কমিশনের নির্দেশনা পেলেই ইছামতি ও বড়াল নদীর দখলদার উচ্ছেদ শুরু হবে

সৈয়দ আকতারুজ্জামান রুমী, পাবনা প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

পাবনার ইছামতি ও বড়াল নদী দখল করে অবৈধভাবে নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ভূমিদস্যু ও দখলদারেরা নদীর জমি গ্রাস করে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন, কল-কারখানা, মার্কেট সহ নানা স্থাপনা। স্থানীয় পর্যায়ে থেমে নেই নদী কে দখল ও দূষণ মুক্তির আন্দোলন। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসক বলছেন, আগের তালিকার সঙ্গে নতুন কিছু দখলদার বেড়েছে। নদীর সীমানা নির্ধারণ ও সমীক্ষার কাজ চলছে। সমীক্ষা শেষে তারা কমিশনের নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তায় যৌথ ভাবে অভিযান চালিয়ে ইছামতি ও বড়াল নদীর দখলদার উচ্ছেদ করা হবে।
পাবনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি নদী আর চাটমোহর উপজেলা দিয়ে বয়ে চলা বড়াল নদী। নদী দুটিতে অপরিকল্পিত সুইচ গেট ও বাধ দেওয়ার ফলে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াতে দখল দুষণের কবলে পৌর এলাকার আর্বজনার ভাগারে পরিণত হয়। পাবনা সদর,সাথিঁয়া ও ভাঙ্গুড়া উপজেলার সীমানায় ৮৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ইছামতি নদী।এ ছাড়া বড়াল নদীর সীমানা জেলার জোনাইল থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত। যার দৈর্ঘ্যতা প্রায় ১০০ কিলোমিটার হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড মরা আর লোয়ার এ দুটি শ্রেণীতে নদীটিকে বিভক্ত করার ফলে পাবনার অংশে বড়াল নদী ৬৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দাবি করে। যদিও রাজশাহীর চারঘাট থেকে পাবনা পর্যন্ত বড়াল নদীটির দৈর্ঘ্যতা ২২০ কিলোমিটার।

২০০৩ সালে ইছামতি নদীর যে অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা গুলোর জরিপে ২৮৫ জনের তালিকা করা হয়। সেই তালিকার সাথে বর্তমানে নতুন কিছু দখলদার বেড়েছে। পাশাপাশি বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির জরিপে চাটমোহরের সোন্দভা থেকে বড়াই গ্রাম এই ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত রয়েছে শতাধিক দখলদার। এক সময় যেখানে ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ ছিলো, সেখানে সুইচ গেট দেওয়ার কারণে ৫ হাজার কিউসেক পানি আসতে শুরু করে। মূলত তখন থেকেই বড়ালের মৃত্যু শুরু হয়। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় দখল দুষণ ও বাড়তে থাকে। নদীও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

সীমানা জটিলতার কারণেই অবাধে নদী তীর দখল হয়েছে যদিও পানি উন্নয়ন বোড বলে মনে করে। তবে নদী রক্ষা আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে,নদীতে সুইচ গেট বসিয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াতেই নদী মরা খালে পরিণত হয়। এবং নদীর দখল ও দূষণ বেড়ে যায়।

পাবনার বড়াল ও ইছামতি নদী দুটিকে রক্ষার জন্য নদী রক্ষা কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন বর্তমানে যথেষ্ট উদ্যোগি। ইতোমধ্যে, নদী রক্ষা কমিশন সারাদেশে নদীর কথা বিবেচনা করে পাবনার অবস্থা জানতে চাইলে তা জেলা সে তথ্য প্রশাসন পাঠিয়েছে এবং ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি চলমান রয়েছে। পাশাপাশি পাবনা বাসীর প্রাণের দাবি ইছামতি নদী রক্ষা। ইছামতি নদীতে ২০০৩ সালে যে অবৈধ স্থাপনা গুলোর জরিপে ২৮৫ জন দখলদার এর তালিকা থাকলেও বর্তমানে ফের দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে। চাটমোহরে বড়াল নদী পাড় দখল করে অবৈধ জায়গায় মার্কেট গড়ে তুলা হলেও উচ্ছেদ হচ্ছে কেবল দুর্বল মানুষের স্থাপনা। কচুরি পানা আর নানা ধরণের শিল্পবর্জ্য এবং পৌর এলাকার আর্বজনার ভাগারে নদী দুষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে নদীর বুকে ব্রীজ তৈরি ক্ষেত্রে প্রশস্ত ও উচু করে তা নির্মাণ করা ছাড়াও নদীর বুকের সমস্ত সুইচ গেট অপসারণ করার জোড় দাবি উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এই পরিস্থিতির মুখে যদি নদী সচল করে দেওয়া হয় তাহলে এই নদীর পানির দ্বারা আমরা অনেক উপকৃত হবো। জেলে পরিবার বলছে, নদীতে পানি নেই মাছ নেই, এ অবস্থায় তাদের জীবন ধারণ অসম্ভব কষ্টের হয়ে পড়েছে।

বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলনের সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, যেখানে ২১ হাজার কিউসেক পানি আসতো সেবখানে সুইচগেট দেওয়ার ফলে ৫ হাজার কিউসেক পানি আসতে শুরু করে, তখন থেকেই বড়াল নদীর মৃত্যু শুরু। এরপর যথন নদীতে পানি প্রবাহ কমে গেলো তখন থেকে আস্তে আস্তে মানুষের দখল দুষণ বেড়ে যেতে থাকলো।

বড়াল রক্ষা আন্দোলনের আহবায়ক, ডা:অঞ্জন ভর্ট্রাচার্য্য বলেন,আমাদের দাবি নদীর বুকে প্রতিটি ব্রীজ যেন প্রশস্ত এবং উচু করে তৈরি করা হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা নদী গুলোর দখল এবং দুষণ। এটা মুক্ত করতে না পারলে এবং ড্রেজিং করতে না পারলে আমাদের সকল আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সরকার যদিও পদক্ষেপ কিন্তু আমলা তান্ত্রিক জটিলতার কারণে কাজের ক্ষেত্রে ধীরগতি তে তা হচ্ছে। পাশাপাশি অধিক গুরুত্বের সাথে সুইচগেট গুলো সম্পূর্ণরুপে অপসারণ করতে হবে। সকল নদীকে ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনতে হবে।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড এর উপ পরিচালক, মোশারফ হোসেন জানান, পাবনায় আমাদের দুইটা নদী, বড়াল ও ইছামতি। বড়ালের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি প্রায় শেষের পথে। আই ডাব্লুউ এস স্ট্যাডি টি করছে। আর ইছামতি নদীর ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি নিয়ে কাজ করছে বুয়েট একটা উংই। যা পরিচিত আই ডাব্লুউ এফ এম বলে। বর্তমানে তাদের কাজ চলমান।

চাটমোহরে অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক শাজাহান আলী জানালেন, তিনি দীর্ঘদিন বড়াল রক্ষা কমিটির সাথে জড়িত। তাদের শৈশবের বড়াল নদী আজ ডাষ্টবিনের মত পড়ে। পৌরসভা অবর্জনার ভাগার । সরকারি ভাবে পদক্ষেপ নিয়ে যদি নদীটা সচল করে দেয়; তাহলে এই নদীর পানির দ্বারা আমরা অনেকে উপকৃত হবো। কৃষি জমি আবাদের জন্য এবং আমাদের জীবন ধারণের জন্য। ইতোমধ্যে, পানির উচু স্তর নিচুতে নেমে গেছে। চাপকলে চাপ দিলে আর পানি পড়ে না। যদি না সাবমার্সেল থাকে। বর্তমানে বড়ালে কচুরি পানা অবমুক্ত করাও জরুরি। নইলে মশা মাছির উপদ্রব মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

চাটমোহরের বড়াল পাড়ের জেলে পরিবারের শ্রী মতি শিখা রানী হলদার ও সাগরিকা হলদার বলছেন,আমরা নদীর মুক্তি চাই। নদীতে আগের মত মাছ ধরে জীবন ধারণ করতে চাই। আমাদের সংসার আর চলছে না, আমরা কোন দিকে শান্তি পাচ্ছি না। ছেলে মেয়ে মানুষ করা কঠিন। দেশে সবদিককার নদী খোলসা করার দাবী তাদের মুখে। তারা বলছেন, বড়াল পাড়ের হিন্দু পরিবার গুলো নদীতে পানি না থাকায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। না পাড়ছে নদীতে মাছ ধরতে, না পাচ্ছে অন্য কোন কাজ করে খেতে। এমনিতেই তালাবাসন মাজা,গোসল,রান্না ময়লা কাপড় ধোয়ার পানি সংকটে জীবন যাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। তার উপর বসতি জমি দখলের কবলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছে।

পাবনা জেলা প্রশাসক মো:জসিম উদ্দিন বলছেন, নদী রক্ষা কমিশন সারাদেশের নদীর কথা বিবেচনা করে পাবনার অবস্থা জানতে চাইলে আমরা তো পাঠিয়ে দিয়েছি নদী রক্ষা কমিশনে। পুর্বে দখলদার যে লিষ্ট ছিলো। সেটার সাথে নতুন করে যারা দখল করছে তাদের টাও সংযোজন করে আমরা পাঠিয়েছি। সরকারের ডেন্টা প্লান্টের অধীনে কোটি কোটি টাকা বরাদ্ধে খনন কাজ চলমান প্রায় ১০টি নদীর। যদিও খনন ও উচ্ছেদ প্রকল্প সহ নদী রক্ষার জন্য বর্তমানে ইছামতি ও বড়াল নদীকে দেশের শত নদীর আওতায় উন্নয়ন বরাদ্ধ হলেই কর্ম প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যাবে। এ জন্য জনগণের সহযোগিতা, সমর্থন এবং সদইচ্ছার বিকল্প নেই।

পাবনা ইছামতি নদী উদ্ধার আন্দোলনের আহবায়ক এস.এম.মাহবুব আলম,তিনি জানান, ২০০৩ সালে যে অবৈধ দখলদার স্থাপনা গুলোর জরিপে ২৮৫ জনের লিষ্ট করা হয়। বর্তমানে আবার নতুন করে জরিপ কাজ চলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় জেলা প্রশাসন।

বড়াল রক্ষা আন্দোলন (চাটমোহর) এর সদস্য সচিব; এস.এম.মিজানুর রহমান জানায়,প্রশাসনের দখল মুক্ত করছে। তবে যারা প্রভাবশালী তাদের উচ্ছেদ করছেনা। তারা প্রতিদিন দখল করছে। সম্প্রতি চাটমোহর পৌর মেয়র বড়াল নদীর পাড় দখল করে অবৈধ মার্কেট গড়ে তুলেছেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে সরকারের সদইচ্ছা এবং প্রভাবমুক্ত প্রশাসন ছাড়া নদী রক্ষা সম্ভব নয়। নদী দখলদারদের উচ্ছেদ সহ তাদের শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা না হলে এই উচ্ছেদ অর্থহীন হবে এবং পুনরায় দখলদারীত্ব প্রতিষ্ঠাপাবে।

পাবনার ইছামতি ও বড়াল কে দখল মুক্ত করে নদী খনন ও পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!