহমেদ রফিক এবং আরও বেশ কয়েকজন তাবে তাঁদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। সবার খবরও সঠিকভাবে আমার জানা নেই। সেদিনের তরুণীদের কারও নামই আমি উল্লেখ করতে পারলাম না স্মৃতি বিভ্রম জনিত কারণে। তবে সংখ্যায় কম হলেও তাঁদের অবদানের গৌরব শ্রদ্ধাভরে হৃদয়ে ধারণ করি। তাঁদের কয়েকজন ও আমাদের মধ্যে আজও আছেন। “সংস্কৃতি” শব্দটি বহুমাত্রিক। জীনাচরণের সকল বিষয়ই প্রবহমান জীবনের সকল দিকই সংস্কৃতির অন্তর্গত। রাজনীতিও তাই। এবং পাকিস্তান আন্দোলন (যা বৃটিশের অনুকম্পা ও সমর্থন পুষ্ট ছিল), পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুকাল আগ থেকে দাঙ্গা বিভেদ, রক্তারাক্তি প্রভৃতির ফলে দুর্য্যােগ, কলংক ও কালিমার সঙ্কার হয়েছিল- সেই ঘন কালো মেঘ অপসারণের লক্ষ্যে রাজনীতির এক চরম লগ্নে বাঙালি তার শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবর রহমানকে পেয়ে যায়। শেখ মুজিব বন্তুত:নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের বরেণ্য সন্তান-যিনি শূণ্য থেকে বিশালত্ব অর্জন করে হিমালয়ে পরিণত হতে পেরেছিলেন, সীমাহীন অবদানের মাধ্যমে। তাঁর সবল ও সাহসী রাজনৈতিক ভাবে বাঙালির যে ঐতিহাসিক নব-উত্থান ঘটেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়।
এই দফায় কথাগুলি বেশীদিন আগের কথা নয়। বিভাগপূর্ব একদশক, বিভাগোত্তর তিন দশক, স্বাধীনোত্তর পাঁচ দশক এই সময়কালে যেমন বাঙালি জাতি বিভক্তির রক্তাক্ত উপাখ্যান প্রত্যক্ষ করেছে দেখেছে ধর্মীয় উন্মাদনার বিষময় ফল ও প্রতিক্রিয়া। সেই অন্ধকার যুগে রাজনৈতিক আসরে আকস্মাৎ দেখা দিলেন প্রধান মুসলিম লীগ নেতা (বিদ্রোহী) মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষানী। তাঁকে সভাপতি করে ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে গঠিত হয় “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”। এতে তৎকালীন বেশ কিছু যুবনেতা আর প্রবীণদের মধ্যে আতাউর রহমান খান প্রমুখ ছিলেন। তার আগেই ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন ঘটে গেছে শ্রেফ তরুণদের উদ্যোগে। তবে অনুপ্রেরণা তাৎক্ষণিকভাবে এসেছিল করাচীতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত কর্তৃক যখন প্রস্তাব উত্থাপিত হয় – বাংলাকে সংসদের অন্যতম সংসদীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা তখন থেকে। এই প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করে পাকিসন্তানের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলে উঠলেন, “বাংলা হিন্দুদের ভাষা-মুসলমানের ভাষা নয়। তাই মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সংসদীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেতে পারে না”। তিনি ধীরেন দত্তকে “পাকিস্তানের দুশমন” এবং “ভারতের দালাল” বলেও আখ্যায়িত করেন। সম্ভবত: লিয়াকত আলী খান আজও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কারণ তাঁর ঐ উক্তির পর প্রতিবাদ স্বরুপ ধীরেন দত্ত সংসদ থেকে বেরিয়ে এসে পিআই এর প্রথম ফ্লাইটেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
সংসদের এই খবর ঢাকার পত্রিকায় তরুন-তরুণীরা ঐক্যবদ্ধ হলেন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে যে কোন মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করে বাঙালীর মাতৃভাষা কে শাসক গোষ্ঠীর আক্রমনের হাত থেকেই শুধুমাত্র রক্ষা করা হবে না – মাতৃভাষা বাংলাকে যথার্থ মর্য্যাদার আসনেরও অধিষ্ঠিত করা হবে। লিয়াকত আলীর উস্কানী বাঙালী তরুণতরুণীদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে মুসনলমান পরিচয় থেকে বাঙালি পরিচয়ে ফিরিয়ে আনতে পরোক্ষ ইন্ধন জাগানো
সহসাই ভাষা আন্দোলন ও শুরু হলো সেই ১৯৪৮ এর মার্চ থেকেই এবং অত:পর ঐ তরুণ-তরুণীরা প্রকৃতই জীবন দিয়ে বুকের রক্ত ঢাকার পীচঢালা কালো রাজপথে ঢেলে তাকে রক্ত রঞ্জিত করেছিল এবং ধারাবহিকভাবে প্রদেশব্যাপী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গৌরবোজ্জল বিজয়ও অর্জন করেই ছেড়েছিলেন। আন্দোলন তীব্র রূপ নিলো বাহান্ন সালে আর ১৯৫৬ সালে সরকারী ভাবে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে ছাড়লো।
আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে ভাষা আন্দোলন শুধুই আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করে নি – তা একই সাথে পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি “দ্বিজাতিতত্ত্ব” কেও প্রচণ্ড আঘাত হেনে তাকে বিতাড়িত করে ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভাষীরা বাঙালি এই সত্য বিশ্বের সামনে নতুন করে উদঘাটন করে দিল। বহুমাত্রিক তাৎপর্য্য নিয়েই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে মহিমান্মিত করেছিল। এখানেই সেই

নানা মাত্রার নানা দিক সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও তুলে ধরার প্রয়াস পাবঃ
এক. উগ্র ধর্মীয় চিন্তার ফলে ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় বিভাজন বাঙালী জাতিকেও হিন্দু করেছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে উভয় ধর্মীয় সম্প্রদাভূক্ত বাঙালিই যেন ঘরে ফিরে এসে পুনরায় বাঙালিত্বকে আঁকড়ে ধরলো।
দুই. ঐ তিক্ত বিভেদ বিভাজন হিন্দুদেরকে করে তুলেছিল গয়া-কাশি-মথুরা-বৃন্দাবনমুখী আর মুসলিমদেরকে করে তুলেছিল সুদূর সৌদি আরবের মরুভূমি বা মক্কা-মদিনা অভিমুখী যেন সবাই বাঙালীত্ব বর্জন করে এক অজানা অচেনা রাজ্যের বাসিন্দা।
তিন. কিন্তু সেই অচেনা-অজানা রাজ্যগুলি পরিত্যাগ করে পুনরায় সবাই ফিরে এলেন বাংলায় পরস্পর পরস্পরের সাথে হাত মেলালেন হৃদয়ে হৃদয়ে মিলল যেন নতুন করে।
চার. রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা গেল নতুন উদ্যমের এক অফুরন্ত জোয়ার। বাহান্নর পর থেকে দেশে নতুন করে ধর্মের নামে আর কোন রাজনৈতিক দলের জন্ম হলো না। শুধু তাই নয় বাহান্নর আগে “মুসলিম” বা “হিন্দু” নাম দিয়ে যে কটি দলের অস্তিত্ব ছিলো সেগুলিও ক্রমান্বয়ে দলের নাম থেকে “হিন্দু” বা “মুসলিম”শব্দগুলি পরিত্যাগ করলেন যেমন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৫৫ সালে এসে “মুসলিম” শব্দটি তার নাম থেকেত পরিত্যাগ করে “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ” এবং ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” ও ১৯৫৩ সালে তার নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি পরিত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ” নাম ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। আবার দেশবিভাগ ব্যাপক দেশত্যাগের কারণে অতীতের “হিন্দু মহাসভা” নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লেও দলটিকে পরে আর কেউ পুনরুজ্জীবিত করতে এগোন নি।
পাঁচ. তেমনি আবার জন্ম নিলো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর পরই। হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালে গঠিত হলো পাকিনস্তান গণতন্ত্রী দল এবং ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে গঠিত হলো “পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি” বা সংক্ষেপে ন্যাপ নামে নিখিল পাকিস্তান ব্যাপী ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসী, সামান্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী
এবং সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক দল।
ছয়. সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রায় আবির্ভূত হলো। বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক নতুন করে বিকশিত হতে শুরু করলো। নাচ, গান, আলপনা, দোকান বিপণীর সাইনবোর্ড-সর্বত্রই বাঙালীর নব উত্থান নবজাগরণের সৃষ্টি হলো। শুরু হলো পহেলা বৈশাখ উদযাপন, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী প্রভৃতি।
-চলবে

 

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!