পারভেজ আক্তার এর ছোট গল্প-স্মৃতির অন্তরালে

 

স্মৃতির অন্তরালে
———————-  পারভেজ আক্তার

 

বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছে রিমি। ঘুমের ঔষধ খাবার পরেও সারারাত ঘুম হয় নি। ভোরে বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারে বসতেই ঘুমে তলিয়ে গেল। মেয়ে মুনিরার বাসায় বেড়াতে এসেছে মামুন। কাপড় মেলতে সকালে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসা মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না। কে এই মহিলা! সে এখানে কেন! দৌড়ে মেয়ের কাছে গিয়ে শুধালো।
বারান্দায় বসে আছে যে মহিলা তুমি তাকে চেন? সে কে? তার পরিচয় কি?
আব্বা, আপনি এমন উত্তেজিত কেন! কি হয়েছে আপনার?
আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার জবাব দাও।
কিছুদিন আগে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে দেখি উনি ময়লা থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছেন। আমার মায়া লাগলো। কাছে গিয়ে কথা বলতেই ইনি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থেকে কেঁদে ফেললেন। কত কথা জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু উনি জবাব দিলেন না। ভাবলাম বাসায় নিয়ে যাই। বাসায় যদি থাকতে পারে তো খুবই ভালো আর যদি না পারে তাহলে রাস্তায় ছেড়ে দিব। যদিও উনার রাতে তেমন ঘুম হয় না তবুও এখন পযর্ন্ত ভালোই আছে। উনাকে নিয়ে আমার বেশ কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি। ভালো একজন সাইক্রিয়টিষ্ট দেখাবো বলে ভাবছি।
উনার নাম কি? বাড়ি কোথায়?
তা তো বলতে পারব না। কেন আব্বা, কি হয়েছে?
তুমি তাকে জিজ্ঞেস কর।
জিজ্ঞেস করে লাভ নেই কারণ সে কথা বলতে পারে না।
আবার দৌড়ে বারান্দায় যায় মামুন। অপলক তাকিয়ে থাকে ঘুমন্ত মুখটার দিকে। রিমি! রিমি গ্রাম থেকে শহরে এলো কিভাবে! রিমি এতো বছর কোথায় ছিল! রিমি কি জানে এই মুনিরাই তার মেয়ে! রিমি কি জানে মুনিরা একজন গাইনোকলোজিষ্ট! ভাবতে ভাবতে মামুনের চোখ দিয়ে পানির মতো নেমে চলে। মুনিরা আর মুনিরার স্বামী অবাক হয়।
আব্বা, আপনি কি তাকে চিনেন?
কি হলো আব্বা, কথা বলছেন না কেন?

চিনির বদলে ভুল করে অনেকেই চা’য়ে লবণ মিশিয়ে ফেলে অথবা কারো সাথে হাসি ঠাট্রার সম্পর্ক থাকলে চিনির বদলে লবণ দেয়। তাই বলে মশা মারার স্প্রে চায়ের সাথে কে মেশায়!
রিমি তাই করেছে। চায়ে মশা মারার স্প্রে মিশিয়েছে। সমস্যা হলো চায়ের সাথে লবন যেমন গলে মিশে যায়, মশা মারার স্প্রে তেমন গলে যায় না বা মিশেও যায় না। বিন্দু বিন্দু তেলের ফোঁটার মতো চায়ের উপর ভাসছে মশা মারার স্প্রে। ভালোভাবে না তাকিয়ে যারা চায়ে চুমুক দিল তারা ওয়াক থু থু করছে আর যারা খায় নি তারা চায়ের কাপটা চোখের সামনে নিয়ে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে। কিন্তু রহস্য বুঝতে পারছে না।
রিমির বাবা জব্বার রিমির মা ময়নাকে ডেকে গরম চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপ দেখিয়ে বলল তেল দিয় চা বানানো কবে শিখলা! আগে তো কোনদিন এমন চা খাওয়াও নাই, ব্যাপারটা কি?
মেহমানের সামনে স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় ময়না। ট্রেসহ কাপগুলি নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে ছুটে। মায়ের জন্য খারাপ লাগে রিমির। সে যা চেয়েছিল তা হয় নি। কিভাবে যে ওই শয়তানগুলিকে শিক্ষা দিবে তাই ভাবছে। চৌদ্দ বছরের রিমি মাত্র ক্লাস নাইনে উঠেছে। ছাত্রী হিসেবে খুব ভালো না হলেও এক্কেবারে খারাপ না। লেখাপড়ার প্রতি কোন আগ্রহ না থাকলেও লেখাপড়া ছেড়ে দেবার কোন ইচ্ছেই নেই। কিন্তু যা ঘটতে যাচ্ছে তাতে আর লেখাপড়া তো দূরের কথা, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই দায় হবে।
বেশ কয়েক বছর ধরে রিমির পিছু নিয়েছে তমিজ। তার বড় ছেলে মামুনের জন্য বউ করে রিমিকে চাইই চাই। সেই কবে থেকে জব্বারকে আড়ালে আবডালে বেয়াই ডেকে চলেছে। মেয়ে এখন সাবলিকা। এখন আর আড়াল আবডাল নয়, প্রকাশ্যে বেয়াই ডাকার বন্দোবস্ত করতে দু-চারজন নিয়ে ঘরে এসেছে। চায়ে তেল-লবণ যা’ই থাকুক না কেন, সম্পর্ক পাকাপোক্ত না করে বাড়ি যাওয়া চলবে না।
রিমি জানে বাবা ওর কথা শুনবে না, শুনবে না মায়ের কথাও। বাবা কারো কথাই শুনবে না। বিয়েটা আরো আগেই হয়ে যেত, হয় নি শুধু নাবালিকা ছিলো বলে। সাবালিকা হবার জন্য নিজেকে বড় অপরাধি ভাবে সে। তমিজের আইবুড়ো ছেলে মামুনকে বেশ কয়েকবার পথে ঘাটে দেখেছে। পছন্দ হওয়া তো দূরের কথা, মামুনকে দেখলে ওর বমি বমি লাগে।
মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলল মা, আমি বিয়ে করব না। তুমি আব্বাকে মানা কর।
আমি মানা করলেও তোর বাপে শুনবে না এই কথা তুই জানিস।
মা, আমি লেখপড়া করবো, এখন থেকে মন দিয়ে লেখাপড়া করবো।
আমি এই কথা বলেছিলাম, তারা না কী তোর বাপেরে বলছে বিয়ার পর লেখাপড়া করাবে। অবশ্য তুই যদি করতে চাস। মামুনই তোরে ইস্কুলে নিয়া আওয়া যাওয়া করবো।
কি কও তুমি! এই বুইড়া বেটা আমার স্কুলে যাবে?
চুপ কর। বেটা মানুষের বয়স বেশি হওয়া ভালো।
কেন মা, বেটাদের বয়স বেশি হওয়া ভালো কেন!
জবাব দিতে ইতস্ততা লাগে ময়নার। মেয়েকে সে কেমন করে বলবে! শ্বাশুড়িকে ইশারা করে বলার জন্য। ময়নার শাশুড়ি জবেদা বেগম রিমির কাছে বসে হাসিমুখে বলেÑ আগে বিয়া হোক তারপর দেখবি বেশি বয়সের বেটা কেমন হয়।
এত ঢং না করে কইতে পারো না?
কম বয়সি বেটারা বিয়ার পর বউয়ের লগে ঝগড়া কাইজা বেশি করে। আর বেশি বয়সি বেটারা বউরে সবসময় আদর করে। তোর দাদাও আমার চেয়ে বিশ-পঁচিশ বছরের বড় ছিলো। কোনদিন আমার গায়ে হাত তুলে নাই।
হাত তোলার সময় পাইলো কই, আব্বা আর ফুফুরে ছোট রাইখাই তো মইরা গেল।
না লো না, উনি বাঁইচা থাকলেও কোনদিন আমার গায়ে হাত উঠাইতো না।
দাদী, তোমার পিরিতের গপ্প বন্ধ কর। আমি অহন বিয়া করুম না।
কারো মতামতের কোন দাম নাই জব্বারের কাছে। মেয়ে বড় হয়েছে, আর সে জানে সেয়ানা মেয়ের বিয়ে না দিয়ে মারা গেলে গুনাহ হয়। হায়াত মরণের কোন সময় অসময় নাই। যেকোন সময় যে কারো মরণ হতে পারে। সময় থাকতে থাকতে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারলেই হয়। তাছাড়া নামকরা বাড়ির লোক তমিজ উদ্দিন, তার ছেলে মামুন বেশ। ওই বাড়িতে রিমির বিয়ে হলে আজীবন সুখে থাকবে।
কেঁদেকেটে কোন লাভ হলো না। বিয়ে হয়ে গেল রিমির। শুরু হলো সংসার জীবন। বয়সে বিস্তর তফাতের লোকটার সাথে কাটতে লাগলো দিনরাত। ভালো লাগা মন্দ লাগা মিলে এক হয়ে গেল। আগের জীবনের সাথে এ জীবনের কোন মিল নেই। তবুও জীবন বয়ে চললো জীবনের নিয়মে। একটু একটু করে শ্বশুরবাড়ি বুঝে নেয়া, মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি আসা যাওয়া জীবনেরই অংশ।
বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই নতুন খবর এলো। মা হবে রিমি। আজ অথবা কাল করে করে বিয়ের পর একদিনও স্কুলে যাওয়া হলো না। বাচ্চা পেটে আসার পর তো আর স্কুলে যাবার প্রশ্নই আসে না। মন মরা হয়ে থাকে সে। কিভাবে যেন সবকিছু বদলে যাচ্ছে। এই জীবন তো সে চায় নি। তবে কেন জীবনে এমন ঘটছে! বয়সে যত বড়ই হোক, মনের গোপন কথা বা কষ্টের কথাগুলো স্বামীর কাছেই বলতে চায়। রাতে কোন এক নিরিবিলি সময়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো বিয়ার আগে আপনারা না কী বলেছিলেন আমাকে লেখাপড়া করাবেন, এখন স্কুলে যেতে দেন না কেন?
কি সব পাগলের মত কথা কও! এই অবস্থায় কেউ স্কুলে যায়? এই অবস্থায় কেউ লেখাপড়া করে? আল্লাহ চায় তো বাচ্চা হবার পরে স্কুলে যাবে।
বাচ্চা হবার পর কেউরে কোনদিন স্কুলে যাইতে দেখেছেন?
কেউ যাক বা না যাক, তুমি যাইবা। আর যাইতে যদি শরম লাগে তাহলে বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করবা। পরীক্ষার সময় গিয়া চুপ কইরা পরীক্ষা দিয়া আইবা।
স্বামীর কথা শুনে আশায় বুক বাঁধে রিমি। শরীরের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। বাচ্চা হবার দিন যত এগিয়ে আসছে ওর মনে হয় মরার দিনও এগিয়ে আসছে। তবুও সে স্বপ্ন দেখে স্কুলে যাবার, লেখাপড়া করার। সে কী সত্যিই লেখাপড়া করতে পারবে? না কী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাবে?
সময় থেমে থাকে না। এক এক করে কেটে যায় দিন। কন্যা সন্তানের মা হয় সে। শুরু হয় আরেক জীবন। পনেরো বছর বয়সেই ওর উপরে অনেক দায়িত্ব। মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়ানো, মেয়ের পায়খানা-প্র¯্রাব পরিষ্কার করা, সংসারের প্রতি খেয়াল রাখা, স্বামী-সন্তানসহ ঘরের অন্য লোকদের প্রতি খেয়াল রাখাও ওর নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সংসার সামলাতে গিয়ে আর পড়ালেখা হয় না। মনে মনে ভাবে, মেয়েটা একটু বড় হলে সে ঘরে বসেই পড়বে আর পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে।
ভাগ্য যার প্রতিকূলে সে কেমন করে মনের আশা পূরণ করবে! বছর দুই কাটতে না কাটতেই আবার সন্তান সম্ভবা হয় রিমি। কোল জুড়ে আসে পুত্র সন্তান। দুবার দুই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার পর নিজের ইচ্ছেগুলোকে বুকের ভিতর দাফন করে। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে লেখাপড়া করা তো দূরের কথা, নিদ্রা নাওয়া খাওয়াও ভুলে যেতে বসেছে। শরীর শুকিয়ে হাড় বেরিয়ে আসছে। কুড়ি বছর বয়স হয় নি অথচ দেখলে মনে হয় দু’কুড়ি পাড় হয়ে গেছে। নিজেকে নিয়ে আর নয়, এখন সে স্বপ্ন দেখে সন্তানদের নিয়ে।
ছেলেটা এখনো কথা বলা শেখেনি তবে মেয়ে বেশ কথা বলে। কোন কথা স্পষ্ট আর কোন কথা অস্পষ্ট, মেয়ে যা বলে শুনতে খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে যখন আহ্লাদি গলায় মা ডেকে গলা জড়িয়ে ধরে তখন অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। তাছাড়া মজার মজার কত কা- কীর্তি যে সারাদিন করে তার হিসেব নেই। মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে এটাই রিমির ইচ্ছে। ইচ্ছে যেন পূরণ হয় স্বামীর কাছে আব্দার করে।
বছর দুই যেতে না যেতেই আবারও সন্তানের বাবা হতে চায় মামুন। কিন্তু রিমি আর সন্তান চায় না। সে দুই সন্তানকে নিয়েই সুখে থাকতে চায়। মামুনের সাথে তার পরিবারের লোকজনও সুর মিলায়। দিন যেতে থাকে রিমির জীবনে ঝামেলাও বাড়তে থাকে। সবার মন যুগিয়ে চলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে সে। সংসার জীবন এত কষ্টের আর কষ্টটাকে কেউ বুঝতে চায় না বলে ওর রাগ হয়। কখনো স্বামীর প্রতি, কখনো সন্তানের প্রতি আর কখনো নিজের প্রতি। ওর রাগ-অনুরাগ দিয়ে মামুনের কিছু আসে যায় না। সে আরও সন্তান চায়। শুরু হয় আরো ঝামেলা। ঝামেলা ঝামেলায় অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে যায় রিমি।
রিমি চলে যাবার পর মামুনের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এক এক করে জীবনের সব ভুল বুঝতে পারলেও স্ত্রীকে আর খুঁজে পায় না। বাচ্চা দুটি এখনো ছোট। এই অবস্থায় কি করবে ভেবে পায় না। কেউ বলে আবার বিয়ে করতে, কেউ বলে বিয়ে না করতে। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় সে বাচ্চা দুটিকে মানুষ করবে, ঠিক রিমি যেভাবে আশা করতো।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!