গল্পটা ভালোবাসার……….

 

রুমিকে বাসস্ট্যন্ডে ছেড়ে এসে একা ফিরছে মেয়েটা। রুমি ফিরে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে বাসস্ট্যন্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। রুমি যাচ্ছে ঢাকার দিকে। মেয়েটা ফিরছে উল্টো দিকে। দু’চোখ ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। আশেপাশের কেউ কেউ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে মেয়েটার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই মেয়েটার। এ কান্না লুকোনোর কোন প্রচেষ্ঠা সে করছে না। তার কেবল বারে বারেই মনে হচ্ছে সে কিছু একটা ফেলে যাচ্ছে।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
‘রুমি’ নামের ছেলেটা নামহীন এই মেয়েটার আমন্ত্রণে এসেছিল তার শহরে। মেয়েটা লেখালেখি করে তার কাছ থেকে ব্র‏হ্মপুত্রের তীরে দাড়িয়ে কোন একটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখার আমন্ত্রণ পেয়েছিল রুমি। শীতের রাতে পাশাপাশি বসে নদীতে চাঁদের ছায়া দেখার লোভ সামলাতে না পেরে রুমি তাই এসেছিল এত দূরের অচেনা এই শহরে। সে শহরেই থাকে মেয়েটা। পাগল ছেলেটা অসম্ভব কিছু সুন্দর স্বপ্নের টানে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল।
মেয়েটাকে না জানিয়ে একদিন সে চলে এল মেয়েটির শহরে। হঠাৎ সন্ধ্যায় ফোন করল..
 এই যে মেয়ে! তুমি কি জানতে চাও এ মুহূর্তে আমি ঠিক কোথায় ?
 অবশ্যই জানতে চাই! কোথায় তুমি ?! মেয়েটা অবাক হয়ে জানতে চায়…..
 আমি এখন তোমার শহরে!! আমি এখন তোমার শহরের কোথাও আছি….! লেখিকা মেয়েটির হৃদয়ে তোলপার শুরু হয়ে গিয়েছে। কি বলছে ছেলেটা এসব ?!! বিশ্বাস হতে চায়না তার। বিষ্ময়ে মেয়েটা বুঝতেও পারে না। অচেনা শহরে ছেলেটাকে সে কিভাবে স্বাগতম জানাবে। বিষ্ময় চেপে রেখে মেয়েটা বলে।
 তুমি কি সত্যি বলছ ?
 হ্যাঁ আমি সত্যি বলছি। শহরে পা দেবার পর থেকে রুমি অস্থির। কখন সে তার কাঙ্খিত লেখিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। শুধু এ মেয়েটার জন্য এ মেয়েটার অদ্ভুত সুন্দর কিছু স্বপ্নের আমন্ত্রণের জন্য সে সারারাত ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথে পথে হাঁটতেও পারে। ছেলেটা বার বার ফোন করে মেয়েটাকে বলে…. আর কোন পাওয়া নেই। আমার সব কষ্ট। সব অজানা আশঙ্কা মিলিয়ে গেছে। রুমির এ বিষ্ময় মেয়েটাকে বিষ্মিত করল হাজার গুণ বেশী। মেয়েটা ভাবল… পৃথিবীতে এমনও মানুষ থাকে। এমনও কি হয় ? পৃথিবী কত বিচিত্র। কালও যে দু’জন দু’জনের সাথে জীবনে কোনদিন দেখা হবার সম্ভাবনাই ছিলনা, আজ একটা চন্দ্ররাতে সে মানুষের বুকে মেয়েটা পরম নির্ভরতায় মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তার ভয় করছেনা। সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ অনুভূতির কি নাম হতে পারে ? ‘ভালোবাসা’ ছাড়া এ অনুভূতির কোন নাম দেওয়া বোধহয় অন্যায় হবে!!
অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ‘রুমিকে’ বসতে বলে মেয়েটা। রুমি বিছানায় বসে। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েটিও বসে রুমির পাশে। হঠাৎ রুমি মেয়েটার সামনে এসে হাটুঁ গেঁড়ে নীচে নেমে বসে। মেয়েটা ইতস্তত হচ্ছিল বার বার বলছিল.. উপরে উঠে বসার জন্য বলে। কারণ তার অসম্ভব লজ্জা লাগছিল।
‘রুমি’ মেয়েটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল। আর বার বার বলতে লাগল এই হাত দিয়েই তো এই মেয়েটা লিখে!! এই হাতের লেখাই এমন মুক্তার মত ঝরঝরে, চকচকে? আমার কি ভাগ্য! আমি এই মেয়েটার সামনে তার হাত দু’টো ধরে বসে আছি। মেয়েটার চোখে পানি। তার জীবনের এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সে এই প্রথম বারই হয়েছে এবং এটাই শেষ বার। সে জানে এর আগে শুধু তাকে নিয়ে, তাকে ভালোবেসে এতটা বিষ্মিত কেউ হয়নি। আর কেউ হবে ও না কখনো।
 আজ পূর্ণিমা। আমরা ব্র‏‏হ্মপুত্রের তীরে বসে চাঁদ দেখব না ?। যে স্বপ্ন আমায় এতদূর টেনে এনেছে ? রুমি বলে…..
 মেয়েটা লজ্জা পায় , বলে….
 ওতো কল্পনাতে। বাস্তবে কি স্বপ্ন অতটা সুন্দর হয় ?
 অবশ্যই হয়। বাস্তবের কিছু স্বপ্ন এত বেশী সুন্দর হয় যে এই মেয়েটার কাছে না এলে আমার তা অজানাই থেকে যেত আজীবন।
 আমি আমার কল্পনাগুলোকে আজ রাতে সত্যি করতে চাই। চল !! লেখিকার বাড়ি ব্র‏‏হ্মপুত্রের তীরে কোন এক কোয়ার্টারে। মাঝে মাঝেই এর ছাঁদে বসে মেয়েটা চাঁদ দেখে। কিন্তু আজ কি করে এই ছেলেটাকে তার স্বপ্ন পূরণের পথে নিয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে বহু কষ্টে সমস্ত ভয় বাধাঁ পেরিয়ে একটা সময় দু’জন বেরিয়ে আসে রাস্তায়। রাস্তা একদম ফাঁকা কিছুই নেই। না থাকারই কথা। এত রাত, সে ছেলেটার হাত ধরে খুব শক্ত করে। দু’জনে হাঁটতে থাকে বেশ কিছুদূর। এবার একটু ভয় লাগে মেয়েটার। নিশ্চয়ই ছেলেটারও লাগে কিন্তু দু’জনেই যা অব্যাক্ত রেখে দেয়। এই তো নদীতীর… চলে এসেছে তারা…. এখানে বসা যায়। এ জায়গাটা নিরাপদ মনে হয় দু’জনের কাছে। দু’জন সেখানে পাশাপাশি বসে। এই সেই কাঙ্খিত রাত.. সেই কাঙ্খিত স্বপ্ন। এই সেই বহু আকাঙ্খিত পূর্ণিমার চাঁদ, যা কুয়াশা ঢাকা এই রাতেও আগলে রেখেছে শহরটাকে। সে চাঁদের ছায়া পড়েছে নদীর জলে.. কি যে মহিমাময় সে দৃশ্য!! পৃথিবীর অন্য কেউ দেখতে পারছেনা শুধু এ দু’জন ছাড়া। এই চাঁদ জানে না সে কত ভাগ্যবান। শুধু তার টানে দু’জন মানুষ পথ হারা পথিকের মত হেঁটেছে। চুরি করেছে। সমাজ সংসার সবকিছু তুচ্ছ করে এসে ব্র‏‏হ্মপুত্রের তীরে পা মেলে বসে রয়েছে…
 অসাধারণ!! কি অসাধারণ। রুমি বলে উঠল। তুমি জান না তুমি আমায় কি দিলে! এই চাঁদ এই নদী আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। আর যে মেয়েটাকে পাশে নিয়ে আমি বসে আছি, সে এক কাথায় আমার ‘বিপন্ন বিষ্ময়’।
 আমি কি আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি ?? ছেলেটার প্রশ্ন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটা বলে…
 হুম্ পার…
 অভয় দিলে আমি কি কিছু কথা বলতে পারি ? রুমি বলে…
 অবশ্যই বলতে পার।
 তুমি যদি কখনো জানতে পার! আমি একজন সামান্য লেখক। যার লেখা তুমি মাঝে মাঝেই পড়। সে তার পরিচয় গোপন রেখে তোমার এতটা কাছে এসেছে তুমি কি নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে ? আমায় কি ভালোবাসবে? আমার অপরাধ কি ক্ষমা করে দেবে ? আমি পারলাম না। যে মেয়েটির কাছ থেকে আমি এতকিছু, এত সুখ নিয়ে ফিরব তার কাছে আমি আমার পরিচয় গোপন করে রেখে তাকে অন্ধকারে রাখতে পারব না।
 ময়েটি চুপ করে ছিল….। হঠাৎ বলল…
 আমি মনে করব সেটা আমার সৌভাগ্য। আমার সব পাওয়া না পাওয়ার মাঝে এটা বাড়তি পাওয়া, তবে এ অন্যায়ের জন্য আমি তোমাকে একটা শাস্তি দেব…
 আমি মাথা পেতে নেব সে শাস্তি! রুমি বলে-
 মেয়েটা ছেলেটার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেল। সাক্ষী থাকে মায়াবী রাত….। ভোর হতে খুব বেশী সময় বাকি নেই। এবার উঠতে হবে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে কখন যে রাত গড়িয়ে গেল বুঝতেই পারলনা তারা…
খুব সাবধানে মেয়েটিকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে শহরের ভেতর একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসে রুমি তার বিশ্বাস হতে চায়না কিছুই, কি ঘটল তার জীবনে, এসব কি সত্যি !? নাকি ঘুম ভাঙার পর তার মনে হবে সে স্বপ্নই দেখছিল এতক্ষণ। টেবিলে ওয়েটারের চায়ের কাপ রাখার শব্দে সম্বিত ফিরে পেল। না এতো সত্যিই!! এসব সত্যি!………..সব………।
মেয়েটির ও বিষ্ময়ের ঘোর কাটছেনা। তার প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হলো এক একটি স্বপ্ন। যেন চোখ মেলেলেই সব ফুরিয়ে যাবে। মিলিয়ে যাবে। তবে যাই হউক এসব কিছুর জন্য এখন মেয়েটির আরও হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
রুমি শহরের এদিক সেদিক একটু ঘোরাঘুড়ি করল। আজ থেকে মেয়টির সাথে সাথে এই শহরটিও তার আপন। খুব আপন, দুপুরে মেয়েটা এলো। একসাথে খেল তারা, অনেক কথা হলো তাদের। এবার উঠতে হবে দু’জনকে।
ছেলেটিকে এবার ফিরতে হবে। রুমিকে সাথে করে মেয়েটি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলো। মেয়েটি অবশ্য আসতে চায়নি, মেয়েটির কাছে যে কোন বিদায় ভীষণ ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা, অজানা আশঙ্কা, এই বুঝি শেষ বিদায়.. শেষ চলে যাওয়া, শেষ দেখা। মেয়েটির মন প্রচন্ড খারাপ। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে…
টিকিট কেঁটে গাড়িতে উঠে বসল রুমি। গন্তব্য ঢাকা। বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে মেয়েটা ধীর পায়ে রাস্তায় হেঁটে এলো। হাঁটছে আনমনে, অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে তার। চশমার ফাঁকে বার বার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছ’ছে মেয়েটা, মেয়েটা কাঁদছে, তার মনে হচ্ছে এর আগে কেউ কোনদিন তার জন্য এতটা পাগলামি করেনি, কেউ করেনি! নিশ্চয়ই গাড়িটা ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। আর একটু একটু করে ছেলেটা চলে যাচ্ছে লেখিকার শহর ছেড়ে। লেখিকা মেয়েটিকে ছেড়ে, তার স্বপ্ন ছেড়ে… ভাবতে ভাবতে একটা রিক্সায় উঠে মেয়েটা।
ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। রুমি ফোন দিয়েছে, রিসিভ করে কানে ধরে, কোন কথা বলতে পারে না মেয়েটা। তার দু’চোখ বেয়ে তখন পানি পড়ছে, ছেলেটা বলতে শুরু করল…..।
……এই যে, এই মাত্র আমি যে মেয়েটাকে ফেলে আসলাম, সে মেয়েটা জানেই না, সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবতী, রূপবতী একটা মেয়ে, মেয়েটা আমার জীবনের একমাত্র ‘বিপন্ন বিষ্ময়’। এই যে মেয়ে তুমি কি জান ? আমি এই শহর থেকে আমার নতুন জীবনটা নিয়ে ফিরছি, তুমি জান না মেয়ে! কিন্তু আমি জানি, আজ থেকে একটা মুহূর্ত আমার তোমাকে না ভেবে চলবে না, আচ্ছা! আমি কি এই মেয়েটাকে সারা জীবনের জন্য পেতে পারি ? জানি না কি করে পেতে পারি! তবে আমার যতটা জীবনীশক্তি রয়েছে আজ থেকে তার সবটা দিয়ে আমি এই মেয়েটাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাইব। আমি সেই চেষ্টাই করব…
উত্তরে মেয়েটা কিছু বলতে পারলনা। সে তখনও কাঁদছে, ফোনের ওপাশে যে মানুষটা সে’ও একটা বাচ্চা ছেলের মত কাঁদছে বুঝতে পারে মেয়েটা। তবে আজ দু’জন মানুষের এ কান্নাটা হৃদয় ভাঙার কান্না নয়। এ কান্না’টা ভালোবাসার কান্না। আবারও ফিরে আসার ব্যাকুলতার কান্না। পরিচয়ের পর থেকে ছেলেটা বার বারই বলত…….‘এই যে মেয়ে আমার ইচ্ছা হয় আমি আমার হৃদয়টা তোমার হাতে দিয়ে বলি, তোমায় দিলাম তুমি কি করবে কর’। আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি আমায় নিয়ে একটা গল্প লিখবে ?
ছেলেটা জানে না মেয়েটা তাকে নিয়েই লিখছে। তবে এটা কোন গল্প নয়। এটা সত্যিকারের জীবন্ত কোন এক অনুভূতি। এই পৃথিবীর কখনো কেউ জানবে কিনা জানেনা মেয়েটা। কখনো কেউ জানুক বা নাই জানুক জানে এই শহর, জানে গতরাতের পূর্ণিমার চাঁদ, জানে ব্র‏‏হ্মপুত্রের তীর। জানে একটা কুয়াশা ঢাকা শীতের রাত। মেয়েটা লিখছে কোন এক ভালোবাসার গল্প আর সে গল্পটি লিখতে গিয়ে তার চোখ ভিজে উঠছে বার বার। কারণ গল্পটা তো ভালোবাসার। গল্পটা ভীষণ ভালোবাসার একটা গল্প………………..।

ফারহানা হিমি
কলেজ রোড, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!