রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার একাধিক রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে

অনলাইন ডেস্ক  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের পর এবার একাধিক রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে হোটেলটি চালুর বৈধতা নিয়ে। তদন্তে বাদ যাচ্ছে না আপন জুয়েলার্সের গোল্ড আমদানির বিষয়টিও। ধর্ষিতাদের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে নেমে বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে বেশকিছু তথ্য মিলেছে।

সূত্র জানায় প্রথম দিনের রিমান্ডেও আগের বক্তব্যে অনড় রয়েছেন মামলার আসামি সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ। তারা দাবি করেছেন, অভিযোগকারী তরুণীদের সঙ্গে তাদের ‘সম্মতিতেই’ তারা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তবে মামলার ৭ দিনেও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি ধর্ষণের মূলহোতা নাঈম আশরাফ এবং তাদের অপর তিন সহযোগীকে। উদ্ধার হয়নি ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজও। তাদের গ্রেপ্তারে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ২৮ মার্চ রাতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মদ পান করিয়ে তাদের ধর্ষণ করে সাফাত ও নাঈম আশরাফ। শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হওয়ায় সাফাত পিস্তল তাক করে গুলি করার ভয় দেখাচ্ছিলেন। আর নাঈম কিল-ঘুষি-চড় দেন। সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল দুই রুমে ঘুরে ঘুরে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করেন। যে কক্ষ দুটিতে ধর্ষণের এ তা-ব চলছিল, সেগুলোর বাইরেই দাঁড়িয়ে শাফাতের বডিগার্ড আবুল কালাম আজাদ পাহারা দেন। আর রেইনট্রির দুই কর্মকর্তা, বেয়ারা একাধিকবার কক্ষ দুটির সামনে এসে খোঁজ নেন, সব ঠিকমত চলছে কিনা।

এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের বিষয়ে গতকাল তদন্তে গিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম ও সদস্য শরীফ উদ্দিন জানান, দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় হোটেলটিতে সেদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে আড়াই ঘণ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তারা এসব কথা বলেন। অথচ ফোরস্টার প্লাস ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে অদ্ভুত দাবি করেছেন। হোটেলের উদ্বোধন ও ধর্ষণের ঘটনার তারিখ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মিলেছে হোটেল সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকেই।

জানা গেছে, রেইনট্রি হোটেল অবৈধভাবে খোলা রাখা হয়েছে। মাদক সেবনসহ নানা রকমের অবৈধ কর্মকা- চলে ওই হোটেলে। আবাসিক হোটেলটির কার্যক্রম এতদিন চলছিল অবৈধভাবে। ফলে ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে রাজউককে অন্ধকারে রেখে হোটেলটি ব্যবহার শুরু করে কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি হোটেলটিতে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা নজরে আসে রাজউক কর্তৃপক্ষের। ইতোমধ্যে রাজউক অঞ্চল-৪ এর (গুলশান-বনানী-বারিধারা) একটি টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে হোটেলটি চালু অবস্থায় দেখতে পায়। এদিকে গতকাল দুপুরে হোটেলটিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালালেও সেখানে কোনো মাদকদ্যব্যের অস্তিত্ব পাননি।

জানা গেছে, হোটেলটির মালিকপক্ষ ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুন। তার বড় ছেলে নাহিয়ান হারুন হোটেলের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজো ছেলে আদনান হারুন ও পরিচালক ছোট ছেলে মাহির হারুন। এমপি নিজেই প্রভাব বিস্তার করে এতদিন অবৈধভাবে হোটেলটি চালাচ্ছিলেন।

এ বিষয়ে রাজউক অঞ্চল-৪ এর অথরাইজড অফিসার আদিলুজ্জামান জানান, অবৈধভাবে চালানোর দায়ে রেইনট্রি হোটেলটিতে একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। এরপর ফের চালুর ব্যাপারে রাজউক থেকে তারা কোনো অনুমতি নেয়নি। ফলে হোটেলটি চালু করার কোনো এখতিয়ার নেই কর্তৃপক্ষের।

এদিকে আপন জুয়েলার্সের সোনা আমদানির বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্তে নেমেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের গোয়েন্দারা।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান জানান, বনানীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার আসামি সাফাত আহমেদ ও তার বাবা দিলদার আহমেদের সব ব্যাংক হিসাব তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের অর্থের উৎস জানতে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। এছাড়া তাদের ব্যবসায়িক লেনদেনে স্বচ্ছতা আছে কিনা, তা জানার জন্য আপন জুয়েলার্সেরও হিসাব চাওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, উচ্চ শুল্ক ফাঁকি দিতে চোরাচালানের মাধ্যমে ডায়ামন্ড আমদানি করেই চলছে আপন জুয়েলার্স স্বর্ণের কারবার। বৈধভাবে এক ক্যারেট (দশমিক ২ গ্রাম) ডায়ামন্ড আমদানি না করেও রাজধানীর গুলশান, বায়তুল মোকাররম ও উত্তরার শোরুমে বিক্রি হচ্ছে ডায়ামন্ডের অলঙ্কার। অথচ ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈধভাবে ডায়ামন্ড আমদানিকারক যে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এ তালিকায় নেই আপন জুয়েলার্সের নাম।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল একাধিকবার আপন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী দিলদার আহমেদ সেলিমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে আলোচিত এ ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের মামলা নিতে পুলিশের টালবাহানা, সময়ক্ষেপণ ও ধর্ষিত দুই তরুণীকে নানাভাবে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে ডিএমপির পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি মাঠে কাজ করছে। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগীদের প্রতি বনানী থানার ওসির একপেশে আচরণ, দায়িত্বশীল আচরণের বিপরীতে অসহযোগিতার যে অভিযোগ, তার কিছু সত্যতাও পেয়েছেন তারা। তবে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে মুখ খোলেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কেউই।

পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় কারো দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ মিললে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ফেঁসে যেতে পারেন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলীসহ আরও এক পুলিশ কর্তা।

এদিকে রেইনট্রির ব্যবস্থাপক ফ্রাঙ্ক ফরগেট জানিয়েছেন, ২৮ মার্চ হোটেলটিতে ৫৮ জন স্টাফ কাজ করেছেন। আমরা তাদের সবাইকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের কারো চোখে অস্বাভাবিক কিছু পড়েনি। ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ট্যুরিজমের নিয়ম অনুযায়ী আমরা ৩০ দিনের বেশি সময়ের ফুটেজ সংরক্ষণে রাখি না। তাই সেদিনের ফুটেজ নেই আমাদের কাছে। এখানে কফিবার রয়েছে। তবে হোটেলটির বারের কোনো লাইসেন্স না থাকায় মদের কোনো বার নেই।

উৎসঃ   আমাদের সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!