একটি আত্মানুসন্ধান: পেছন ফিরে তাকানো

 

 

 

একটি আত্মানুসন্ধান: পেছন ফিরে তাকানো
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

 

দেশ কোন পথে এ নিয়ে বাংলাদেশে আজ ভাবনার, তৃপ্তির, উৎকণ্ঠার, উদ্বেগের শেষ নেই। মাঝখানে একটা তৃপ্তির কথা উল্লেখ করেছি। হ্যাঁ, সেটাও সত্য-তবে তা ক্ষমতাধর বা ক্ষমতা প্রত্যাশী ও সুবিধাভোগী ও সুবিধা প্রত্যাশী অল্প সংখ্যক লোকের মাত্র। তাই তার খুব একটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা দেখি না অন্তত: নিবন্ধটি লেখার শুরুর বা তার প্রাথমিক পর্যায়ে।
অহোরাত্র তৃপ্তির ঢেকুর যাঁরা তুলছেন দেশবাসীর সায় কিন্তু সেখানে নেই। দেশবাসী-মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বা সাধারণ অর্থে দেশের কল্যাণকামী কোটি কোটি মানুষের সমর্থন যে তাঁদের প্রতি নেই দেশের পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলির প্রতি চোখ বুলালে তা দিব্যি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের মূল সংকট আধুনিকতা বনাম কূপমন্ডুকতা, উদারনীতি বনাম রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মান্ধতা প্রভৃতির মধ্য নিহিত এবং তা আজ এতটাই প্রাসঙ্গিক যে তা যেন অর্থনৈতিক সংকটগুলিকেও ম্লান করে দিচ্ছে। চিন্তাশীল মানুষ পেটের ভাবনার চাইতে আদর্শিক ভাবনা নিয়ে বেশী উদ্বিগ্ন দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে এ কারণে যে, যে মৌলিক কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর থেকেই বাঙালি জাতি ঐ নবগঠিত রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম রচনা করতে থাকেন, যে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ ৩০ লক্ষ বাঙালি তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার সবুজ প্রান্তরকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন, সেই সুমহান আদর্শগুলি, একাত্তরের বিজয়-অর্জিত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে ৪৬ বছরের রাষ্ট্রযন্ত্রটি। ক্ষোভ এবং বেদনাটা এখানেই।

কিন্তু এই নীতি-আদর্শ তো বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন, তাজউদ্দিন আহমেদ ধারণ করতেন, ধারণ করতেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মনি সিং সহ অজস্র নেতা-কর্মী যাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বানে আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটি গঠন করেছিলাম ১৯৭১ এ এবং বাহাত্তরের সংসদে ৪ নভেম্বর তারিখে এক ঐতিহাসিক সংবিধান গৃহীত হয়েছিল যাতে পরবর্তীকালে অজস্র অবৈধ ও নীতিভ্রষ্ট সংশোধনী এনে কলুষিত করে ফেলা হলেও তাতে আজও লেখা আছে, “বাংলাদেশের মালিক এ দেশের জনগণ”। আরও লেখা আছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি এবং সেগুলি হলো গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। তাই জনগণের সেই মালিকানাকে যদি সত্য সত্যই আমরা মানি-তাতে যদি সত্য সত্যই বিশ্বাস করি, তবে কুণ্ঠাহীনভাবে বলতেই হবে রাষ্ট্রটি জনগণের সেই সাংবিধানিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করে এক ধরণের স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে একক হাতে সেই ক্ষমতা দখলে নিয়ে রাষ্ট্রে ঐ চার মৌলনীতির প্রতিটিকেই শুধুমাত্র অস্বীকার করে চলেছে তা-ই নয়-রাষ্ট্রটিকে পেছনে ঠেলতে ঠেলতে তার সাম্প্রদায়িকীকরণ করতে করতে আজ বাংলাদেশকে, তার মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ যাবতীয় বিজয় এবং বিজয়-জনিত গর্ব ও অহংকারকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে সম্ভাবনাময় এই দেশটার পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে এই দেশটার পাকিস্তানিকরণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করছে।
সাম্প্রতিকতম উদাহরণ উগ্র সাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের জানী দুশমন হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছে (মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে) দাবী উত্থাপন করে বলেছে, মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার আন্দোলনের জননন্দিত নেত্রী সুলতানা কামালকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হোক নতুবা পথে ঘাটে যেখানে তাঁকে পাবে তাঁকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করবে। বিকল্প প্রস্তাবও তারা দিয়ে বলেছে গ্রেফতার করা না হলে সুলতানা কামালকে তসলিমা নাসরীনের মত বাংলাদেশ থেকে বিতাড়ন করা হোক।
গ্রেফতার অবশ্য করা হয় নি এখনও বা সুলতানা কামালকে সরকারী পক্ষ থেকে দেশ ছাড়তেও বলা হয় নি। সম্ভবত: কারণটি হলো সুলতানা কামাল বাল্যকাল থেকেই ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আরও জানা যায় শেখ হাসিনা এবং সুলতানা কামাল পরস্পর বন্ধু এবং একে অপরকে নাকি “তুই” বলে আজও সম্বোধন করে থাকেন। এহেন পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাই হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রেখে থাকতে পারে সরকারকে।

কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এমন ঘনিষ্ঠ একজন সম্মানিত মহিলার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতা যে স্পর্ধিত হুমকি দিলো-সরকার তাদের বিরুদ্ধেও সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। মিথ্যা প্রচার, সম্মানহানি এবং জীবন নাশের হুমকি ঐ চরমপন্থীরা দিয়ে কিভাবে আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে তা ভাবলে উদ্বেগের অন্ত থাকে না। ঐ হুমকি সংবিধান বিরোধীও বটে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই হুমকির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে তাঁরা সর্বত্র প্রতিবাদ সমাবেশ ও করেছেন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলিও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু টুঁ শব্দটি করছেন না বাংলাদেশ সরকার বা সরকারের কোন মন্ত্রী বা এম.পি.। এই নীরবতা থেকে জঙ্গীবাদ উৎসাহিত হয় এবং তার ক্রম-উত্থানের অনুকূল পরিস্থিতিই সৃষ্টি করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যাঁরাই আদর্শনিষ্ঠ তাঁদের সবার জন্যই ঝুঁকির ইঙ্গিত বাহীও বটে।
হেফাজতে ইসলাম যে মাত্র কয়েক বছর আগে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করে ঢাকা অবরোধ করার ঘোষণা দিয়ে এই সরকারকে উৎখাত করার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে “নাস্তিক” বলে আখ্যায়িত করেছিলো দেশকে ইসলামীকরণের লক্ষ্যে তাদের ১৩ দফা দাবী উত্থাপন করেছিলো, দেশে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছিল-যার ফলে সরকার বাধ্য হয়ে গভীর রাতে পুলিশী হস্তক্ষেপ করে তাদেরকে ঢাকা থেকে হটিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়েছিল-সেদিনের কথাগুলি হয়তো বা ইচ্ছে করেই সরকার দিব্যি ভূলে গেছে।
ভুলে যায় নি শুধু। ঐ ঘটনার কিছু কালের মধ্যেই নানা চ্যানেলে যোগাযোগ করে হেফাজতের সাথে এক গোপন সমঝোতায় পৌঁছে যায় সরকার-যার পরিণতি স্বরূপ তেঁতুল হুজুর এক সময় বলেই ফেলেন “এই সরকার ভাল – তাদের সাথে হেফাজতে ইসলামের কোন বিরোধ নেই।” এমন একটি কলংকিত সার্টিফিকেট তো এমনি এমনিতেই আসেনি নিশ্চয় তার জন্যে সরকারকে বিস্তর তেল খড় পোড়াতে হয়েছে কোটি টাকায় জমি এবং বিস্তর নগদ টাকাও তাদেরকে দেওয়া হয়েছে-এমন খবর নানা মাধ্যমে তখন প্রচারিতও হয়েছিল।
পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ আরও ভয়ংকর আরও আতংকজনক। বাংলাদেশের চার মৌলনীতি তো বহু পূর্বেই “বিসমিল্লাহ্”, “জামায়াতে ইসলামী ও সকল ধর্মাশ্রয়ী দল বৈধ” ও “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সন্নিবেশিত করে যে সকল সশোধনী ২০১১-১২ সালে সংসদে পাশ করানো হলো তার চাপে ঐ চার মৌলনীতির অপমৃত্যুই ঘটানো হয়েছিল। দিনে দিনে তা আরও বেশী মাত্রায় দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
হেফাজতের ১৩ দফায় শিক্ষানীতি পরিবর্তনের যে প্রতিক্রিয়াশীল দাবী উত্থাপিত হয়েছিল, পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে অঘোষিতভাবে তা মেনে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী ঘটনা বেমালুম ঘটনো হয়েছে।

অত:পর কওমী মাদ্রাসার শেষ ডিগ্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মাষ্টার্স ডিগ্রীর সমতুল্য বলে ঘোষণা করে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সমতুল্য বলে মেনে নেওয় হয়েছে। বস্তুত: মাদ্রাসা শিক্ষাই যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কিন্তু ঐ শিক্ষার কোন আধুনিকায়ন নেই – তার সিলেবাস প্রণয়নের অধিকারও সরকারের নেই। ফলে দেশের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত এক ভয়াবহ অন্ধকারের আবর্তে নিপতিত হতে চলেছে। পাকিস্তানের চাইতে বেশী প্রতিক্রিয়াশিলতাই যেন আজ বাংলাদেশেকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। করে ফেলেছেও বহুলাংশে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সীমাহীন দুর্বলতা ও আপোষকামিতার সুযোগে।
একের পর এক, চোখের সামনে দেখছি সেই কতদিন হলো, ব্যবসায়ী সমাজের তীব্র বিরোধিতা সত্বেও রবিবারের বদলে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা হলো, অহেতুক শুধুমাত্র জিয়া বিরোধিতার কারণে ঢাকা বিমানবন্দরের নাম পাল্টে ইসলামী নাম দেওয়া হলো যদিও মক্কা, মদিনা, জেদ্দা, বাগগাদ, তেহরান, লাহোর, করাচী বিমানবন্দরগুলি নিজ নিজ শহরের নামে দিব্যি অবস্থান করছে। এবং সেই থেকে আমরা দ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ নয় বরং উগ্র ধর্মান্ধতাকে আঁকড়ে ধরার রাষ্ট্রীয় অপপ্রয়াস নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছি। তাতে কি আমরা কেউ ‘সওয়াব’ বা ‘পুণ্য’ সঞ্চয়ের অপপ্রয়াস নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছি। যার ফলে পরজন্মে হুর-পরী-সুরাদি পান করার সুযোগ পাব?
বাংলাদেশের পুলিশ যত্র তত্র জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাচ্ছে, জঙ্গী গ্রেফতার ও অস্ত্র, বোমা ও তার সরঞ্জামাদি উদ্ধার করছে প্রায় প্রতিদিনই। অর্থাৎ জঙ্গীবাদ রীতিমত প্রসার লাভ করে ফেলেছে বাংলাদেশে। জনগণের অগোচরে দেশ-জনগণ ও রাষ্ট্রের সর্বনাশ ঘটানোর লক্ষ্যে।
আজ দীর্ঘকাল ধরে আমাদের স্বপ্নের, আমাদের রক্তের, ঘামের, লাখো শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশের এহেন পশ্চাদ্ধাবন ও পাকিস্তান অভিমুখে ফিরতি যাত্রা দেখেও আজ ভাবতে বসে ঘটনাগুলির প্রতিরোধে নিজেরা কি করেছি একবারও কি তা গভীরভাবে ভেবে দেখছি? কার্যত: এই হীন প্রক্রিয়া প্রায় বিনা প্রতিরোধেই দিব্যি সমাপ্ত করতে চলেছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বয়ং।
এবারে আমি গণতান্ত্রিক শক্তি ও দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের একটি অংশের ভূমিকাটি সংক্ষিপ্তভাবে সামনে আনতে চাই। গণতান্ত্রিক শক্তি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কাদেরকে বলবো? এখানে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, এ দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি সমাজ সাধারণভাবে আওয়ামী লীগকে এবং একমাত্র আওয়ামী লীগকেই আজও বাংলােেশর গণতান্ত্রিক শক্তি বলে মনে করেন। অগণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্র বিরোধী শক্তি হিসেবে তাঁরা বি.এন.পি. জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম প্রমুখকে মনে করেন।

গণতন্ত্র বিরোধী বা অগণতান্ত্রিক শক্তি বলে যাদেরকে মনে করা হয় সে প্রশ্নে সামান্য বিরোধ থাকার কারণ না থাকলেও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আজও আওয়ামী লীগকে ভাবা যায় কি না তা গভীরভাবে ভাবতে হবে তার উপরে উল্লেখিত ধরাবাহিক ধর্ম নিরপেক্ষতা-বিরোধী নৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান ও ভূমিকার বিবেচনায়।

কোন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্য দায়ী ব্যক্তিকেই বিচারামলে না এনে বা শাস্তি প্রদান না করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বরং সহায়তা ও উৎসাহ প্রদান করে, হেফাজতের মত উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির কাছে দফায় দফায় নতি স্বীকার করে, বার বার কথাদিয়েও জামায়াতে ইসলামীকে বে-আইনি ঘোষণা না করে বিগত সাধারণ নির্বাচনের মত ভোটার বিহীন, প্রার্থী-বিহীন বিতর্কিত নির্বাচন করে পাঁচ পাঁচটি বছর রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা ধরে রেখে তাঁরা কতটা গণতন্ত্র রক্ষা করেছেন বা আজও করছেন তা ভাববার বিষয়। ষ্পষ্টভাষায় বলতে গেলে এগুলি আদৌ গণতন্ত্র সম্মত নয়।

আওয়ামী লীগ, দু:খজনক হলেও সত্য যে, আজ তার জন্মকালীন ও পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বকালীন আদর্শিক অবস্থান থেকে যোজন যোজন দূরে চলে এসেছে। আজ, হতে পারে আসন্ন ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনে জিতবার লক্ষ্যে নয়তো বা পূরোদস্তর ঐ আদর্শকে গ্রহণ ও ধারণ করে পশ্চাৎমুখী পথে চলতে শুরু করেছেন। যে কারণেই হোক, আওয়ামী লীগের জন্য এ এক ভায়াবহ সর্বনাশই ডেকে আনতে চলেছে এবং দেশটাকেও অন্ধকারে গহ্বরে নিক্ষেপ করছে।

সন্দেহ নেই, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই এই বিষয়ে বিস্তর মতানৈক্য রয়েছে কিন্তু যাঁদের ভিন্নমত রয়েছে তাঁরাও নিজ নিজ পদ অক্ষুন্ন রাখতে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না।
আর আমরা? আমরা যারা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও বামধারা বা বামপন্থী রাজনীতিতে আছি এবং একই রাজনীতিতে বর্তমান প্রজন্মের যাঁরা পথ চলছেন তাঁদের ভূমিকাই বা কি? বাস্তবানুগতভাবে খুঁটিয়ে সেগুলিও দেখা দরকার। নতুবা এক তরফা চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন থেকে দেশকে আদৌ এগিয়ে নেওয়া যাবে না। আত্মসমীক্ষার সে কারণেই বড্ড বেশি প্রয়োজন।
বাস্তব কথা হলো এই যে এই মুহুর্তে (বা ২০১৮ সালের) জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এদশের প্রগতিশীল গতান্ত্রিক শক্তিগুলি একজোট হলেও নিজস্ব শক্তিতে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে পারবেন না।

পারবেন না এ কারণে যে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কোথাও তাঁদেরকে দেখতেই পায় না। না আছেন রাজপথে না আছেন সভা-সমিতিতে-না আছেন কোন গণ-আন্দোলনে। ইস্যু টু ইস্যু সংবাদপত্রে কিছু বিবৃতি প্রদান বা বড় জোর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কিছু কর্মী নিয়ে মানববন্ধন করে তা সংবাদ মাধ্যমে ও ফেসবুক জাতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে কিছু লাইক পাওয়া। কোটি কোটি সাধারণ মানুষ ক্রমবর্ধমান দেশবাসী এতে প্রভাবিত হতে ন্যায্য কারণেই পারছেন না।

আর এ কারণেই আমরা মানুষের কাছে আজও আর আলোচিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিরাজ করছি না। যতই বেদনাদায়ক হোক ব্যাপারটা যে সত্য তা অন্তত: মনে মনে সবাই স্বীকার করবেন।
আমরা যে কত গভীরে কত দ্রুত তলিয়ে যেতে বসেছি, কষ্টার্জিত বাংলাদেশ কোথায় হারিয়ে যেতে চলেছে তা যদি আমরা প্রকৃতই সঠিকভাবে অনুধাবন করতাম তবে কোন কালে আমরা তত্ত্বের কচকচানি বাদ দিয়ে দ্রুত সমমনা ও নিকটমনা তাবৎ গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিকে ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে দেশজোড়া গণ-আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত করে দ্রুত জনগণের আস্থা অর্জন করার কোন বিকল্প নেই।

এই কাজগুলি করতে পারলে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের ক্যাডার বা কর্মী সংকটও ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে পারতাম। শরীরেও রক্ত সঞ্চালন বাড়তে পারতো। সমাজে ধীরে ধীরে স্থান করে নেওয়া যেতো সংসদেও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিছু কিছু করে ঢুকে জনগণের দাবী-উত্থাপন করে মানুষের সামনে আসা যেত। যে সময় চলে গেছে তার জন্য এখন আর তা না ভেবে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐ পথে অগ্রসর হওয়ার বিকল্প নেই। হচ্ছি না বলে দেশের এই পশ্চাদ্ধাবনে আমরাও সমভাবে অপরাধী। ষ্পষ্টভাষায় তা স্বীকার করা ও সে মতে দ্রুত অগ্রসর হলেই মাত্র নিন্ধটি লেখার উদ্দেশ্য সফল হলো বলে ভাববো। নইলে তা অরণ্যে রোদনেই পর্য্যবসিত হবে।


 

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!