দুষ্টচক্রের নিয়ন্ত্রণে ব্রডব্যান্ড ব্যবসার ৬০ শতাংশ

অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

ঢাকাসহ সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। আইএসপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি বলছে, আগামী দু-তিন বছরে এর গ্রাহকের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবসার এই সম্ভাবনায় থাবা বসিয়েছে প্রভাবশালী দুষ্টচক্র। এরই মধ্যে ঢাকা, গাজীপুরসহ একাধিক বিভাগীয় ও জেলা শহরে এমন এক চক্র গড়ে উঠেছে, যারা লাইসেন্সবিহীন সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ব্যবসার ৬০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে।

এর ফলে সরকার যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি সাধারণ গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছেন। দুষ্টচক্রের বেঁধে দেওয়া দাম ও শর্তেই ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ধারাবাহিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া অনেক আইএসপি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। অবৈধ ব্রডব্যান্ড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নিয়েও একাধিক কমিশন সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো অভিযান দেখা যায়নি।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা শুধু ঢাকায় নয়, ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। সরকারের শুভ উদ্যোগের সুফল যেন সাধারণ মানুষ পায়, তা নিশ্চিত করা হবে। লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

দুটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে অবৈধ ব্যবসা :বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আইএসপি এবং পিএসটিএন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফাইবার অপটিক কেবলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ৫৬ লাখ ৮০ হাজারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালে যা ছিল ৪৪ লাখ ৬১ হাজার। অর্থাৎ গত এক বছরে প্রায় ১২ লাখ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে বিটিআরসির হিসাবেই।

সংশ্নিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে ২৮৮টি বৈধ আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আছে। বিটিআরসি মূলত তাদের দেওয়া গ্রাহক তথ্যই প্রকাশ করে। তবে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও সারাদেশে অনেক- এক হাজারের বেশি এবং এদের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। এই গ্রাহকরা বছরের পর বছর বিটিআরসির তথ্যের বাইরেই থাকছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চারটি বৈধ আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র। এদের মধ্যে মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। এর একটি প্রতিষ্ঠানের নামের শুরু ‘সি’ দিয়ে, শেষ ‘এল’ দিয়ে। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের শুরু ‘কে’ দিয়ে, শেষ ‘এস’ দিয়ে। প্রথম প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ‘আইটি’ এবং দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ‘অনলাইন’ শব্দটি যুক্ত রয়েছে। অবৈধ ব্যবসার ক্ষেত্রে মূলত এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বৈধ লাইসেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ বিষয়টি বিটিআরসিসহ আইএসপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ওপেন সিক্রেট হলেও, দুষ্টচক্রটি অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে সাহস পাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দুটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহক পর্যায়ে সংযোগ না দিয়ে কৌশলে তাদের লাইসেন্স ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জের পাঁচ শতাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে। তারা অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে প্রতি মাসে লাইসেন্স এবং প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার বাবদ নির্দিষ্ট হারে ভাড়া আদায় করছে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, একাধিকবার মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানটি যে নাম বা সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে, সেই নামে বৈধ আইএসপি লাইসেন্স নেই। তবে চ্যালেঞ্জ করলে তারা নিজেদের ওইসব বৈধ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের শাখা অফিস বলে জানিয়েছে।

বর্তমানে ব্রডব্যান্ড সেবায় প্রায় ২৪০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহূত হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবাদানে ব্যবহূত ব্যান্ডউইথের পরিমাণ প্রায় ১৫০ জিবিপিএস। এতে করে বাকি প্রায় ২৮৪টি বৈধ প্রতিষ্ঠান মিলে সেবা দিতে পারছে মাত্র ৯০ জিবিপিএস। এই ৯০ জিবিপিএস সেবার গ্রাহকদের কাছ থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু ১৫০ জিবিপিএস থেকে সরকার রাজস্ববঞ্চিত থাকছে।

গ্রাহকের দুর্ভোগ : দেশের প্রতিষ্ঠিত ও বড় বড় আইএসপি প্রতিষ্ঠান কিছু বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং রাজধানীর অভিজাত গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডি, উত্তরা ও মিরপুরের কিছু এলাকায় গ্রাহক সেবা দিচ্ছে। কিন্তু এই দুষ্টচক্রের চাপে রাজধানীর অন্য কোথাও গ্রাহক পর্যায়ে কার্যত কোনো সেবা দিতে পারছে না।

অন্যদিকে রাজধানী ও রাজধানীর উপকণ্ঠে স্থানীয় মাস্তানদের এলাকা ভাগ করে দিয়ে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের চক্রটি। রাজধানীর বনশ্রী, আদাবর, মোহাম্মদপুর টাউন হল, টোলারবাগ, খিলক্ষেত, বরুয়া, কুড়িল, বাড্ডা, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জের পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট করে প্রায় ৫০০ স্থানীয় অবৈধ আইএসপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এ চক্রের তত্ত্বাবধানে।

পাড়া-মহল্লায় এই চক্রের নির্ধারণ করে দেওয়া একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই সংযোগ নিতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্নিষ্ট এলাকার ব্রডব্যান্ড গ্রাহকরা। যেমন- বনশ্রী এলাকায় তিন এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ সক্ষমতার ক্ষেত্রে মাসে এক হাজার টাকা, খিলক্ষেতের বরুয়া, লেকসিটি ও ডুমনি এলাকায় একই সক্ষমতার জন্য এক হাজার দুইশ’ টাকা, আদাবর এলাকায় ৮০০ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। টঙ্গী পৌরসভা এলাকায় এক এমবিপিএস সক্ষমতার জন্য মাসে এক হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ রাজধানীর শাহবাগ, ধানমণ্ডি, বনানী, উত্তরার মতো যেসব এলাকায় বৈধ আইএসপি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে, সেসব এলাকায় গ্রাহকরা মাসে ৪০০-৬০০ টাকায় তিন এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ সক্ষমতার সেবা পাচ্ছেন।

প্রতিটি এলাকার অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া গ্রাহকরা জানান, তারা অত্যন্ত নিম্নমানের সেবা পাচ্ছেন। গ্রাহকরা জানান, তাদের তিন এমবিপিএস সক্ষমতা সেবা দেওয়ার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এক এমবিপিএস সক্ষমতার সেবাও পাচ্ছেন না। বিশেষ করে আপলোডের ক্ষেত্রে কখনও কখনও গতি একশ’ কেবিপিএসও পাওয়া যায় না। ডাউনলোডের ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ সময় পাঁচশ’ কেবিপিএসের বেশি গতি পাওয়া যায় না। বনশ্রী, বরুয়া, আদাবর, গাজীপুর এলাকার একাধিক গ্রাহক জানান, এই মাস্তানচক্র রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। প্রকাশ্যে অভিযোগ করলে শুধু ইন্টারনেট সংযোগই কেটে দেবে না, এলাকাছাড়াও করবে।

আইএসপিএবির বক্তব্য: ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল ইসলাম হাকিম বলেন, যখন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা জনপ্রিয় হচ্ছে, দ্রুত গ্রাহক বাড়ছে, সে সময় অবৈধ ব্যবসার দাপট বড় হুমকি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে একাধিকবার বিটিআরসির সঙ্গে আইএসপিএবির আলাপ হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে বিটিআরসির কাছে কার্যকর ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছেন। উৎস-সমকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!