প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য কেন প্রয়োজন?

 

 

রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য,ঐক্য ন্যাপ

নিত্যদিনের সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দিব্যি চোখের সামনে ভেসে ওঠে নির্বাচন প্রস্তুতির খবর। মূলত: আজও তা দুটি বড় দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার একটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ও তার সাথে জোটবদ্ধ হওয়া দলগুলির। আর দ্বিতীয়টি হলো বি এন পির এবং তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে। দেশব্যাপী ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ির অন্ত নেই এই দুটি জোটের নেতাদের।
অনেক পিছিয়ে থাকলেও নানা রূপে নানা সময়ে নানা মূর্তিতে স্বৈরাচারী (বা স্বৈরতন্ত্রি- গণতন্ত্রি) ভেসে উঠছেন হোসায়েন মুহাম্মদ এরশাদও। “আমিই বা কম কিসে” এমন চিন্তা থেকেই প্রধানত: তিনিও ঢাউস মার্কা কিন্তু ভেতরে ফাঁপা লোক দেখানো বাজার গরম করা এক ভূয়া ইসলামী জোটের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী ঘর গোছাতে শুরু করেছেন যার উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগ যাতে তাদেরকে শক্তিহীন অংশীদার বলে না ভাবে এবং নিজ দলের হতাশাগ্রস্ত লোকদের মনে যতটা সম্ভব চাঙাভাব জাগ্রত করা।
বিএনপি অবশেষে আগামী দিনগুলিতে কি করবে তার একটি ছক রূপকল্প ২০৩০ নামে বেশ ঘটা করে দেশবাসীর সামনে হাজির করেছে অতীতের তুলনায় যা কিছুটা ইতিবাচকও। কোন বামপন্থী দল এই রুপকল্প-২০৩০ সম্পর্কে সামান্যতম মন্তব্য করেছেন আজও এমনটা আমার চোখে পড়ে নি। কিন্তু মন্তব্য আসা উচিত ছিল বলে মনে করি।
বিএনপির ঘোষিত রূপকল্পের ত্রুটিও কম নয়। এখনও তারা যুদ্ধাপরাধী সংক্রান্ত ইস্যুতে, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন সংক্রান্ত ব্যাপারে মুখ খোলেন নি-অর্থাৎ এ ব্যাপারে তাঁরা তাঁদের অতীত ভূমিকার সপক্ষেই অবস্থান রাখছেন। ফলে অপরাপর কর্মসূচীর বাস্তবায়ন ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন অতীতের মত প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গেল। জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোটবদ্ধ থাকলেও জামায়াত বস্তুত: বিএনপির সাথেই কার্য্যত: থাকছে না কি গোপনে গোপনে তারা আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ে কার্য্যত: দলটির অবলুপ্তি ঘটানোর কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট না হলেও জামায়াতের নিম্ন ও মধ্যস্তরের এক বিশাল অংশ যে ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছে (এবং সেখানে সাদরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে গৃহীতও হয়েছে) তা কম-বেশি সকলেরই জানা।
এ পরিস্থিতে সব চাইতে উগ্র ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক-স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী নেতা কর্মীদেরকে দৃশ্যত: গ্রেফতার ও মামলা-মাকর্দমার হামেশা শিকার হতে দেখা গেলেও লক্ষ্যনীয় যে আটককৃত যে সকল অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে কোন চার্জসীট, বা বিচার শুরু কিংবা শেষ হওয়া বা শান্তি হওয়ার একটি খবরও এ যাবতকাল পর্য্যন্ত চোখে পড়ে নি। অর্থাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালে কোন এক অজানা চুক্তিতে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা হয়তো প্রত্যহিত হচ্ছে এবং গোপনেই তাদের কারামুক্তি ঘটছে। জেল থেকে বেরিয়ে হয়তো সরাসরি তারা আওয়ামী লীগে যোগদানও করছে।
লক্ষ্যনীয় যে সাম্প্রতিককালে জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক জামায়াত নেতা-কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভার চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলার বা সদস্য পদে ও নির্বাচিত হয়েছেন।
ফলে বলাই যায়, দুটি বৃহৎ দলেই জামায়াতের সদা সচ্ছন্দ বিচরণ এবং সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিমুক্ত অবস্থানে দিব্যি পৌঁছেছে স্বাধীনতা-বিরোধী জামায়াতে ইসলামী। তবে এ কথা সত্য যে তারা কদাপি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা/আদর্শ রূপায়নের কথা বলে না। তারা ইসলামী ভাবধারায় পরিকল্পিত এবং ইসলামী চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিবেদিত। এ প্রশ্নে তাদের কোন রাখ-ঢাক নেই এবং জামায়াত কর্মীদের এই আদর্শিক অবস্থান আওয়ামী লীগ দিব্যি হজম করে চলেছে। হালের আওয়ামী লীগের সম্ভবত: তাতে খুব একটা আপত্তিও নেই।
এর সর্বাধিক বড় প্রমাণ সবার চোখেই দিব্যি ধরা পড়েছে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অপর উগ্র ধর্মান্ধ হেফাজতে ইসলামের সাথে প্রকাশ্য আঁতাত এবং তা অতি প্রকাশ্যে। ভারত সফর করে ফিরে এসেই মাননীয় প্রধান মন্ত্রী প্রথম সে কাজটি করলেন তা হলো তিনি কয়েকশত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষক ও তাদের নেতা (সবাই হেফাজতে ব্যানারে সক্রিয়) “তেঁতুল হুজুর” বলে খ্যতো আল−ামা শফির সাথে এক আকস্মিক বৈঠক। এ বৈঠকের ভিডিও চিত্র দিব্যি সরাসরি টি.ভি চ্যানেলগুলিতেও দেখানো হলো। তাতে দেখা গেল আল−ামা শফি দাবী তুললেন কওমী মাদ্রাসার শেষ ডিগ্রীকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাষ্টার্স ডিগ্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং অবাক বিস্ময়ে দেখা গেল তিনি তৎক্ষনাৎ দাবীটি মেনে নিলেন কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে ও শিক্ষাবিদদের সাথে আলাপ আলোচনা ছাড়াই।
তাৎক্ষনিকভাবে এই স্বীকৃতি দেওয়ায় হেফাজত কওমী শিক্ষকরা দিব্যি “আলহামদুল্লিাহ” বলে দোয়া পড়ে তাঁদের অসীম কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি।
সঙ্গে সঙ্গে আল−ামা শফি দাবী করলেন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে গ্রীক দেবীর মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার। অবিস্বাস্য দ্রুততায় শেখ হাসিনা এ দাবীর প্রতিও তাঁর সহমত ঘোষনা করলেন। সৃষ্টি করলেন জাতির জন্য পরম এক বিস্ময়ের। আবার তেমনই দ্রুততার সাথে তিনি না কি বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপ্রতির সাথে কথাও বলেছেন। তাবে জানা যাচ্ছে না এ পর্য্যন্তও কী ঘটতে যাচ্ছে ঐ ভাস্কর্য্যটির ভাগ্যে। কিন্তু শেষ হুমকি হেফাজতরা দিয়েছে, আসন্ন রমজানের আগেই যেন মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হয়।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানতম পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাই প্রত্যাশা হলো তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন। তাঁর দফায় দফায় জাতির কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকারও তেমনই। কিন্তু বাস্তবে?
নির্মম বাস্তবতায় দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্ট বে-আইনী এবং বাতিল ঘোষণা করার পর পরই তিনি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীর “বিসমিল্লাহ” “জামায়াতে ইসলামী” সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলের বৈধতা” এবং এরশাদের “রাষ্টধর্ম ইসলাম” তাতে সংযোজন করে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের অবিতর্কিত পরিপূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধানের বিকৃতি ঘটিয়ে তাতে সাম্প্রদায়িকতাকে স্থান করে দিলেন।
মাত্র তিনটি বছর যেতে না যেতেই দিব্যি সরকার উচ্ছেদের ঘোষণা দানকারী হেফাজতে ইসলামের নির্দেশ মেনে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ থেকে সুরু করে কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে মাষ্টার্স ডিগ্রীর সম মর্যাদা প্রদান ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য্য অপসারণে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার যেমন বার্তা দিলেন পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও তেমনটি করে সাহস পায় নি। বঙ্গবন্ধু আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের তাঁরই হাতে বিপর্য্যস্ত, ¤−ান ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। সকল অসাম্প্রদায়িক শক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিষ্ঠাবান শক্তিগুলি আজ হতাশার পংকে নিমজ্জিত। অপরদিকে সকল সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি আজ উপজ্জীবিত। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষনার প্রতিশ্রুতিও পূরণ হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই।
সব কিছু মিলিয়ে যে রাজনৈতিক আবহে বাংলাদেশ নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুগে আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে দ্রুত বেগে ছুটছে বাংলাদেশ। এই গতি পাকিস্তান মুখী তাই জাতিকে সর্বপ্রযতেœ রোধ করতে হবে বাঁচাতে হবে ঐ পশ্চাদমুখী, পাকিস্তানমুখী গতিকে-বাঁচাতে হবে স্বপ্নের, সাধের, কল্পনার, লড়াই এর, বিজয়ের, ঐতিহ্যের বাংলাদেশকে। বাঁচাতে হবে গণতন্ত্রকে। গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র নির্বাচন নয়-গণতন্ত্র মানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-লিঙ্গ-গাত্রবর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সম-মর্য্যাদা সমান অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। এর প্রয়োজন একটি অগ্রসরমান বাংলাদেশ গড়ার জন্যেই।
কিন্তু কার্য্যত: যখন দেখি এই আদর্শীক পশ্চাদগতি রোধের পরিকল্পনা ও প্রত্যয় নিয়ে নয় বরং তাকে অধিকতর গতিশীল করার লক্ষ্য নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন সুরু হতে এ নির্বাচন জনগণের স্বার্থানুকুল কোন ফল বয়ে আনবে না বরং তা এক দুঃসহ গতানুগতিকতায়ই পর্য্যবসিত হবে।
এমতাবস্থায় রাজনীতির এই পশ্চাদমুখী গতিকে রোধ করার কাজটি পূরাপুরি আদর্শিক এবং সেই আদর্শ নিষ্ঠ নতুন শক্তি সমাবেশ আজ অত্যন্ত জরুরী।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!