২ লাখের শ্রম-ঘামে অন্যতম মসজিদ উজিরপুরে

বায়তুল আমান জামে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স। প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার শ্রমিকের শ্রম-ঘামে নির্মিত মসজিদটি। এটি কেবল এশিয়াই নয়, বিশ্বের অন্যতম সুন্দর মসজিদগুলোর মধ্যে একটি।

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের চাংগুরিয়া গ্রামে ১৪ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বায়তুল আমান কমপ্লেক্স। যাকে ‘গুঠিয়া মসজিদ’ হিসেবেও চেনেন অনেকে। মহানগরী থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বানারীপাড়া সড়ক সংলগ্ন উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক এই মসজিদটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- বিশ্বের ১৯টি পবিত্র স্থানের মাটি ব্যবহৃত হয়েছে এর নির্মাণে।

মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই হাতের বাঁয়ে রয়েছে বিস্তারিত লেখা ফলক। তা থেকে জানা যায়, পবিত্র কাবা শরিফের মাটি, মহানবীর (সা.) জন্মস্থানের মাটি, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা, জাবালে নূর-সুর-রহমত (পাহাড়), ওহুদের যুদ্ধের স্থান, জান্নাতুল বাকি, মসজিদে নববী, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাজারসহ আরও বেশ কিছু গুরুত্ববহ স্থানের মাটি সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে বায়তুল আমানের নির্মাণে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু অপরূপ এই মসজিদ তৈরিতে অর্থায়ন করেন। ২০০৩ সালে মহান বিজয় দিবসে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। তার অাগে সরফুদ্দিন সান্টু কয়েকজন স্থপতি বন্ধুকে নিয়ে ঘোরেন সৌদি, তুরস্ক, ইরান, দুবাই, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। এরপর বিদেশি বিভিন্ন স্থাপত্যকলার আদলে মসজিদের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। প্রায় তিন বছর চলে নির্মাণ কাজ। এখানে নারী-পুরুষ মিলিয়ে একসঙ্গে ২০ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারবেন। শুধু কমপ্লেক্স নয়, মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল পুকুর। যা এমনভাবে খনন করা- যাতে পানিতে মসজিদটির পুরো প্রতিবিম্ব সুস্পষ্ট বোঝা যায়। এছাড়া এতিমখানা, ডাকবাংলো, গাড়ি পার্কিং প্লেস, চর্তুমাত্রিক লাইটিং ব্যবস্থাসহ গাছ ও বাগান রয়েছে পুরো কমপ্লেক্স ঘিরে।

প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন মিলন ও আমিনুল হক মসজিদের নকশা প্রণয়ন করেন। ২০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে প্রায় তিন বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর জুমার নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে বায়তুল আমানের উদ্বোধন করা হয়। ছারছিনা দরবার শরীফের পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ এর উদ্বোধন করেন। মসজিদটি উদ্বোধনের পর থেকেই অগণিত দর্শনার্থী ভিড় জমান এর আঙিনায়।

ইসলামিক ঐতিহ্য ও নির্মাণশৈলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত মসজিদটি। মনোরম শৈল্পিক কারু-কাজ মণ্ডিত অত্যাধুনিক বায়তুল আমান জামে মসজিদে ২০টি গম্বুজ ও ১টি মিনার রয়েছে। মিনারের উচ্চতা ২০০ ফুটের মতো। নয়নাভিরাম মসজিদটি পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ তো বটেই, সমগ্র দেশেরই অন্যতম অধুনিক স্থাপনা। ছুটির দিনে কিংবা ঈদে ঢল নামে বায়তুল আমানে।

এশিয়ার মধ্যে অন্যতম আধুনিক মসজিদের খ্যাতি আছে গুঠিয়া মসজিদের। ইরানের নাসির আল মুলক মসজিদের মতো সুন্দর এর স্থাপনা। সূর্য ডোবার সময় লাল আভায় আলোকিত মসজিদ, অন্যদিকে গোধুলির সময় লাইটের আলো-ছায়ায় আরও মনোরম দৃশ্য। লেজার লাইটের খেলায় মাতামাতি কতো না সুন্দর!

২ লাখ শ্রমিকের শ্রম-ঘামে বিশ্বের অন্যতম একটি মসজিদ এখন উজিরপুরে। কমপ্লেক্সের মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে ডান পাশে বড় পুকুর। এর চারদিকে নানা রঙের ফুল ও গাছ। দর্শনার্থীদের চলাচল ও বসার জন্য পুকুরপাড়ে রয়েছে সুব্যবস্থা। এছাড়া মোজাইক দিয়ে তৈরি শান বাঁধানো ঘাটের শীতল হাওয়া মন জুড়িয়ে দেবে। ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে মসজিদের প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে দু’টি ফোয়ারা। সন্ধ্যার পর থেকে আলোর ঝলকানিতে ফোয়ারাগুলো আরও অপরূপ লাগে। মসজিদের তিন পাশে খনন করা হয়েছে কৃত্রিম খাল।

মসজিদের নির্মাণে মধ্যপ্রাচ্যের তিন-চারটি বিখ্যাত মসজিদের আদল আদর্শ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এদিকে ২০ গম্বুজের স্থাপত্যে বায়তুল আমান মূল কমপ্লেক্স। মধ্যখানের কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে বৃত্তাকারে ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়েছে পবিত্র আয়াতুল কুরসি। শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ মসজিদের ভেতরের চারপাশ জুড়ে ক্যালিওগ্রাফির মাধ্যমে সুরা রহমান লেখা। অভ্যন্তরে চারকোনের চার গম্বুজের নিচে, প্রবেশ তোরণের সামনে এবং দর্শনীয় কয়েকটি স্পটে শোভা পাচ্ছে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিওগ্রাফি।

এসব সুদৃশ্য লেখা ধারাপাত ও আল্পনা বর্ণিল কাঁচ, বিদেশি মার্বেল পাথর, গ্রানাইট ও সিরামিক দিয়ে করা হয়েছে। ভেতরের নয়টি গম্বুজে বিশালাকৃতির নয়টি অত্যাধুনিক ও মূল্যবান ঝাড়বাতি রয়েছে। এছাড়া মেঝেতে ভারত থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথরের টাইলস দেওয়া। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের সুবিধার্থে সর্বপ্রান্তে রয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। এছাড়া বিদ্যুৎ লাইনের পাশাপাশি ব্যাকআপ হিসেবে ১৫০/১৫ কেভিএ শক্তিসম্পন্ন নিজস্ব দু’টি জেনারেটরও রয়েছে। এতে রাতে বিদ্যুৎ না থাকলেও পুরো মসজিদ থাকে নয়নাভিরাম আলোর খেলাতেই।

অত্যাধুনিক সুন্দর ও মায়াময় দৃষ্টিনন্দনের মসজিদটি শুধু একটি স্থাপনাই নয়, ঐতিহ্যও বটে। এটি আধুনিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশের মাটিতে, তাও আবার প্রত্যন্ত গ্রামে এ রকম বিস্ময়কর সুন্দর সৃষ্টি হতে পারে, ঘুরতে না এলে বিশ্বাস হবে না।

https://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=XlQKsN_WSPc

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!