সেলিনা জাহান প্রিয়ার রহস্য গল্প- চলন্ত ট্রেনে খুন

 

চলন্ত ট্রেনে খুন
————————— সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

১৯৯৫ সাল আজমল পেশায় একজন সাংবাদিক। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন সাহসী ছেলে। তার খুব কাছের বন্ধু শফিক তার একমাত্র বোনের বিয়ে। শফিকের বোনের বিয়ে তে না গেলে শফিক খুব মন খারাপ করবে। তাই সব কাজ বাদ দিয়ে শফিকের বাড়ি জামালপুর মেলান্দ যাওয়ার জন্য রাতের ট্রেনের অপেক্ষা।
কমলাপুর থেকে রাত ১১ টায় ট্রেন ছাড়ে। ট্রেন জামালপুর হয়ে রংপুর যায়। মেইল ট্রেন। ঠিক টাইমে আজ ট্রেন ছেড়েছে। আজমল সিটে বসে দেখল মানুষ খুব অল্প। ট্রেন ছাড়তেই তেজগাঁ আর বিমান বন্দর থেকে অনেক মানুষ উঠেছে। একজন মহিলা মাত্র অনেক দূরে কর্নারে বসা। মহিলার কারো দিকে খেয়াল নেই। সাথে কেউ নেই।
টঙ্গি ষ্টেশনে আসার পর আজমলের কামরার সব যাত্রী কেন জানি নেমে যাচ্ছে। আজমল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ট্রেন ছাড়ার সময় আবার চার জন যাত্রী ট্রেনে উঠল। কিন্তু সুন্দরী মেয়েটা তার সিটে ঠিকেই বসে আছে। কোন কথা বলছে না।
আজমল দেখল মেয়েটা ট্রেনের বাথরুমে গেল। চার জন যাত্রী নিজেদের কি নিয়ে আলোচনা করছে। মেয়েটা বাথরুম থেকে আসতেই চার জনকে দেখে বলে উঠল তোমরা ট্রেনে কেন?
—- একজন বলল কাউকে না বলে কি বাসা থেকে আশা ঠিক হয়েছে।
—- আমি কোথায় যাব না যাব সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
— অন্য জন বলল আপনার স্বামী কে বলে যাওয়ার কি দরকার নাই।
—- এটা আমি আমার স্বামীর সাথে বুঝবো।
— কিন্তু আপনার স্বামী এখন আমাদের সাথে বুঝতে বলেছে।
— তোমরা ট্রেন থেকে নেমে যাও বলছি।
— হা মিসেস সালমা মেম। তবে আপনাকে নিয়েই সামনের ষ্টেশনে নেমে যাব।
— না আমি তোমাদের সাথে যাব না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সামনের ষ্টেশনে পুলিশ
ডাকতে বাধ্য হবো।
—- সালমা মেম পুলিশ ডাকুন আর আর্মি ডাকুন। আমি যখন এসেছি তবে
আপনাকে নিয়েই যাব।
—- আজমল বলল – এটা কি শুরু করলেন। ভদ্র মহিলা কে কেন বিরক্ত করছেন।
—- একজন আজমল কে ধমক দিয়ে বলল এই মিয়া চুপ করে বসুন। কল্লা ফেলে
দিব। আজমল দেখল চার জন একসাথে আজমল কে বলছে। জানের মায়া
থাকলে চুপ কর।
—- মেয়েটি বলল চুপ করবে কেন। যা দেখছে। তাই বলছে।
—- একজন বলছে। সালমা মেম জীবিত বা মরা আপনাকে নিয়ে যেতে হবে।
—- জীবিত আমাকে নিতে পারবে না। মরাই নিতে হবে।
— মেম আপনার মাথার দাম তিন লাখ টাকা। শুধু মাথাটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।
— মেয়টা বলল তাই নিয়ে যা। মনে রাখিস আমার নাম সালমা। আমার জীবন
থাকতে আমার বাবার টাকা আমি আমার স্বামী কে দিব না।
— দুই জন লোক এসে আজমল কে বলল ট্রেনের বাথ রুমে যেতে,
—- আজমল বলল এটা কেমন কথা। মেয়েটা বলল ভাই আপনি ভয় পেয়েন না।
এই গুলো লেজ কাঁটা কুকুর কিছুই করতে পারবে না। ভাইয়া আমার বাড়ি ২৭
চামেলি বাগ।
এই কথা বলা মাত্র একজন একটা চুরি বের করে মেয়েটির পেটে বসিয়ে দিল। মেয়েটা একটা চিৎকার করলো। দুই জন মিলে মেয়েটাকে নিচে ফেলে গলা চেপে ধরল। রক্তে ট্রেনের কামরা ভরে গেল। চার জন মানুষ মিলে মেয়েটাকে আজমলের সামনে মেরে
ফেললো। আজমল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তাদের সবার কাছে ছুরি। আজমল ভয়ে ট্রেনের বাথ রুমে গিয়ে পালালো। আজমল শুনতে পাচ্ছে চার জানের হাসি।
একজন বলছে ঐ বেটা দরজা খোল। অন্যজন বলছে মাথা কাটার দরকার নাই। ওর জামাই বলেছে একটা আঙুল কেটে নিলেই হবে। যেই আঙুলে নীলা আংটি আছে। কাপড়ের ব্যাগটা নে। লাশ পরে থাক। এই দেশে কেউ কারো খবর রাখে না।
আজমল কে চার জন মিলে ডাকছে। এই বেটা বের হয়ে আয়। দরজা খুল। না হয় তোকে মেরে ফেলব। আজমল ভয়ে চুপ হয়ে গেল। কোন শব্দ আর করছে না। ভাবছে একটু আগে যেই মেয়েটা এত সাহস দেখালো এখন সে লাশ। চার জনের সাথে আমার পক্ষে পারা সম্ভব না। আজমল ভয়ে চুপসে গেল।।
তার পর কিছুই মনে নেই। হটাৎ দরজা ধাক্কার শব্দে আজমলের হুস আসলো। আজমল বাথ রুমের জানালা দিয়ে দেখছে অনেক মানুষ। এবার সাহস করে দরজা খুলল। কারন খুনিরা এত সময়ে চলে গেছে।
দরজা খুলে দেখে সে জামালপুর। কিন্তু ট্রেনের মধ্য কোন রক্ত মানুষের লাশ কিছুই নাই। সে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। একজন বলল ভাই কি এভাবে দেখছেন। আজমল যেই জায়গায় রক্ত পড়ে ভরে গিয়েছিল সেই খানে কোন রক্ত নাই। বাদামের খোসা আর কাগজ পড়ে আছে। আজমল বলল গতরাতে এই খানে একটা মেয়েকে চার জন মিলে হত্যা করেছে। সবাই হাসতে লাগলো। কি যেন বলেন ভাই। রাতে এই ট্রেন আসছে এখন চলে যাবে। আজমল তাহলে কি স্বপ্ন দেখছিল। না স্বপ্ন হতে পারে না।
স্বপ্ন হলে সে বাথরুমে থেকে বের হবে। মেয়েটার হাতের রক্ত একটা সিটে লেগেছিল। আজমল সেই সিটের কাছে গেল না কোন রক্ত নাই।
ট্রেনের কামরা থেকে নেমে বার বার ট্রেনের কামরা টা দেখছিল।
কয়দিন পড়ে আজমল ঢাকা আসলো। কিন্তু বার বার ট্রেনের কথা মনে হচ্ছিল।
মনে মনে ভেবে নিল এটা স্বপ্ন ছিল তার। একদিন কি একটা কাজে চামেলিবাগ গেল
ফেরার পথে দেখে ২৭ চামেলিবাগ । আজমল রিক্সা থামিয়ে গেইটের সামনে নামলো। অনেক পুরানো বাড়ি। একজন বলল – কাউকে খোঁজছেন।
— হ্যা এটা কি ২৭ চামেলিবাগ।
— হ্যা ২৭ ই তো লিখা। আজমল বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। একজন মহিলা
বের হয়ে বলল কাকে চান বাবাজি। এই বাসায় সালমা নামে কেউ আছে।
মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল – আপনি কে বাবাজি।
—- আমার নাম আজমল।
—- সালমা কে কি করে চিন?
— যে ভাবেই হক চিনি। সে কি আছে। মহিলা কেঁদে দিয়ে বলল বাবা সালমা নিখোঁজ আজ ১২ বছর হল। আমার মেয়ে। তুমি কি ওর সাথে পড়তে বাবা।
—- না খালা। আমি একজন সাংবাদিক।
—- বাবা কত সাংবাদিক। কত পুলিশ। কত কি করলাম। কিন্তু মেয়ে কে পাইলাম
না। আমার মেয়ে বড্ড ভাল ছিল। আমার স্বামী মারা যাওয়ার সময় তার সব
কিছু মেয়ের নামে দিয়ে যায়।
—- আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল কার সাথে?
—- বাবা আর কি বলব সে কথা। আমার স্বামী তার প্রিয় বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে
দিয়েছিল। আমার মেয়ের সাথে বিয়ের পর থেকে শুধু টাকা টাকা। আমার স্বামী
মারা যাওয়ার পর। একদিন রাতে মেয়ে আর মেয়ের জামাই বাসায় আসে।
রাতে মেয়ে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়। তখন আমি বাধা দেই। জামাই
বলে মা চিন্তা করবেন না। সালমা রাগ করে বাসাই যাবে। মেয়েটা রিক্সা নিয়ে
রাগ করে কোথায় চলে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ নাই।
—– পুলিশে মামলা করেছিলেন।
—– হা করেছি। পুলিশ মামলাটা সি আই ডি তে নেয়। সি আই ডি সালামার স্বামী কে সন্দেহ করে। কিন্তু মেয়ে তো আমার বাসা আমার সামনে থেকে চলে যায়। আমি মেয়ের জামাই কে নিয়ে সকালে জামাই এর বাসায় যাই মেয়ে নাই। জামাই এর আমি সব জায়গায় খুজি। আমার জামাই তো অনেক ভাল মানুষ। মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ৫
বছর পড়ে অন্য মেয়ে কে বিয়ে করে।। কিন্তু পুলিশ বলে এটা জামাই এ করেছে। কিন্তু প্রমান দিতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।
—- মামলার নাম্বার টা আছে আপনার কাছে।
—- আজমল সালমার মায়ের কাছ থেকে মামলার নাম্বার টা নেয়। বিকেলে মালিবাগ
সি আই ডি তে আসে। সি আই ডি অফিসার মিঃ কনক বলে আমি মামলাটা
তদন্ত করেছিলাম। কিন্তু আসামী খুব চালাক। সালমা কে সে খুব চালাকি করে নিখোঁজ করে দেয়। পুলিশের ধরানা মেয়েটা পাচার হতে পারে বা হত্যা। কিন্তু সালমার মায়ের সাক্ষীর জন্য সালমার স্বামী বেঁচে যায়। তার স্বামী বিষয়ে পুলিশ এর আগাতে পারে না মামলা।।
আজমল বলল – আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমি একজন সাংবাদিক।
—– কি ভাবে সাহায্য করতে চান মিঃ আজমল?
—- মিঃ কনক সাহেব। যেই দিন মেয়েটা নিখোঁজ হয়। ঢাকা থেকে জামালপুর
রেল ষ্টেশনে কোন মহিলার লাশ পাওয়া গেছে কিনা দেখতে হবে। নিখোঁজ থেকে
তিন দিনের মধ্যে।
—- যদি লাশের রিপোর্ট পাওয়া যায়। আর যদি সেই লাশের রিপোর্টে মেয়েটির ডান
হাতের কোন আঙুল কাঁটা থাকে তবেই মিলে যাবে।
—- লাশের সাথে আঙুলের কি সম্পর্ক?
—- মিঃ কনক সাহেব। এটাই রহস্য।।
ঠিক আছে চলুন কাল থেকে আমি আর আপনি তদন্ত শুরু করি। মিঃ আজমল আর মিঃ কনক মিলে জি আর পি পুলিের গত ১২ বছর আগের রেল ষ্টেশনের লাশের
তালিকা দেখছে। মিঃ কনক বলল আজমল সাহেব। একটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল।
গফরগাও রেল ষ্টেশনে।
—– দেখুন তো কনক সাহেব কামরা নাম্বার টা আমার কামরা নাম্বারের সাথে মিলে কিনা। আজমল তার লিখা আগের কামরা নাম্বার আর লাশ পাওয়ার কামরা নাম্বার
এক। মিলে গেল দেখে আজমল বলল মিঃ কনক হিসাব মিলে গেছে।।
— কি হিসাব মিঃ আজমল।
— রিপোর্ট দেখেন ডান হাতের আঙুল কাঁটা কি না।
—- মিঃ আজমল ঠিক আঙুল কাঁটা। আপনি ফাইল নিয়ে চলুন অফিসে। আমাদের
যেতে হবে সালমার মায়ের কাছে।
আজমল আর কনক মিলে সালমা মায়ের কাছে এলো। আজমল আর পুলিশ অফিসার
কনক মিলে সালমার মায়ের কাছে বসা।
—- আজমল বলল খালামনি আপনার কি মনে আছে সালমা একটা নীলার আংটি
পরত।
—- কেন মনে থাকবে না বাবা। আমার স্বামীর মারা যাওয়ার তিন দিন আগে সখ
করে মেয়ে কে আংটি টি দিয়েছিল।
— খালামনি আপনার মেয়ের জামাই এখন কোথায়। এখন তো ও তার অফিসে। তাহলে আপনি চলুন। আমাদের তো চিনবে না। আপনি আমাদের নিয়ে বলবেন সালমা
আংটি টা দরকার।
—- বাবা সাংবাদিক ঐ নীলার আংটিটা এখন জামাই বাবা জি মেয়ের কথা শরণ
করে হাতে পরে।
— মিঃ কনক আপনি বলবেন চার জনের একজন আপনি এরেস্ট করেছেন। আর আংটিটি চাইবেন।
সালমার স্বামী খুব দারুন ব্যবসা করছে। অফিস লোকজন কাছ করছে। সালমার
মাকে নিয়ে অফিসে আসতেই সালমা স্বামী শাশুড়ি কে দেখে খুব মিষ্টি একটা হাসি
দিয়ে বলল আম্মু আপনি কষ্ট করে কেন আমাকে ফোন করলেই হতো।
—- না বাবা। একটা কাজে আসলাম। সালমা নীলা পাথরের আংটিটা কোথায়।
—- এই তো মা আমার হাতে।।
— আজমল বলল বাহ! তাই তো! তা মিঃ- সালমা আংটিটা আপনাকে কখন দিয়েছে।
—- কে আপনি?
—- কনকে আই ডি কার্ড দেখালো। বলল যা প্রস্ন করছি তার উত্তর দিন।
—– এটা আমাকে বিয়ের এক সপ্তাহ পড়ে সালমা আমাকে দিয়েছে।
—- খালামনি সালমা নিখোঁজ হওয়ার কত দিন আগে এই আংটি তাকে
দেয়া হয়েছে।
—- নিখোঁজ হওয়ার দুই আস আগে।
—- সালমা নিখোঁজ হওয়ার কত দিন আগে উনার সাথে বিয়ে হয়েছে। দের বছর।
—- কি মিঃ। দের বছর আগে নাকি। নিখোঁজ হওয়ার আগে।
—- ঠিক মনে নেই অনেক আগের কথা।
—- আপনার চার জন থেকে একজন ধরা পরেছে যে আপনাকে আংটিটা আঙুল
সহ এনে দিয়েছে।
—- মানে কে এরেস্ট হয়েছে?
—– আপনাকে আংটি কে দিয়েছে,
—- গফুর।
— রাইট গফুর। নাম তো মনে আছে।
সালমার মা বলল- তুই খুনি। আমার মেয়ের আংটি দে। সালমা মা তার স্বামীর হাতের আংটি টা নিজের হাতে নিয়ে নিল। সালমা স্বামী সব পুলিশের নিকট স্বীকার
করল। আজমল বলল মিঃ কনক আমার কি কিছু আর বলতে হবে।
—- না মিঃ আজমল। তবে আপনি কি করে জানলেন।
—–বাকি চার জন গ্রেফতার হয়েছে তারাই বলে দিবে।। কিন্তু ঐ চার জন বলছে
ঐ দিন ট্রেনে একজন ছিল তবে সে এই আজমল না। আজমলের কাছে
আজোও রহস্য। নিউ মার্কেট মোড় থকে কিছু গোলাপ কিনে আজমল সন্ধ্যায় চলে আসলো কমলাপুর রেল ষ্টেশনে। অপেক্ষা করছে জামালপুরের ঐ ট্রেনের। রাত নয়টায় ট্রেন আসে। ৯৬৯৬৯৬ কামরার কাছে যায়। ট্রেনে উঠে সালমা যে সিটে বসে ছিল ফুল গুলো ঐ সিটে রাখে। অনেক মানুষ উঠে ট্রেনে ফুলগুলো দেখে কেউ বসে না সিটে। ট্রেন ছাড়ে প্লাটফর্মে দাড়িয়ে থাকে আজমল। হটাৎ আজমল দেখে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের জানালা দিয়ে অনেক দূর থেকে মেয়েটা হাসি দিয়ে তার ফুল গুলো দেখছে। আজমল তার চোখ মুছে এবার দেখে মেয়েটা ফুল গুলো নিয়ে বাতাসে মিশে গেছে………….।।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!