কষ্টের কথা, ভালবাসার কথা ও উচ্ছাসের গল্প

কষ্টের কথা, ভালবাসার কথা ও উচ্ছাসের গল্প
-ফরিদা ইয়াসমিন জেসি
ফাউন্ডার, আর্ন এন্ড লিভ

আমার মেয়ের নাম সাহেদা। আমি তার মা। সে আমাকে মা বলে ডাকে।
সাহেদার জন্ম হয়নি আমার ঘরে , বিলেতের রয়েল লন্ডন হাস্পাতালে। রয়েল লন্ডনের আকাশচুম্বী হাস্পাতালে যার জন্ম হয়েছে তার নাম তাস্নিয়া, সে ও আমার মেয়ে।

তাছনিয়ার জন্মলগ্নে ছিলো তারার মেলার ভীড়। সাদা রঙের বিদেশি নার্সদের কোলাহল, থোকা থোকা ফুলের বুকে, বাহারি রঙ এর ভিউকার্ড, সেলিব্রেট সুইট বক্স, আরো কত কি।

পিং কালারের মখমলের গাউনে আবৃত আমি চেয়ে দেখি তাছনিয়াকে, তার কান্না তার হাসি আমাকে দেয় পৃথিবী সমান মধুর উল্লাস।

আমার মেয়ে সাহেদার জন্ম হয় অন্য কোনো মায়ের কুলে, অন্য কোনো একটা টিনের ঘরে। বিশেষ শিশু হয়ে হয় জন্ম তার । সমাজের কাছে নাম তার প্রতিবন্ধি। জন্ম হয় অবাঞ্চিত হয়ে পৃথিবীর কঠিন সময়ে।
ছোট বেলার দিনগুলি তাস্নিয়া আর সাহেদাদের সমানই হয় , খেলা, হাসি, গান সব শিশুদেরই সমান হয় তবে তাছনিয়া খেলে ইলেকট্রনিক মিউজিক ইন্সট্রোমেন্ট দিয়ে, সাহেদা খেলে জোনাকির আলো দিয়ে। তাছনিয়া খেলে ট্রাম্পেলিন আর পাজল দিয়ে সাহেদা খেলে পাট খড়ির পাশা খেলা।

সপ্ন হয় দুজনের ভিন্ন। একজন হবে ডাক্তার, একজন হবে হাতের কাজের শিল্পি, হবে স্বাবলম্বী।

তাছিনিয়া আকতে ভালবাসে আকে রং তুলি দিয়ে, সাহেদা আকে ফুল পাতা কাপড়ের গায়ে।

তাছনিয়া -ডাক্তার হবে চিকিৎসা দিবে অসহায়কে।
সাহেদার -নিজের পায়ে দাঁড়াবে আরো দশজন প্রতিবন্ধীকে সাবলম্বি করবে। এই হয় দুজনের সপ্ন দেখা।

আর আমার সপ্ন দেখা হয় আমার দুই মেয়ে একই রকম ঘরে থাকুক, একিই খেলা খেলোক,একি সুবিধায় বড় হয়ে থাকুক দুধে ভাতে তাই আমার খেয়াল আজকাল ধিরে ধিরে তাছনিয়ার চেয়ে সাহেদার দিকে থাকে। তাছনিয়ার কাছে আছে বিলেতি এডোকেশন -স্কুলে যাবার জন্য গাড়ি- খাবারের জন্য আছে মিড ডে মিল সুপারভাইজার।

কিন্তু আমার সাহেদার কাছে তা কিছুই নেই। সাহেদার আছে যুদ্ধ, সাহেদার আছে কষ্ট, অভিমান। সমাজের সাথে, মানুষের সাথে।
অন্যের বই চেয়ে, ফেলে দেয়া প্রশ্নপত্র দেখে পড়াশুনা হয় সাহেদার। আসমানীদের মত রসুল পুরের ঘরের ভেতর গুমরে পার করে সময় সে।
সাহেদা আমাকে লিখে পাঠায়, মা কি করো? মা কেমন আছো? আমি যখন থাকি গভীর রাতে জায়নামাযে। সাহেদার তখন দুপুর বেলা। কখনো আমার দুপুর বেলায় সাহেদার থাকে গভির রাত। ঘুম না আসলে লিখে পাঠায়, মা কি করো ঘুম আসছে না। তোমার সাথে কথা বলি। আমার অসুখে সাহেদা অস্থির হয়ে দোয়া মাগে আল্লাহর দরবারে, আমাকে লিখে পাঠায় সকালের ঔষধ খেয়েছো নাকি, বিকেলের ঔষধ খেয়েছো নাকি। আমি চোখ মুছি অবলীলায়, তাছনিয়া কাছে এসে ঔষধ দেয় হাতে আর পড়ে সাহেদার লেখা।

যখন লিখি ভাল হয়ে উঠেছি তখন পৃথিবীর এপাড় থেকে মা এর উত্তরে সান্তনা নেয় কোনো এক সন্তান, সে জানে সন্তানেরও দায়িত্ব আছে তাই খবর নেয় সময় অসময়ে মায়ের।

যে মা তার সপ্নের দাম দিয়ে চলেছে। ঘর থেকে জনসমুদ্রে তুলে এনে দিতে জাচ্ছে সমান অধিকার। সাহেদা ছিলো একজন নিথর পাথর, আজ সে খোলা চুলে কদম ফুল গুজে সেজে হয়েছে শিল্পিত, আজ তার চোখে মুখে ফুলের পাপড়ির উদ্ভাস যেখানে ছিলো শুধু কান্নার জল।

আজ সে একজন কর্নধার, আর্ন এন্ড লিভের একটি সেন্টার চলে আজ তার দায়িত্বে। প্রতিবন্ধী ও দুস্থ মহিলাদের করে সে পরিচালনা ।

এগিয়ে যাচ্ছে সাহেদা এগিয়ে যাচ্ছে তাছনিয়া তাদের সপ্নের সিড়ি বেয়ে উপরে। আমি আছি তাদের মা, তাদের জন্য প্রার্থনারত মোনাজাতে বিধাতার দরবারে।

আমি আছি অবিরাম চেষ্টা প্রচেষ্টায় কি করে সব সন্তানেরা পাবে সমান অধিকার, সমান ভালবাসা, প্রতিবন্ধী রা আর হবেনা অবহেলিত, থাকবেনা বদ্ধ ঘরে লোকানো। তারা বাইরে আসবে, লিডারশীপ এ থাকবে কখোনো কখনো। করেছি” আর্ন এন্ড লিভ” এই বিশেষ শিশুদের জন্য প্লাটফর্ম।

বিঃদ্রঃ সাহেদা এখন পঞ্চাশের মত এক গ্রুপ মহিলাকে লিড দিচ্ছে। সাহেদার কে সহায়তা করছে আর্ন এন্ড লিভের ডিজাইনার সুমি আক্তার, অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে সুমি আক্তার ও রুম্পা রাহা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!