(ক) তফশিল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আদৌ হবে কি?

 

 

(ক) তফশিল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আদৌ হবে কি?
রণেশ শৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

আমরা সংবিধানের একটি সংশোধনী বাতিল হওয়াতে দেশ-বিদেশে ঝড় তুলে ফেলতে দেরী করি নি। সেই পহেলা আগষ্টে শুরু হওয়া ঝড় আজ অক্টোবরের শেষে এসেও থামে নি। হয়তো বা তা অব্যাহত থাকবে আগামী ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারী পর্য্যন্ত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আনুষ্ঠানিক বিদায় অবধি।
কিন্তু সংসদের পাশ করা ষোড়শ সংশোধনী না হয় আদালত বাতিল করেছে তাতে সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতায় আদালত হস্তক্ষেপ করেছে এমন অভিযোগ এনেছেন মন্ত্রী সাংসদেরা। এ বিতর্কের শেষ কোনদিন হবে বলে মনে হয় না। কারণ এতদিন জানতাম সংসদ প্রণীত আইনকে উপযুক্ত কারণে বে-আইনী ঘোষণা করার অধিকার উচ্চ আদালতের রয়েছে। অতীতে বহু ক্ষেত্রে আদালত তা করেছেনও বটে কিন্তু এমন সংসদীয় বিতর্ক তেমন একটা ঘটতেদ দেখা যায় নি। এবারে ঘটলো আমরা সবাই তা দেখলাম। দেখবো এর সমাপ্তি কিভাবে হয় কখন হয়।
কিন্তু যে আইন নিয়ে আমি আজকের নিবন্ধটি লিখতে বসেছি সে আইনটি আজ থেকে ১৭ বছর আগে সংসদই প্রণয়ন করেছিলো। কদাপি এ আইন সংসদ বা আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হয় নি। বারংবার সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বলা হয়েছে এই সরকার এই আইন অবশ্যই কার্য্যকর করবেন…..ইত্যাদি। এই আলোচ্য আইনটির নাম হলো “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-২০০১”। আইনটি দিব্যি এখনও বহাল আছে। তবেশুধুমাত্র পাঁচ বছর (বি.এন.পি. ক্ষমতায় আসায়) এর কার্য্যকর করা হচ্ছে না? আইনটিকে জীবন্মৃত করে আর কতোকাল রাখা হবে?
আইনটির ইতিহাসও ‘ঐতিহাসিক’। “অর্পিত সম্পত্তি” নামটি দেওয়া হয় ১৯৭২ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে। তখন ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার। নতুন করে দেওয়া এই নামটি এ আইনের আসল নাম নয়। আসল নামটি ছিল “শত্রু সম্পত্তি আইন”। এটি রচিত ও চালু করেছিলো পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে পাঁক-ভারত যুদ্ধ চলাকালে। সেই ১৯৬৫ সাল থেকে আজ ২০১৭ সাল পর্য্যন্ত শুধুমাত্র এর নামটির পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই আইনে উল্লেখিত সম্পত্তি প্রত্যর্পনের জন্য আর একটি আইন ২০০১ সালে প্রণীত হয়েছে।
কিন্তু কার্য্যত: দেখা যায়, পাকিস্তান না থাকলেও পাকিস্তানের “শুত্রু সম্পত্তি আইন টি অনেক বেশী শক্তিশালী এ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন আইন” নামক বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক প্রণীত আইনের চাইতে। কারণ পাকিস্তন সরকার রচিত শত্রু সম্পত্তি আইনের প্রয়োগ তুমুল শক্তি নিয়ে। ঐ আইনের স্পিরিট অনুযায়ী হিন্দুদের (ভারতে চলে যাওয়া বা এদেশেই বাস করা নির্বিশেষে) কোটি কোটি হিন্দুকে দিব্যি পাকিস্তানের শত্রু বিবেচনা করে তাদের সব সম্পত্তি, বাড়ীঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানাকে “শত্রু সম্পত্তি” হিসেবে ঘোষণা করে দিব্যি লুট-পাট করা হলো। কোটি কোটি হিন্দুকে সহায়-সম্পদহীন অবস্থায় দেশত্যাগে বাধ্য করা হলো এবং তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির প্রায় সমুদয় অংশ সরকারী দলের নেতা-চামুস্তারা রক্ষক বা বন্ধু সেজে দিব্যি চিরতরে দখল নিয়ে কাগজপত্র তৈরী করে তার মালিক সেজে বসলেন।
অপরপক্ষে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সরকার কর্তৃক ২০০১ সালে প্রণীত “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-২০০১” দিব্যি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। কোন প্রয়োগ নেই প্রয়োগের কোন বিজ্ঞপ্তিও সরকারের উচ্চতর মহল থেকে নি¤œতর মহলে এতগুলি বছরের মধ্যে পাঠানো হয় নি। ফলে না ‘নড়ন চড়ন’।
এই প্রত্যর্পণ আইনে তাবৎ শত্রু (বা অর্পিত) সম্পত্তিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। “ক” ও “খ” তফসিলে বিভক্ত করা হলে জানানো হলো “ক” তফসীলভূক্ত সম্পত্তি (যার প্রধান অংশই বসতবাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমি) প্রত্যর্পণ করা হবে এবং এক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার পাবেন যেগুলির মালিক বা তাঁদের বৈধ ও ওয়ারিশ বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে এমন কেউ থাকলে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি ফেরত পাবার জন্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দলিলাদিসহ নির্দিষ্ট ট্রাইব্যুনালে নির্দিষ্ট সময় কালের মধ্যে আবেদন করতে হবে। এমন ট্রাইব্যুগণ প্রত্যেক জেলায় গঠনও করে দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনাল প্রাপ্ত কাগজপত্র ও দলিলাদি ও সাক্ষ্যসাবুদ বিবেচনা করে রায় দিলে তাঁরা তা ফেরত পারেন। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে সংশ্লিষ্ট উচ্চতর আদালতে আপিল দায়ের করতে পারবেন এবং আপিলের আদেশ শিরোধার্য্য।
দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবেন যাঁরা ঐ গৃহাদি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে বছর বছর নিয়ম মাফিক লিজের টাকা পরিশোধ করে বসবাস করছেন তাঁরা যদি বাড়ী বা সম্পত্তি নিতে ইচ্ছুক হন তাঁরা তা পাবেন তবে যদি সরকারের নিজস্ব কোন প্রয়োজন না থাকে ঐ সম্পত্তিকে ঘিরে। সে ক্ষেত্রে ঐ লীজ গ্রহীতার নিজস্ব কোন বাড়ী না থাকার শর্তও রয়েছে।
খোঁজ-খবর নিয়ে যতদূর জানা গেছে (ক) তফশীল ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ যতটা আইনত: হওয়ার কথা বাস্তব হিসাবে পাওয়া গেছে তার চাইতে অনেক কম। এটার কারণ এ নয় ঐ সম্পত্তিগুলি মালিক বা তার বাংলাদেশের নাগরিক স্থায়ী বাসিন্দাদেরকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত কারণ হলো ঐ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি জাল দলিল করে মিথ্যা মোকর্দমা দায়ের করে এক শ্রেণীর অসৎ আইনজীবী কিছু সংখ্যক দুর্নীতিপরায়ন বিচারকের সাথে যোগ সাজলে সেগুলি অর্পিত সম্পত্তি নয় মর্মে আদালতের রায় তাদের অনুকূলে নিয়ে তাদের মালিকানায় নিয়ে নিয়েছে।
২০০১ সালে প্রত্যর্পণ আইন পাশ হয়ে গেজেট হওয়া সত্বেও এ যাবত ঐ স্বল্প পরিমাণে সম্পত্তি (যা ‘ক’ তফশিলভূক্ত) প্রত্যার্পণ আজতক দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া শুরুই হয় নি। তবে এ যাবত ৪/৫ দফা অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়েছে মাত্র।
অপরদিকে শত্রু সম্পত্তি আইনে বলা ছিল, লিজ গ্রহীতা ঐ রূপ বাড়ী প্রয়োজনে মেরামত করতে পারলেও তার জন্য ব্যয়ভার সরকার বহন করবে না। ফলে বাড়ীগুলি যা শতাধিক বছর আগে নির্মিত সবই জরাজীর্ণ হয়ে বাসের অযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আইনে আরও বলা আছে যে লিজ গ্রহীতা নিজ ব্যয়ে মেরামত করতে পারলেও ঘরের ছাদ ঢালাই করতে পারবেন না। অপরদিকে বাৎসরিক লিজের টাকার পরিমাণ ২/৩ বছর পর পরই বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এই পরিস্থিতির শিকার। বিগত ৮০র দশকে পাবনা বেলতলা রোডস্থ অর্পিত সম্পত্তি ঘোষিত (ক) তফশীলভূক্ত বাড়ী- (যা ভি.পি.মিস কেস ৫৭/পাব/১৯৬৫-৬৬ নং লিপিবদ্ধ) তৎকালীন জেলা প্রশাসক-অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অনেকটা সেধেই আমাকে বাৎসরিক লিজ দিয়েছিলেন। সেধে দেওয়াপর কারণ তাঁরা যে মুহুর্তে জানলেন, আমি একজন ভাষা-সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক কারণে-পাকিস্তান আমলে দীর্ঘকাল কারা জীবন যাপন করতে হয়েছে তখন তাঁরা আমার তৎকালীন ভাড়াটিয়া বাসায় (পাবনার কাচারীপাড়াস্থ) অকস্মাৎ গিয়ে একটি শ্লিপ কাগজে হাতে লেখা ভিপি. মিস কেস নং ও তফসীল আমাকে ধরিয়ে দিয়ে একটি দরখাস্ত করে লিজ চাইতে বললেন।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পরদিন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অফিসে গিয়ে তাঁর হাতে জমা দিতেই তিনি মুহুর্তে সবকিছু রেডি করে লিজ মঞ্জুর করে আমার হাতে কাগজ ধরিয়ে দিলেন। পরে জানা গেল বাড়ীটি অবৈধ দখলদায়ের দখলে আছে। তখন তাদেরকে নোটিশ প্রদানসহ তাবৎ প্রক্রিয়াশেষে পুলিশ ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়ে ঐ অবৈধ দখলদারদের উৎখাত করে আমার হাতে দখল বুঝে দেন। আজও সেই বাড়ীটিতে বাস করছি।
পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক কারণে বারংবার কারাগারে বিনাবিচারে নিক্ষেপ করেছে তাই নয় – তারা কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকুরীও করতে দেয় নি। সে কারণে কোন বসত বাড়ি নির্মাণও সম্ভব হয় নি।
এমতাবস্থায় ভূমিমন্ত্রী বরাবর দরখাস্ত করি তিন বছর আগে বাড়ীটি স্থায়ীভাবে আমাকে দেয়া হোক প্রত্যর্পণ আইন অনুসারে। কিছুকাল পর তিনি পাবনা সফরে এসে আমার অনুপস্থিতিতে পাবনা সার্কিট হাউসে সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করতে বসে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে মৌলিক নির্দেশ দেন-বাড়ীটি যেন রণেশ মৈত্রকে সত্বর দিয়ে দেওয়া হয়। অত:পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও লিখিত কোন নির্দেশ না আসায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মৌলিক নির্দেশ কার্য্যকর করতে পারছেন না।
অত:পর মন্ত্রী বরাবর দরখাস্ত পাঠিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায় নি।
বলা বাহুল্য কথিত এই বাড়ির মূল মালিক বা তাঁদের কোন বংশধর ওয়ারিশ এ দেশে বাস করেন না কেউ বাড়ীটি দাবীও করেন না।
এমতাবস্থায় আমার বরাবর বাড়ীটির মালিকানা হস্তান্তরে আইনগত সামান্যতম বাধাও নেই।
অকস্মাৎ একদিন ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিবকে টেলিফোনে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানিয়েছিলেন এ জাতীয় বাড়ীগুলি প্রত্যর্পণের জন্যে মন্ত্রণালয় থেকে কিছু নির্দেশনামূলক নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তা প্রণীত হলেই সকল জেলা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে তা জানিয়েছে দেওয়া হবে। সেজন্যে কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। সেটাও দু’বছর আগের কথা।
তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন করতে হয় (ক) তফশীলভূক্ত অর্পিত সম্পত্তিগুলি আদৌ কি প্রত্যর্পণ করা হবে? না কি এবারে মার্কা বিশেষে ভোট দিলে ভোটে জয়যুক্ত হলে তা করা হবে বলে আসন্ন নির্বাচনেও নির্বাচনী কর্মসূচীতে বিষয়টি স্থান পাবে?


কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।


 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!