সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প- এক নীরা খালা মনির গল্প

 

 

এক নীরা খালা মনির গল্প

——————-  সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

সুমনের সাথে ইমু প্রায় চলে আসত সুমনের বাসায় । আসলেই নীরা খালা খুব আদর করত ইমুকে। কেমন জানি একটা মায়ার আঁচল পেয়ে গেল ইমু। ইমু যে কোন সমস্যা মানেই নীরা খালা মনি । বিশেষ করে ভাল কিছু রান্না হলে নীরা খালা মনি ইমুকে ডাকবে । সুমনের বিশ্ববিদ্যালের প্রায় সকল বন্ধু তখন নীরা খালা মনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই ইমুর জন্য খালা মনি হয়ে যায় সুমনের ফুফু । নীরা কে আর কেউ অ্যান্টি বা ফুফু ডাকে না। সবার কাছে নীরা খালা মনি । সুমনের বোনের দিলার বিয়ে হয়ে যায় আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে । এ দিকে ইমুর বিশ্ববিদ্যালয় শেষ। সবাই যে যার কাজে এক সময় ব্যস্ত হয়ে যায়। সময় গড়িয়ে অনেক দূর। সুমন রাজন তাদের বোনের জন্য এখন আমেরিকায় ।

সুমনের বাবা মারা যাওয়ার পর সুমন তাঁর মা কেও নিয়ে যায় আমেরিকায় । সুমনের ঢাকার বাড়িটায় নীরা খালা মনি একাই থেকে যায় । যদিও এই বাড়ির সাত কাটা বাড়ির তিন কাটার মালিক নীরা খালা।

ইমু কোন কাজে ঢাকা আসলেই নীরা খালাকে এক নজর দেখে যায়। মোবাইল হওয়াতে মাঝে মধ্যে নীরা খালার সাথে কথা হয় । নীরা খালা মনির ভাইয়ের ছেলেরা আমেরিকায় তেমন ভাল কিছু করতে পারে নাই । নাম মাত্র সুমনেরা ফুফুর খবর রাখে। একটা দু তলা বাড়ি তিনটা রুম ভাড়া যা পায় তা দিয়ে নীরা খালা মনি চলে। সত্যি কারের একজন ভাল মানুষ । জীবনে নিজের করে কিছু চায় নাই। সব ভাল বাসা তাঁর ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের পিছনে ব্যয় করেছে। বাবার বাড়িটা দেখে শুনে রাখে। এর মধ্যে এক দুই বার সুমন রাজন আর দিলা বাংলাদেশে এসে গেছে । সুমন বলে ফুফু তোমাকে তো নিতে চাই আমেরিকা কিন্তু সে খানে তোমার ভাল লাগবে না। তাছাড়া এই বাড়ির এখন অনেক দাম তুমি ছাড়া এই বাড়ি কে দেখে রাখবে। নীরা মনে মনে খুব খুশি হয়। যাই হোক বাবার বাড়িতে যেন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারে। হঠাৎ করে একদিন সুমন আর রাজন বাংলাদেশে আসে। বাড়ির মধ্যে কিছু নতুন লোক জন আসতে থাকে। নীরা খালা মনি জানতে পারলো এই বাড়ি তারা বিক্রি করে দিবে। নীরা খালা মনি তখন মনে করে হয়ত সাথে করে তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ চাইলেই কি কাউকে নিতে পারে। নীরা খালা কে সুমন রাতে বলে ফুফু তোমাকে নিতে সময় লাগবে। আমরা এখানে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে দিব আর কাগজ পত্র হতে যত দিন লাগে। মাসে মাসে তোমার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিব। আর যে দিন কাল পরেছে কে কখন বাড়ি দখল করে নেয় তাঁর ঠিক আছে কি?

নীরা খালা খব চিন্তায় পড়ে যায়। এবার বলে ভাইয়ের সন্তান তাঁর তো নিজের সন্তানের মতই। আমি এই বাড়ি দিয়ে কি আর করব। রাতে ইমু কে ফোন করে নীরা খালা – ইমু বলে খালা মনি তুমি আসলে বোকা। নিজের জন্য কি তুমি কিছু কোন দিন ভাববে না। দেখ সুমন তাঁর মাকে আমেরিকা নিয়ে গেল সাত বছর। এই সাত বছরে কি তোমার কাগজ হত না। আজ পর্যন্ত তোমার পাসপোর্ট করিয়েছে। করে নাই। নীরা খালা ভাবনায় পরে যায়। ইমু তো ঠিকই বলেছে। কিন্তু আমার তো ভাইয়ের ছেলে মেয়ে ছাড়া আর আপন কেউ নাই। আমার আপন ভাইয়ের ছেলে মেয়ে। তাদের আমি আপন সন্তানের মত মানুষ করেছি। তারা কি আমকে বিপদে ফেলে যাবে। অনেক চিন্তা শেষ করলো রাতে।

সকালে অনেক লোক জন এলো জমি মাপতে। সিঁড়িতে বসে দেখছে লোক জনকে। আসতে আসতে নিচে নেমে এলো নীরা খালা। সুমন কে বলল – এরা কি করে?
— ফুফু জমি মাপছে।
— কেন?
— তোমাকে না বললাম।
— অহ। আমার অংশ বাদে মাপতে বল।
— ফুফু কি বল তুমি? এরা একটা ডেভেলাপার কোম্পানি?
— যাই হউক।
— আমার অংশ বিক্রি করব না। এটাই আমার শেষ কথা। রাজন বলল – ফুফু তুমি বুঝতে পারছ না।
— থাক আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।
— কেন বলবে না? ভাল দাম দিবে। তাছাড়া তোমার ছেলে মেয়ে নাই। আমরা ছাড়া কি তোমার দেখার কেউ আছে?
— অনেক দেখেছ আর দেখতে হবে না।
অনেক কথা কাঁটা কাটি হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যে। ডেভেলাপার পুরা অংশ ছাড়া নিবে না। সুমন তাঁর মামা কে বিষয় টা বলল। বিকালে মামা এসে নীরা খালাকে বুঝিয়ে বলল – যে সুমন রাজনের আমেরিকায় অনেক টাকা লাগবে। না হয় ওদের সমস্যা হবে। তাছাড়া তারা একটু ভাল কিছু করে তো আপনাকে নিয়ে যাবে। নীরা খালা বলল – আমি আমার অংশ বিক্রি করব না। এটাই আমার শেষ কথা।

রাতে সুমনের মা ফোন করে বলল – দেখ নীরা তারা তোমার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে। সারা জীবন তোমার ভাই তোমাকে পেলেছে। তুমি তো বুঝতে চাও না। তাছাড়া আমরা কি তোমার খারাপ চাই। তুমি মারা গেলে তো এ সম্পদ তোমার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে পাবে। তুমি বেঁচে থাকতেই দিয়ে দাও। তাতে তোমার সম্মান আমার ছেলেদের কাছে অনেক বেশি হবে। শেষ পর্যন্ত নীরা খালা মনি ভাইয়ের ছেলেদের বিশ্বাস করে বাড়ি বিক্রিয় করে দেয়। ইমু বন্ধুর কাছে
খুব ছোট হয়ে যায়। আর খালা মনি ইমুর কথা রাখে না। এর পর অনেক দিন আর ইমু নীরা খালাকে ফোন করে না। এর ঠিক বছর তিন পরে ইমু তাঁর একটা বিশেষ কাজে ঢাকা আসে। আর একবার চিন্তা করে নীরা খালা কে দেখে যাই। নীরা খালা দেখতে তাঁর নীরা খালার মহল্লায় যায়।

নীরা খালাদের চিনে এমন একজনের সাথে দেখা হলে ভদ্রলোক খুব দুঃখ করে বলে – ইস নীরা এই ছিল কি তাঁর কপালে? কেউ তাঁর খোজ নেয় না। তাঁর ভাইয়ের ছেলেরা মাস ছয়েক কিছু টাকা পাঠাত। হঠাৎ তাদের টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাসাভাড়া দিতে পারছিল না। কিছু দিন বাচ্চাদের আরবি পড়াত। তাঁর পর এক বাসায় একটা বাচ্চা দেখার কাজ নেয় । ঐ বাসায় বছর দুয়েক ছিল। কিন্তু যে মহিলার বাচ্চা দেখত তাঁর চাকুরি চলে গেলে। আমাদের বাসায় কয়েক মাস কাজ কাম করেছিল। কিন্তু এর মধ্য তাঁর একটা অসুক দেখা দেয়। চিকিৎসা করার মত তেমন টাকা ছিল না। আমেরিকায় ফোন করে কাউকে পাওয়া যায় নাই। ঢাকা মেডিক্যালে মাস খানেক ছিল। মহল্লার সবাই চাঁদা তুলে নীরাকে চিকিৎসা করা হয়। এখন নীরাকে ঢাকা মেডিক্যালে গেলে পাইলে পাইতেও পারেন। ঐ রোগীদের কাম কাজ করে কিছু যদি পায় তাতেই চলে। মাঝে মধ্য আমগো মহল্লায় আসে। আর এখন তো বয়স হয়েছে তেমন কাজ কামও করতে পারে না।

ইমু নীরা খালাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে কি সুন্দর একটা ১০ তলা আধুনিক বাড়ি। ইমু অবাক চোখে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। আর নীরা খালা মনির মায়া আদর আর ভালবাসার সেই ছবি চোখে ভেসে উঠে।

ইমুর স্ত্রীকে ফোন করে ইমু – নীরা খালার দুঃখের কথা স্ত্রীকে শুনায়। ইমুর স্ত্রী বলে – শুন ইমু রিজিকের মালিক আল্লাহ্‌। তা ছাড়া তুমি এক সময় নীরা খালার অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছ। উনার বাকি জীবনটা আমাদের সাথে থাকুক। ইমু ঢাকা মেডিক্যালে যায় খুঁজতে। এক সময় নীরা খালাকে পেয়ে যায় । ইমু পিছিন থেকে ডাক দেয় নীরা খালা মনি। মুখ ফিরিয়ে দেখে ইমু। নীরা খালা আচল দিয়ে মুখ ডেকে কাঁদতে থাকে। ইমু কাছে যায়। নীরা খালা বুকে জড়িয়ে বলে বাবা ইমু তুমিই সত্যি বলেছিলে কিন্তু আমি ভালবাসা আর মায়ার মমতায় তাদের বিশ্বাস করে আজ রাস্তার ভিখারি। ইমু বলে না খালা মনি আপনি অনেক মহত। আপনার বিশ্বাস ঠিক ছিল বরং তারাই বিশ্বাসের ঘর চুরি করেছে। তাই আল্লাহ্‌ আমাকে আপানার সেবা করতে পাঠিয়েছে।

নীরা খালা মনি কে নিয়ে ইমু চলে আসে তাঁর নিজ বাড়িতে। পরম মমতায় ঠাই দেয় নীরা খালাকে। কিন্তু আমাদের সামাজে কত জন নীরা খালা মনি ইমুদের পায় বলুন। বেশির ভাগ নীরা খালা মনিরা হয়ত এর চেয়েও বেশি কষ্টে আছে কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!