বক্স কালভার্ট খোলার পরিকল্পনা ওয়াসার, দুর্ভোগের আশঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজধানীর সব বক্স কালভার্ট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব খালের ওপর ফ্লাইওভার নির্মাণ করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে বলেছেন তিনি। গত ৩১ জুলাই সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তার এমন নির্দেশ পেয়ে চিন্তাভাবনা করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাগুলো। তবে বক্স কালভার্ট উন্মুক্ত করা হলে নানা জটিলতার পাশাপাশি অন্যান্য দুর্ভোগ ও জনসমস্যা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকায় যেসব বক্স কালভার্ট রয়েছে সেগুলোর ওপর দিয়ে বড় বড় রাস্তা, বহুতল ভবন ও বাসাবাড়ি তৈরি হয়েছে। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে হাজার হাজার যানবাহন। বক্স কালভার্টগুলো উন্মুক্ত করে দিলে সড়কে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে জনসাধারণের চলার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাসাবাড়ি আর দোকানপাটও ভাঙা সম্ভব নয়। ভাঙতে গেলে দেখা দেবে নানান জটিলতা।

বিষয়টি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত কিন্তু চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবীব। তিনি বলেন, ‘আসলে বক্স কালভার্ট ঢাকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব খাল একসময় শহরের গৌরব ছিল, সেগুলো দখল করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সেই খাল পুনরুদ্ধারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটি যুগান্তকারী। এখন খালগুলো পুনরায় তৈরি করে যদি সচল প্রবাহ ফিরে আনা যায় তাহলে ঢাকা বাঁচবে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ এসব খালের ওপর আমরা অনেক উন্নয়ন কাজ করেছি। তবে সময় নিয়ে যদি সঠিক কাজটি করা হয় তাহলে সম্ভব। ঢাকায় ভবিষ্যৎ বসবাসের জন্য যা প্রয়োজন সবই করতে হবে।’

তবে ‘অকার্যকর’ এসব বক্স কালভার্ট মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে সচল করা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। এতে কিছু কারিগরি ও নকশাগত পরিবর্তন আনার সুযোগ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় বক্স কালভার্ট খুলে ফেলা যায় কিনা তা ভাবছে ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান  বলেন, আমরা প্রকৌশলগত ভাষায় যদি বলি তাহলে এটা উন্মুক্ত করে দেওেয়া সম্ভব। আমরা তা ভাবছি। কিন্তু এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটা বড়। কারণ এর ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি উঠেছে। বক্স কালভার্ট উন্মুক্ত করে দিলে তো রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে কী করা যায় সেজন্য মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

ডিএসসিসি’র এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর মতে, ‘বক্স কালভার্ট দিয়ে নিয়মিত পানি প্রবাহ হয় না। পলিথিন আর ময়লা-আবর্জনা ভেতরে ঢুকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়াসা সেগুলো ঠিক মতো পরিষ্কার করছে না। এখন পানি প্রবাহের পরিবর্তে উল্টো ভেতরের পানি রাস্তায় চলে আসে। এ অবস্থায় কিছু কারিগরি পরিবর্তন এনে অস্থায়ীভাবে এগুলো সচল করা যেতে পারে।’

বুধবার (২ আগস্ট) দুপুরের বৃষ্টিতে পুরান ঢাকার নিমতলি গেট এলাকায় দেখা গেছে, বক্স কালভার্টের ঢাকনাগুলো দিয়ে ভেতর থেকে ব্যাপক গতিতে বৃষ্টির পানি রাস্তায় চলে এসেছে। স্থানীয় দোকানিরা জানান— শুধু বৃষ্টির সময়ই নয়, বছরের প্রায় সবসময়ই বক্স কালভার্ট দিয়ে এভাবে পানি বের হয়।

রাজধানীর জলাবদ্ধতার পেছনে আরও অনেক কারণ চিহ্নিত করা হলেও নগর পরিকল্পনাবিদরা অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, প্রকল্পটি রাজধানীবাসীর জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। কারণ খালগুলো ভরাট করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করাটা ছিল রীতিমতো বাস্তবতা বিবর্জিত। তাই বক্স কালভার্ট সরিয়ে খালের রূপ ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন তারা।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, সাধারণত বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভের মাটি তার সাধ্যমতো শোষণ করে নেয়। বাকি পানি খাল-বিল ও ড্রেন হয়ে নদীতে চলে যায়। কিন্তু ঢাকায় দুটি পথের সবই অকার্যকর। এ কারণে বৃষ্টি হলে নগরীর জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে।
ওয়াসা

মঙ্গলবার (১ আগস্ট) জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বক্তব্য রাখেন সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বৈঠকে ওয়াসা’র এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকায় পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। জলাধার থাকার কথা ছিল ১২ শতাংশ, কিন্তু আছে মাত্র ২ শতাংশ। বৃষ্টির পানিও মাটির নিচে যেতে পারে না। প্রাকৃতিক উপায়ে পানি নিষ্কাশনের সব পথ বন্ধ। এখন কৃত্রিম ব্যবস্থায় নিষ্কাশন হচ্ছে।

সভায় খালের ওপর করা বক্সকালভার্টগুলো উন্মুক্ত করার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মতামতের বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। তখন তিনি বিষয়টি ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে জানতে চান। ওয়াসা’র এমডি বলেন, ‘বর্তমানে ঢাকায় ১৫ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট আছে। এগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া ভালো। তবে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।’

এ বিষয়ে কী করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা দিতে ওয়াসার এমডিকে নির্দেশ দেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। এরপর সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার আইনগুলোতে পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কিনা তা পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি করে দেন তিনি। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন আক্তারকে।

রাজধানী ঢাকার খালগুলোর মালিক মূলত ঢাকা জেলা প্রশাসন। কিন্তু আশির দশকে খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় ঢাকা ওয়াসা। ২০০১ সালের দিকে অধিকাংশ খাল ভরাট করে তাতে বক্সকালভার্ট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় ওয়াসা। এতে জলাবদ্ধতা কমার চেয়ে উল্টে বেড়ে যায়। প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালের ১৫ জুন একনেকে ঢাকার খালগুলো থেকে বক্স কালভার্ট তুলে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। তখন খালের আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ওই সিদ্ধান্তের কোনও বাস্তবায়ন হয়নি।

সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ১৫ কিলোমিটারের মতো বক্স কালভার্ট রয়েছে। এর ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে রয়েছে— রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রিন রোড হয়ে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজা থেকে সোনারগাঁও হোটেল, পান্থপথ থেকে পরীবাগ, ইব্রাহিমপুর বাজার থেকে মিরপুর বাউনিয়া খাল, সেগুনবাগিচা থেকে আরামবাগ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, খিলগাঁও থেকে তিলপাপাড়া পর্যন্তসহ আরও কয়েকটি স্থানে স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্স কালভার্ট সড়ক রয়েছে। রাসেল স্কয়ার থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত পান্থপথের প্রায় পুরো রাস্তাই পড়েছে বক্স কালভার্টেরওপর।


  • কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!