দেবীগঞ্জের মেয়ে কাকলীর রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড অর্জন

নাজমুস সাকিব মুন, পঞ্চগড় প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড অর্জন সহজ নয়। অনেক কাঠ বা খড়ি পুরে তা অর্জন করতে হয়। লক্ষ লক্ষ সদস্যদের মধ্য থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা সেটি পাওয়ার চেষ্টা করে উপজেলা লেভেলেই। সোনার সেই হরিণ কয়জনই বা অর্জন করতে পারে? প্রতি বছর বাংলাদেশ স্কাউটস ৩টি রেঞ্জে এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে থাকে। প্রাথমিক লেভেলে বলা হয় ‘শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড’ মাধ্যমিকে ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ (পিএস) এবং কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ‘প্রেসিডেন্ট রোভার স্কাউট এ্যাওয়ার্ড’ (পিআরএস)।

কাব স্কাউট, স্কাউট, রোভার স্কাউট- এ তিনটি স্কাউটিংয়ের পর্যায়। তিনি স্কাউটিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে বিদ্যুৎ ক্যাম্প,আঞ্চলিক সমাবেশসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেছেন।

পেয়েছেন স্কাউটদের জন্য বাংলাদেশ স্কাউট এর সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রেসিডেন্ট’স স্কাউট অ্যাওয়ার্ড। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্কাউট প্রোগ্রাম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও সম্পন্ন করার সম্মাননা স্বরূপ পান এই স্বীকৃতি। গত ২০ জানুয়ারি সোমবার জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মৌচাক, গাজীপুরে ৯ম জাতীয় কাব ক্যাম্পুরী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও চীফ স্কাউট মো. আবদুল হামিদ তার হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম, তিনি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ পৌর শহরের কলেজপাড়ার স্কাউট নিশাত আনান কাকলি। তিনি শহরের পারফেক্ট একাডেমী থেকে প্রাথমিক এবং দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন।এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্কাউট দলের হয়ে সে রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।

স্কাউটিংয়ে সম্পৃক্ততা ও অর্জন সম্পর্কে নিশাত আনান কাকলী বলেন, ‘ আমার বয়স যখন ৩ মাস আমার বাবা তখন আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। ছোট থেকেই আমি আমার মায়ের স্নেহ ভালোবাসায় বড় হয়েছি। আমার বাবা যে নেই একথা মাঝে আমাকে কখনও বুঝতে দেয়নি। মা সব সময় ছাতার মতো আমাকে আগলে রেখেছেন। একটি মাত্র সন্তান হওয়ায় আমি যখন যা কিছু করতে চেয়েছি বা যা কিছু চেয়েছি মাঝে আমার সে দাবি অপূর্ণ রাখেনি।

এরপরে আমি স্কুলে লেখাপড়া করতে করতে দেখি অন্যান্য ছাত্র/ছাত্রীরা স্কাউট, খেলাধুলা সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের দেখে আমারও আশা জাগে আমিও যদি নেতৃত্ব দিতে পারতাম তাহলে নিজকে খুব ভালো লাগত। একথা আমি প্রথমে আমি আমার মাকে জানাই। মা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে আমার আগ্রহ ও ইচ্ছা শক্তি দেখে আমাকে আর বাঁধা দেয়নি। এরপর আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখা পড়া শুরু করি তখন স্কাউট লিডার ফজলুল হক স্যারের সাথে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমার আগ্রহ দেখে আমাকে স্কাউটের বিভিন্ন দীক্ষা দিয়ে আমাকে সহায়তা করতে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে আমি স্কাউট সম্পর্কে নানান রকম জ্ঞান অর্জন ও চর্চা শুরু করি। তখন থেকে স্কাউট বিষয়ে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্কাউট থেকে একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। এসব দেখে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকও আমাকে বিভিন্ন পর্যায়ে স্কাউটে অংশগ্রহণ করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এরপর আমি জাতীয় পর্যায়ে স্কাউটে অংশ গ্রহণ করি। সেখান থেকে আমি আমার জীবনের সেরা সাফল্য অর্জন করি। এটা এমন এক সাফল্য যার কথা না বললেই নয় সেটা হলো প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। যেটা আমি গত ২০ জানুয়ারি সোমবার গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মহোদয়ের নিকট হতে গ্রহণ করি।

একজন মেয়ে হয়ে এমন সাফল্য অর্জন করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি আর সেই সাথে আমি আমার মা সহ যারা আমার এই সাফল্যের পেছনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি”।

কাকলির মা বলেন, “ কাকলির বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি তাকে অনেক আদর স্নেহে মানুষ করেছি। কখনও বাবার অভাব বুঝতে দেইনি। ছোট থেকেই ও যা কিছু করতে চেয়েছে আমি তা করতে দিয়েছি। আর স্কাউট বিষয়ে প্রথমে আমার মত না থাকলেও ও আগ্রহ আর ইচ্ছা শক্তি দেখে আমি তাকে বাঁধা দেইনি। আমি তাকে সবসময় সাবধানে ও অন্যান্য স্কাউট সদস্য সহ শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে চলতে উৎসাহিত করেছি। যাইহোক আমার মেয়ের এমন সাফল্যে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। আর আমার মেয়ের এ সফলতার সাথে যারা জড়িত তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি”।

কাকলির স্কাউট লিডার ফজলুল হক জানান, আমরা সবাইকে উৎসাহিত করি এই প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য। আমরা দেবীগঞ্জ অলদিনী থেকে ১৩ জনকে মোটামুটি ভাবে উৎসাহিত করে ফরম পুরন করাতে সক্ষম হই। পর্বরতীতে এদের মধ্যে সবাই পিছু পা হলেও দুজন টিকে থাকে তার মধ্যে কাকলি একজন। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পর্যায় ক্রমে জেলা পর্যায়, অঞ্চল পর্যায় এবং জাতীয় পর্যায়ে লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের মাধ্যমে কাকলি প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। আর এটাতে আমি একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্যে দিয়ে ছিলাম, আসলে মানুষের ইচ্ছা শক্তি কাছে কোনো কিছু বড় না, মানুষ ইচ্ছে করলে সব কিছুই করতে পারে। আসলে আমারও একসময় আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাবো কিন্তু আমি অর্জন করতে পারি নি, আজ কাকলি এই অ্যাওয়ার্ড অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমি পরিপূর্ণতা ফিরে পেয়েছি। আমি খুবই আনন্দিত।

দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার সিংহ বলেন, আমার স্কুলের মেয়ের এমন সাফল্যে আমি খুবেই আনন্দিত। তার এই সাফল্যের পিছনে আমি বা আমার স্কুল ক্রেডিট নিতে চাই না সে মেধা ও পরিশ্রমের কারণে এই অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, আমরা স্কুল থেকে সার্বিকভাবে কিছু সহযোগিতা করছি মাত্র।

কাকলির স্কাউট শিক্ষক আশরাফুজ্জামান বলেন, নিজেকে আজ বিজয়ী মনে হচ্ছে। আমার চেষ্টা এবং আমি চেষ্টা করছি আমার দেবীগঞ্জকে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার এবং শাপলা অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার জন্য। এমনও সময় গেছে আমি আশেপাশের উপজেলার স্কাউট প্রশিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়েছি। কাকলির স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষক সার্বিকভাবে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। অনেকে আমার সাথে আমার চ্যালেঞ্জ করেছে যে দেবীগঞ্জে একটা স্কাউট টেনিং সেন্টার আছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার মতো কেউ নাই। কিন্তু আজ আমি বিজয়ী আমি থাকাকালীন দেবীগঞ্জ উপজেলা থেকে চার জন প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করতে পেরেছে।

প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্টানে দেবীগঞ্জের নিশাত আনান কাকলী ছাড়াও স্কাউটে অসামান্য অবদানের জন্য সারাদেশের ৪৭ শিক্ষার্থীকে ‘রাষ্ট্রপতির স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ এবংস্কাউট চিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে ‘রাষ্ট্রপতি রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেন রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!