ন্যায্য দাবি, অন্যায্য শক্তি প্রয়োগ

দানবীয় হামলার পক্ষেও কিছু মানুষ অবস্থান নিতে পারে, কোটা প্রথা বাতিল নয়- সংস্কারের মত শতভাগ যৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধেও কিছু মানুষ অবস্থান নিতে পারে,তা নতুন করে আরও একবার দেখা গেল স্বাধীন বাংলাদেশে। সরাসরি রাজনৈতিক নেতা- কর্মীরা ‘অন্ধত্ব’ ধারন করেন, তা কারও অজানা নয়। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তারাও যখন ‘অন্ধত্ব’ ধারন করেন, তখন বোঝা যায় একটা সমাজ কতটা পচে গেছে।

কোটা সংস্কার এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর বর্বর আক্রমণ বিষয়ে কিছু কথা।

০১। আপনি হয়ত রাতে টেলিভিশনে খবর দেখেছিলেন যে, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকুরিপ্রার্থীদের উপর পুলিশ আক্রমণ করেছে। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটা সাধারণ ব্যাপারই। তারপর হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আক্রমণের মাত্রা যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল, কতটা নারকীয় ছিল, তার প্রায় কিছুই হয়ত রাতের সংবাদ দেখে বুঝতে পারেননি। সকালে হয়ত কিছুটা বুঝেছেন, যারা একাধিক পত্রিকা পড়েন তারা। একটা পত্রিকা যারা পড়েন, তাদের পক্ষে ভয়াবহতাটা বোঝা একটু নয়, অনেকটাই কঠিন।

পুলিশ লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। শত শত টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছে। শাহবাগ- চারুকলা- টিএসসি- দেয়েল চত্বর, কার্জন হল… পুরো এলাকা টিয়ারসেলের ধোঁয়ায় মেঘের আকার ধারন করেছে। রাবার বুলেট দিয়ে গুলি করা হয়েছে।

সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের অতিনিরীহ আন্দোলনের স্থানটিকে রণাঙ্গন হিসেবে বিবেচনা করেছে। পুলিশকে সেই সাজে সজ্জিত করে পাঠিয়েছে। পুলিশ আক্রমণ করেছে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্ষত- বিক্ষত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে। তাদের উপর আবার জলকামান দিয়ে পানি বর্ষণ করা হয়েছে। একদিকে কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ, সঙ্গে রাবার বুলেট এবং জলকামানের পানি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে দু’একটি ট্যাংক নিয়ে এলেই শাহবাগ- টিএসসি, প্যালেস্টাইন- ইসরায়েল সীমান্তের চেহারা পেতে পারত।

০২। আন্দোলনরত তরুণরা ভয়ঙ্কর পুলিশি তাণ্ডবের প্রতিরোধ করেছে। প্রতিরোধ করেছে কীভাবে? বাংলাদেশের অন্য সব আন্দোলনের মত এক্ষেত্রেও তারা ইটের টুকরো ছুঁড়েছে পুলিশের দিকে। সংখ্যায় যেহেতু তারা অনেক বেশি, ফলে পুলিশের দিকে যে পরিমান ইটের টুকরা নিক্ষেপ করা হয়েছে,তা পুলিশকে বেশ বিপদে ফেলেছে। আহতও নিশ্চয়ই হয়েছেন কিছু সংখ্যক পুলিশ।

সারা রাত ধরে পুলিশ যুদ্ধ মর্যাদা দিয়ে আক্রমণ করেছে, শিক্ষার্থীরী ইট ছুঁড়ে প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়েছে। চারুকলার ভেতরে ঢুকে মঙ্গল শোভাযাত্রার বাঁশ- কাঠ রাস্তায় এনে আগুন দিয়েছে আন্দোলনরতরা। চারুকলার অনেক ফুলের টব ভাংচুর করা হয়েছে। ভিসির বাড়ির গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছে আন্দোলনকারীরা। বাড়ির অনেক আসবাবপত্র, ফুলের টব ভেঙ্গেছে, দু’টি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। ভাঙ্গচুর ও আগুন জ্বালানোর ঘটনার পর, কিছু বিষয় সামনে আনা হয়েছে।

(ক) চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার জিনিসপত্র ভাংচুর করা হলো কেন? এর সঙ্গে তো কোটা সংস্কার আন্দোলনের সম্পর্ক নেই। মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধীরা বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরাই ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলন করছে, তা না হলে মঙ্গল শোভাশাত্রার প্রস্তুতির আয়োজন আক্রান্ত হবে কেন, এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াত- শিবিরই করছে, তারা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন।

(খ) ইট কেন ছোঁড়া হলো, আগুন কেন জ্বালানো হলো?

(গ) ভিসি বাড়িতে ঢুকে কেন ভাংচুর করা হলো?

০৩। এসব প্রশ্ন যারা করছেন, ধারনা করে নিতে হবে যে এরা শিশুর মত সরল বা মহামানব। এক গালে চড় খেলে আরেক গাল পেতে দেয়া মানসিকতার ধারক- বাহক। তারা কোনোদিন এদেশে বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কোনো আন্দোলন দেখেননি, অংশ তো নেন-ইনি।

এই সরল মহামানবদের বিষয়ে কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু বলি, যে কোনো বোধসম্পন্ন মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। অন্যায়ের তীব্রতায় বোধশক্তিহীন মানুষও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেন। বুলেটের প্রতিবাদ তারা বুলেট দিয়ে করেন না, করতে পারেন না। হাতের কাছে যা কিছু পান, তা দিয়েই প্রতিরোধ করেন।এক্ষেত্রে ইটের ভাঙ্গা টুকরো সব কিছুর থেকে এগিয়ে থাকে। বুলেট- জলকামান- কাদানে গ্যাসের সামনে, ইটের টুকরো খুবই তুচ্ছ প্রতিরোধ। তুচ্ছ ইটের টুকরোই আন্দোলনকারীদের হাতিয়ার। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে,অতীতের সব আন্দোলনে যা দেখা গেছে। প্যালেস্টাইন- আফ্রিকা- ল্যাটিন আমেরিকা নিপীড়িত মানুষের হাতিয়ার ইটের টুকরা। ‘ইটের টুকরা ছোঁড়া যাবে না’ বলা যাবে, তার আগে নিশ্চিত করতে হবে পুলিশ দিয়ে বর্বর আক্রমণ করানো যাবে না।

০৪। আন্দোলনকারীরা আক্রান্ত হয়েছে শাহবাগে। পুলিশের লাঠির বাড়ি, কাদানে গ্যাসের যন্ত্রণায় আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরী ছুটে পালিয়েছে। সামনেই চারুকলা। পুলিশের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে তারা চারুকলার তালা দেয়া গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেছে। ইট- কাঠ- বাঁশ সামনে যা পেয়েছে, হাতে তুলে নিয়েছে। ফুলের টবসহ ভাংচুর করেছে। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়েছে। কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজ থেকে বাঁচার একটা উপায় আগুন জ্বালানো। সব আগুন জ্বালানোর অর্থ সহিংসতা নয়।

অর্থ এও নয় যে, আন্দোলনকারীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। আন্দোলন যে ব্যাকরণ মেনে হয় না, তা আমরা আপনারা সবাই জানি। ব্যাকরণ মেনে আন্দোলন হলে সচিবালয়ের দেওয়াল কোনো দিন ভাঙ্গা হতো না, গাড়িতে আগুন দেয়া হতো না। তার মানে কি ভাংচুর বা গাড়িতে আগুন দেয়া সমর্থন করছি? না, সমর্থন করছি না। আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে যা যা ঘটে, তা বলছি।

নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের আওয়াজ যেহেতু সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না, ফলে ভাংচুর বা রাস্তা অবরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা যখন সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে নিয়মাতান্ত্রিক প্রতিবাদ করেছেন, দিনের পর দিন মানববন্ধন করেছেন, তখন সরকার আলোচনার জন্যে প্রতিনিধি পাঠাননি। যখন রাস্তা অবরোধ করেছে, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে দমন করা যায়নি, তখন সরকার আলোচনা করতে চাইছে। এখন যারা বলছেন রাস্তা কেন আটকালো, নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় তারা সরকারকে সজাগ বা সচেতন করার দায়িত্ব পালন করেননি।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভাংচুর বা সহিংসতা বাংলাদেশ বা উপমহাদেশ বা গরীব দেশগুলোতেই শুধু হয় না। ডাবলু টিও সম্মেলনের সময় কঠিন শাসনের হংকং শহরেও শত শত গাড়ি ভাংচুর হয়, জেনেভার মত শান্ত শহরেও এক ঘন্টায় তিন’শ থেকে পাঁচ’শ গাড়ি ভাংচুর করা হয়। ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের সময় ইউরোপিয়ান অ্যাক্টিভিস্টরা কোপেনহেগেন শহর রণক্ষেত্রে পরিণত করে ফেলে। নিউইয়র্কের আন্দোলনকারীরাও রাস্তায় গাড়ি ভাঙ্গে, ভবনে আগুন দেয়।

০৫। প্রয়োজনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি শক্তি প্রয়োগ করে,সারা রাত ধরে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রণক্ষেত্রে পরিণত করা হলো। ভিসিসহ শিক্ষকদের এক্ষেত্রে অনেক কিছু করার ছিল। ছাত্রীরা যাতে আন্দোলন করতে না পারে, সেকারণে হলে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু তারা করেননি। পুলিশ যাতে শিক্ষার্থীদের উপর দানবীয় নিপীড়ন না চালায়, তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি ভিসি বা কোনো শিক্ষককে। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করেছে, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করেছে। ভিসি বা শিক্ষকরা নিরবতা পালন করেছেন। পূর্বে ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করেছে, সেই ভিডিও চিত্র থাকার পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তদন্ত তদন্ত নাটক করেছে।

নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে ভিসির বাড়ি আক্রমণে। আন্দোলন বা ক্ষোভ ব্যাকরণ মেনে চললে, এমন হওয়ার কথা নয়। যেহেতু আন্দোলন বা ক্ষোভ ব্যাকরণ মেনে চলে না, ফলে ভিসির বাড়ি ভাংচুর হয়েছে।

ভিসি বলছেন তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশে বাড়িতে আক্রমণ করে ভাংচুর করা হয়েছে। এই বক্তব্য অতিসরলিকরণ এবং ভিসি বা শিক্ষকসুলভ নয়। ভিসির বাডিতে আক্রমণ করা অন্যায় এবং লজ্জার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে দেয়া বক্তব্য আরও বেশি লজ্জার। ভিসি পদটি যে কতটা মর্যাদার, তা সম্ভবত ভুলে যাওয়া হচ্ছে।

সারা রাত ধরে শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত- নিপীড়িত হলো, আর সকাল বেলা ভিসি হত্যা প্রচেষ্টা মামলার উদ্যোগ নিচ্ছেন। শিক্ষকরা সারা রাত নিরব থেকে, সকাল বেলা ‘দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র’র প্রতিবাদে মানববন্ধন করতে চাইছেন। ভিসি আবার আরেকটু এগিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে, সরকার পতনের আন্দোলন হিসেবে দেখছেন।

সরকার পতন আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে, আওয়ামী লীগে বহু নেতা আছেন। ভিসিও যদি সেই দায়িত্ব পালন না করে, সরকারের বা আওয়ামী লীগের কোনো সমস্যা হবে না। আর যদি সেই দায়িত্ব পালন করতেই হয়, তাহলে ভিসি পদ ছেড়ে দিয়ে সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে যান। তাতে ভিসি পদটি লজ্জা থেকে বাঁচবে। শিক্ষকরাও যদি এমন নীতি অনুসরণ করেন, শিক্ষাঙ্গন কিছুটা রক্ষা পেতে পারে।

এভাবে অসত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বললে, মানববন্ধন করলে মানুষ শুধু হাসবে না, মুখ থেকে আরও কিছু বেরিয়ে আপনার শরীরে লাগতে পারে। নিজের জন্যে না হোক, শিক্ষকতা পেশার জন্যে হলেও বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার।

০৬। ৫৬ শতাংশ কোটা, বিষয়টি শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ড. আকবর আলী খান গবেষণা করে দেখিয়েছেন, কোটার মধ্যে ২৪৭ রকমের প্রকারভেদ। পুরো ব্যাপারটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ জটিল। অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কেরানি নির্ভর। সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন, শুধু ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে আন্দোলন নয়।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকতে পারে, তার বেশি নয়। আরও নয় এই কারণে যে,মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ঠিক নেই। তালিকায় নেই অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, আছে অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা। ৩০ লক্ষ শহীদ বা ২ লাখ নিপীড়িত নারীর আত্মীয়- পরিজনদের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেয়া হয় নি। আন্দোলনকারীদের ভেতরে অধিকাংশই কোনো না কোনো ভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। অল্প কিছু সংখ্যক আছে শিবির বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী।

লক্ষ লক্ষ তরুণ আন্দোলনকারীদের জামায়াত- শিবির বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে পরিচিতি দিয়ে তাদের শক্তি- সামর্থ্য কতটা বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন, একবার হিসেব করে দেখেন। ছাত্রলীগকে কেন এমন গণবিরোধী লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করছেন, তাও হিসেব করে দেখা দরকার।

কোটা সংস্কারের মত এত যৌক্তিক দাবি না মেনে, সরকারের কোনো উপায় নেই। যত দ্রুত এই শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, ততই মঙ্গল।

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!