পদ্মার ভাঙনে মসজিদ, বিদ্যালয় শত শত ঘরবাড়ি নদীতে।

 

 

সৈয়দ মেহেদী হাসান, শরীয়তপুর প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

প্রতি বছরের ন্যায় বর্ষার শুরুতেই এবারও শুরু হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন। গত ১০ দিনে জাজিরা কুন্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়ি, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নড়িয়া উপজেলার ৫টি মসজিদসহ ৩টি ইউনিয়নের শত শত ঘরবাড়ি ও ফসলী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

এদিকে ভাঙনের মুখে রয়েছে একটি মসজিদ, দুইটি বাজার ও একটি লঞ্চঘাট। ভাঙন কবলিত এলাকার পরিবারগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ সব এলাকার লোকজন দিন রাত করে তাদের বসতঘর, আসবাপত্র, গবাদী পশু অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। সেই সাথে ভাঙনের মুখে থাকা গাছপালাও কেটে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছেন, নদী তীর সংরক্ষণ কাজের প্রকল্প প্লানিং কমিশনে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ জুলাই গভীর রাত থেকে জেলার জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে শুরু হয় পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙন। বিরামহীন ভাঙন চলতে থাকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। শত বছরের ইতিহাসে পদ্মার ভয়াবহ এ রূপ কেউ দেখেনি। ভয়াবহ ভাঙনে জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের খেযুরতলা কলমিরচর চোকদার কান্দি, মমিন খালাসি কান্দি, হাজী মকবুল খালাসি কান্দি, রিয়াজ উদ্দিন মাদবর কান্দি ও ইয়াকুব মাদবর কান্দি ও নড়িয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। দীর্ঘ দিনের নদী ভাঙনে দুইটি উপজেলার অন্তত ১ হাজার দু’শ পরিবারের ভিটেবাড়ি, ফসলী জমি, স্থাবর-অস্থাবর সব কিছু গ্রাস করে নেয় পদ্মা।

এ ছাড়াও কুন্ডেরচর ইসমাইল হোসেন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়সহ ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫টি মসজিদ এবং জাজিরার কলমিরচর ও নড়িয়ার ওয়াপদা বাজারের শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হয়। ওই সময়ে জেলা প্রশাসক ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি খাঁস জমিতে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলো। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনৈদিক ব্যাক্তিরা ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ছিলেন।

১০ মাসেও এর কোনও অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছন ক্ষতিগ্রস্থরা। ফলে, নদীতে সব হারানো লোকদের অধিকাংশ গত প্রায় ১০ মাস যাবৎ নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের ফসলী জমি, বালুর মাঠ ও নদীর পাড়ের ১ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া/খাঁজনা দিয়ে পরিবারের লোকদের নিয়ে মানবেতর জীবন পাড় করছেন। ফসলী জমি, ব্যবসা ও বাড়িঘর না থাকায় এক সময়ের অঢেল সম্পদসালীরা এখন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রম বিক্রি বা রিকশাভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

জানা গেছে, এ সকল পরিবারের স্কুল পড়ুয়া শিশু সন্তানরা লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে দৈনন্দিন শ্রম বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাতে পরিবারকে সহযোগিত করছে।

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ন্যায় এবারও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর, নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ও মোক্তারের চরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুরু হয়েছে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙন।

গত ১০ দিনে জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ইউসুফ বেপারী কান্দির গ্রামের কুন্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহ উদ্দিন বেপারী আজিজুল বেপারী, গোলাম মাওলা বেপারী, রুহুল বেপারীর বাড়িসহ অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি, রিয়াজুদ্দিন মাদবর কান্দির ২০/২৫টি বসতবাড়ি, ইয়াকুব বেপারী কান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ পদ্মার তীরবর্তী গ্রামগুলোর প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। কাজিয়ারচর ব্রিজটির চারদিকে মাটি সড়ে গেছে। ব্রিজটি যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মাত্র এক বছর আগে ওই ব্রিজটি নির্মণ করা হয়।

নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বর কাঠি গ্রামের আলী হোসেন ফকির ও শাজাহান মাদবরের বাড়িসহ ২০ থেকে ২৫টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

একই উপজেলার সাহেবের চর গ্রামের শিকারী বাড়ি জামে মসজিদ, জমাদ্দার বাড়ি জামে মসজিদ, একই গ্রামের মালেক মুন্সি, আজিজ মুন্সি, রাজ্জাক শিকারী, নাজমুল আকন, মজিবুর রহমান আকন, বাবুল শিকারী, আজহার শিকারী, চরনড়িয়া গ্রামের সরদার বাড়ি জামে মসজিদ, খান বাড়ী জামে মসজিদ, শেখ কান্দি জামে মসজি, শেহের আলী মাদবর কান্দি জামে মসজিদ ও বশির জমাদ্দার, মোসলেম জমাদ্দার, মোতাহার খান, মঞ্জু খান, নুরু ছৈয়াল, শাজাহান মোল্যা, আবু ছৈয়ারের বাড়ি, শেহের আলী মাদবর কান্দি জামে মসজিদসহ অর্ধ শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলী জমি পাকা সড়ক ও ব্রিজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর কালু বেপারী কান্দি স্কুল এন্ড কলেজ, কলমিরচর কাইয়ুম খার বাজার, নড়িয়া উপজেলার ওয়াপদা বাজার, সাধুর বাজার লঞ্চঘাট দুই উপজেলার শত শত ঘরবাড়ি ও হাজার হাজার একর ফসলী জমি ও মসজিদ মাদ্রাসাসহ রাস্তা ঘাট ও পাকা স্থাপনা।

সরজমিন ও স্থানীয়রা জানায়, প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শত শত ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ভাঙনরোধে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। ওই এলাকার মানুষ সরকারের কাছে ভাঙনরোধে জরুরিভাবে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ চায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ভাঙন কবলিত লোকজন নিজেদের ঘরবাড়ি, আসবাপত্র, গবাদী পশু ও গাছ পালা কেটে সড়ানোর জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে। তার পরেও চোখের সামনেই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বাপ দাদার ভিটে মাটিসহ শত বছরের স্মৃতি। সর্বস্ব হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারের লোকজন হাউ মাউ করে কেঁদে উঠছেন। ভাঙন কবলিত সর্বহারা কিছু পরিবার তাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও অনেক পরিবার অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
ইয়াকুব মাদবর কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় ওই বিদ্যালয়ের ২ শতাধিক শিশু শিক্ষার্থীরা পাশের একটি বাড়ির সামনে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছে। ওই বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীরা জরুরি ভিত্তিতে ঘর নির্মাণের দাবি জানিয়েছে। এ সব লোকদের জন্য সরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত কোনও সাহায্য দেয়া শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থরা।

কাজিয়ারচর ছমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জিএম সালাহ উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর বর্ষা এলেই পদ্মার ভাঙন শুরু হয়। গত বর্ষা মৌসুমে সর্বকালের সেরা পদ্মার ভাঙ্গনে এক হাজারের বেশী পরিবার স্কুল কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা বিলীন হয়ে গেছে। এবাও পদ্মার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে।

নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের সাহেবেরচর গ্রামের মোশারফ শিকারী বলেন, এ বছর পদ্মার ভাঙ্গনে আমাদের এলাকার অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়ী ও ৫টি মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে। ওয়াপদা বাজার ও সাধুর বাজার লঞ্চঘাটসহ অনেক ঘরবাড়ী ভঙ্গনের মুখে রয়েছে। এগুলো যে কোন সময় পদ্মায় বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের কাছে ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী বাধ নির্মান চাই।

জাজিরার কুন্ডেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ সালাহ উদ্দিন বেপারী বলেন, কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ভাঙন শুরু হয়েছে। অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে গত ১০ দিনে শতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়ে ভিটেমাটিসহ সব কিছু হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনও সাহায্য দেয়া সম্ভব হয়নি। সরকারের কাছে এলাকার অসহায় মানুষগুলোর জন্য সাহায্যের দাবি করছি।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্ধ বলেন, ভাঙনরোধে নদী তীর সংরক্ষণ কাজের প্রকল্প প্লানিং কমিশনে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে।

02


  • কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!