গণপরিবহনে শৃংখলা আনতে ১০ দফা সুপারিশ

বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃংখলার সাথে জড়িত বলে দাবী করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গতকাল ২১ এপ্রিল শনিবার সকালে নগরীর জাতীয় প্রেসক্লাবের “সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা উত্তোরণের উপায়” র্শীষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এই দাবী করেন।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে, বাসে-বাসে রেষারেষি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লা-পাল্লির কারনে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে যাত্রীরা। যত্রতত্র বাস থামানো। রাস্তার মাঝ পথে গতি কমিয়ে চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানামা করানো। ট্রাফিক আইন লংঘন। রাস্তার মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো নামানো। যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ংকর প্রতিযোগীতা। অব্যবস্থাপনা ও বিশৃংখলা ঢাকার গণপরিবহনের নিত্যদিনের চিত্র। সম্প্রতিক সময়ে সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন নিহতের ঘটনায় সারাদেশ ঘুমুড়ে কেঁদে উঠলেও প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে ঝড়ছে কমপক্ষে ৬৪ টি তাজা প্রাণ। প্রতিদিন আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ এর বেশি মানুষ। আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃংখলা মারাত্বকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে বলে দাবী করেন বক্তারা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লক্ষ যানবাহন রাস্তায় চলছে যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লক্ষ চালকের মধ্যে বিআরটিএ লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লক্ষ চালকের হাতে। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লংঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে, ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, বা কারো জীবন চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে সারাদেশে জানুয়ারী ২০১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত ১৭৭৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮৪১ জনের প্রাণহানী ৫৪৭৭ জন আহত হয়েছে। এখানে পঙ্গু হয়েছে ২৮৮ জন।

বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সড়কে শৃংখলা প্রতিষ্টার পরিবর্তে তথাকথিত সনাতন পদ্ধতিতে জরিমানা আদায়ে ব্যস্ত। ট্রাফিক পুলিশ পরিবহনে শৃংখলা প্রতিষ্টার পরিবর্তে পরিবহনে চাঁদাবাজী, টোকেনবাজী, জরিমানা আদায় ও অর্থ আতœসাথের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। প্রকৃত মালিক ও শ্রমিক সংগঠন গুলোকে কোনঠাসা করে সরকারের লেজুরভিক্তিক গুটি কতেক সংগঠন এই সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পরিবর্তে চাঁদাবাজী, পারমিট বানিজ্য, কর্তৃত্ব জাহির, ক্ষমতার প্রদর্শনে ব্যস্ত রয়েছে। রাজনৈতিক ঠিকাদারেরা সরকারের কোর্ট গায়ে দিয়ে সরকারের আপন লোক সেজে সড়কে শত শত কোটি টাকার কাজ ভাগিয়ে নিয়ে যেন-তেন ভাবে কাজ করে বিল নিয়ে লাপাত্তা হচ্ছে। অথবা রাস্তা কেটে মাসের পর মাস ফেলে রেখে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়কে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী আজ চরম আকার ধারন করেছে বলে দাবী করে বক্তারা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃংখলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রন করছে। দৈনিক চুক্তি ভিক্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাসটি চালকের হাতে তুলে দিয়েছে। এতেই চালকরা যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এহেন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়লো বা কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই চালকদের।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ১০ টি সুপারিশ তুলে ধরেন, ১। নগরীতে বাসে-বাসে প্রতিযোগিতা বন্ধে কোম্পানি ভিক্তিক একই কালারের বাস সার্ভিস চালু করা। ২। উন্নত বিশ্বের আদলে আমলাতন্ত্রের বাইরে এসে পেশাদারিত্ব সম্পন্ন গণপরিবহন সার্ভিস অথরিটির নামে একটি টিম গঠন করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্বাবধানে নিযুক্ত এই টিম নগর জুড়ে গণপরিবহনের সমস্যা সম্ভাবনা চিহ্নিত করে প্রতিদিনের সমস্যা প্রতিদিন সমাধান করে নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থা একটি শৃংখলায় নিয়ে আসবেন। এবং সড়কের সুষ্টু ব্যবহার নিশ্চিত করবেন। গণপরিবহনের মান, যাত্রী সেবার মান, বাস টার্মিনালের পরিবেশ, যাত্রী ও গণপরিবহন সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করবেন। ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ ও অনান্য সেবাদান প্রতিষ্ঠান সমূহ এই টিমের নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকবে। এই ধরণের একটি টিম জরুরী ভিক্তিতে গঠন করা। ৩। ট্রাফিক বিভাগের কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা। ৪। চালকের হাতে দৈনিক জমা ভিক্তিক বাস ইজারা দেওয়া বন্ধ করা। ৫। বিআরটিএ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা জনবান্ধব করতে হবে। এই আদালত পরিচালনার মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। ৬। ট্রাফিক পুলিশের মামলার জরিমানা সরাসরি ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান নিশ্চিত করতে হবে। ৭। সড়কে চাঁদাবাজী, টোকেন বাণিজ্য, দখলবাজী, হকার ও অনান্যদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ৮। রুট পারমিট ইস্যু প্রক্রিয়ায় ঢাকা মেট্রো আরটিসিতে মালিক শ্রমিক নেতাদের পরিবর্তে পেশাদারিত্ব ও কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন লোকজন নিয়ে পূর্ণগঠন করতে হবে। ৯। ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানী বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। ১০। পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় যাত্রী সাধারণের অভাব অভিযোগ তুলে ধরা ও মত প্রকাশের স্বার্থে যাত্রী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

এই সময় উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়রম্যান কাজী রিয়াজুল হক, ডিটিসিএ’র সাবেক নিবার্হী পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধাণ সমন্নয়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিষ্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া, বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার প্রমূখ। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়রম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মানুষের বেচেঁ থাকার অধিকার, আমাদের সড়কে এই অধিকার অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় পৃষ্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের এখানে প্রকৃত পক্ষে আইনের কোন প্রয়োগ নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে নতুন যে আইন করা হচ্ছে তাতে সবার মতামতের প্রতিফলন হয়নি ফলে এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা কঠিন। তিনি প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইন বিল আকারে পাশ করার আগে সবার মতামত নিয়ে সব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আইনের সন্নিবেশনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানে যাত্রী সাধারণের মতামত ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এই সেক্টরে সিদ্ধান্ত গ্রহনের দাবী জানান।

ডিটিসিএ’র সাবেক নিবার্হী পরিচালক গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমরা ইতিমধ্যে মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে কাজ করে একটি সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা সরকারের কাছে দায়ের করেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে ঢাকা শহরের গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা দুর হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধাণ সমন্নয়ক জোনায়েদ সাকি কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য এই সমস্যা গুলো জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন সেক্টরের সমস্যা গুলো চিহ্নিত সমাধানের উপায়ও বিশেষজ্ঞরা ইতি মধ্যে সরকারের কাছে দিয়েছে। তারপরও সরকার বছরের পর বছর এই সব সমস্যা সমাধান না করে এই সমস্যাকে পুঁজি করে নানা ধরনের পায়দাতন্ত্র হাসিল করতে চাই।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, মাদকের হাত থেকে পরিবহন সেক্টরকে রক্ষা করা না গেলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়তে থাকবে। তিনি অনতিবিলম্বে নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিষ্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া আইন না মানার প্রবণতাকে সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, যারা নিহত হন শুধু তারাই মারা যান না পুরো ঐ পরিবারটি মারা যান। কেননা ঐ পরিবারের পরিচালক যখন মারা যায় তখন পরিবারটি আর অস্থিত্ব থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!