বিএনপি’র ভিশন ২০৩০ এ যা থাকতে পারে

 

 

অনলাইন ডেস্ক  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

রূপকল্প ২০৩০’-এর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহলকে একটি পরিষ্কার বার্তা দিতে চায় বিএনপি। আগামী ১০ই মে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রূপকল্প উপস্থান করবেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে জাতির সামনে একটি রূপকল্প উপস্থানের ঘোষণা তিনি আগেই দিয়েছিলেন। তবে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের মনোভাব ও আগামী জাতীয় নির্বাচনের চলমান তোড়জোড় বিবেচনা করে সেটির বিষয়পরিধি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরাম। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সহায়ক সরকার গঠনের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা এবং দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক মহলের সামনে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলোর সমন্বয়ে তৈরি করা হয় এ রূপকল্প।

বিএনপির রূপকল্প প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রূপকল্পে প্রধানত তিনটি প্রস্তাবনা থাকবে। প্রস্তাবনাগুলো হলো ১. নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন, ২. স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন ও ৩. দেশের নানা শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট, নিরপেক্ষ ও সজ্জন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন।
নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে ৩টি প্রস্তাবনার দুটি প্রণয়ন করা হয়েছে সংবিধানের বিধি মেনে। অন্য প্রস্তাবনাটিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জনপ্রয়োজনে সংবিধানের বিধি পরিবর্তনের বিষয়টি। এক্ষেত্রে দুটি আহ্বানও জানাতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রথমত, সংবিধানের কিছু বিধি পরিবর্তন।
দ্বিতীয়ত, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রেসিডেন্টকে একটি সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাতে পারেন তিনি। তবে দলীয় সরকারের অধীনে নয়- নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিএনপির অনড় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত হবে প্রতিটি প্রস্তাবেই।

অর্থাৎ সংবিধানের অধীনে থেকেও দলটি নির্বাচনে যেতে রাজি। তবে সেটা কোনোভাবেই বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে নয়। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে বিএনপির সামনে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে যেমন ঝুঁকি থাকবে, তেমনি রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠা পাবে দলটির ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। তাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশে-বিদেশে জনমত তৈরি করতে রূপকল্পের মাধ্যমে প্রস্তাবনা দিচ্ছে বিএনপি। সেই সঙ্গে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে দলের তৃণমূলকে।

প্রকাশ্যে আগামী দিনে দাবি আদায়ে সম্ভাব্য আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা বলা হলেও বাস্তবে নির্বাচনী প্রস্তুতিকেই দেয়া হচ্ছে প্রাধান্য। বিএনপি নেতারা জানান, নির্বাচনকালীন সরকারের কিছু মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা পাল্টে দেয় নির্বাচনী পরিবেশ ও পরিস্থিতি। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কার অধীনে থাকবে বা সে দুই মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো কিভাবে পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা থাকবে রূপকল্পে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার একটি ‘ফ্লেক্সিবল স্পেস’ রাখতে চায় বিএনপি।

বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপির ‘ভিশন ২০৩০’-এর একটি প্রাথমিক ধারণা খালেদা জিয়া গত বছর কাউন্সিলে দিয়েছেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও অঙ্গনে কর্মরত শীর্ষস্থানীয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকেও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে।

সবার সুচিন্তিত অভিমত ও পরামর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধ দেশ ও আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিএনপি ইতিমধ্যেই ‘ভিশন-২০৩০’ শিরোনামে একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনার খসড়া প্রণয়ন করেছে।’ সে বক্তব্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। রূপকল্প প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রূপকল্পে রাষ্ট্রের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র ঠিক রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার সংস্কার ও সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্ব খর্ব করে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার কথাটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।

জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করে প্রান্তিক গোষ্ঠী ও নেতৃস্থানীয় পেশাজীবীদের আইনসভায় আনতে চায় বিএনপি। সেই সঙ্গে রূপকল্পে থাকছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি গণভোট প্রথা চালু, সব কালা-কানুন বাতিল, দলীয়করণমুক্ত দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার। সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকারের সমন্বয় ঘটানো, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করা, দুর্নীতি দমন কমিশন শক্তিশালীকরণ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন করা, বিচারক নিয়োগের জন্য বাছাই বা সুপারিশকৃতদের ব্যক্তিগত তথ্য ও সম্পদবিবরণী জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা ও তদারকি শক্তিশালী করা, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা এবং সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একযোগে কাজ করার প্রত্যয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দের কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনায়।

সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা পূরণে বাংলাদেশের সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষের সম্প্রীতির অবস্থান নিশ্চিতকরণ, সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, যথোপযুক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে গোটা কৃষি খাতকে পুনর্বিন্যাস, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার এবং প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে নেয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বন্দি অবস্থায় অমানবিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো, আটকাবস্থায় মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার জন্য তদন্ত, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করবে বিএনপি।

এছাড়া স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, শিল্প, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন খাতওয়ারি পরিকল্পনার প্রকাশ থাকবে। যার আলোকেই তৈরি হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ইশতেহার। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে উন্নত ও স্থিতিশীল আগামীর স্বপ্ন দেখানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জন করতে চায় বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলে দেয়া দলের চেয়ারপারসনের বক্তব্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়েই ছিল এসব কর্মপরিকল্পনা। বিগত দেড় বছর ধরে এ রূপকল্পটি প্রণয়নে কাজ করছে বিএনপি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বিএনপি সেটি উপস্থাপনে অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের। প্রথমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়ে রূপকল্প উপস্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও সরকারের তরফে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড়ের কারণে সহায়ক সরকারের পাশাপাশি আগামী দিনের পরিকল্পনার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপকল্প উপস্থানের সিদ্ধান্ত হয় দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে।

বিএনপির রূপকল্প প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করবে, তা শুধু দেশের জনগণই নয়, বাংলাদেশের বন্ধু দেশ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত কূটনীতিকরাও জানতে চান। বিএনপি নেতারা প্রায়ই তাদের প্রশ্নের জবাবে একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার করেন। তারা বলেন, ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিএনপি। সমন্বয় ঘটাতে চায় সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকারের। দলটির সেই পরিকল্পনা কোন পথে অর্জিত হবে, রূপকল্প ২০৩০-এ সেটাই নানাভাবে প্রকাশ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!