ভয়ংকর বিপজ্জনক পথে ছুটছে বাংলাদেশ

 

 

ভয়ংকর বিপজ্জনক পথে ছুটছে বাংলাদেশ
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

বাংলাদেশের দক্ষিণমূখী যাত্রা কোন নতুন কথা নয়। এর আনুষ্ঠানিক শুরু ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ এর মর্মান্তিক হত্যালীলার পর একদিকে বাংলাদেশের বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নির্মমভাবে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ হত্যা এবং তাঁদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই তাঁরই বিশ্বস্তজন খোন্দকার মুশতাক কর্তৃক নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে ঘোষণা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, বেতার টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরকে ‘সূর্য্যসন্তান’ বলে আখ্যায়িত করে তারা “ইসলাম” বাঁচিয়েছে বলে উল্লেখ করা প্রভৃতির মাধ্যমে।
কিছুকাল পরে মেজর (অবশেষে জেনারেল) জিয়াউর রহমানের অবৈধ ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, রাইফেলের বাঁট দিয়ে (কোন নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে নয়) বাহাত্তরের সংবিধান সংশোধন করে তাতে “বিসমিল্লাহ্” সংযোজন ও স্বাধীনতা-বিরোধী পাকিস্তানের নাগরিক জামায়াতের আমীর গোলাম আযমকে ভিসা প্রদান ও অবশেষে ভিসা বিহীন গোলাম আযমকে স্থায়ীভাবে এ দেশে থেকে রাজনীতি করতে দেওয়া এবং অবশেষে জামায়াতে ইসলামী ও অপরাপর ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলকে একই পদ্ধতিতে সামরিক আইন ব্যবহার করে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়ে তাদেরকে প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ অবারিত করা হয়।
এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার প্রেক্ষিতে অবশেষে জিয়াউর রহমান যেমন পদ্ধতি অবলম্বন করে সংবিধানে “বিসমিল্লাহ্” বসালেন, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ধর্মাশ্রয়ী দলকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়ে মাঠে নামার সুযোগ করে দিলেন ঠিক অনুরূপ পদ্ধতি অবলম্বন করে পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ সংবিধানে “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম” এই কথা কয়টি সংযোজন করে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রটির ইসলামীকরণ করে পাকিস্তানী করনের পথ সুপ্রশস্ত করলেন।
এ ভাবেই দেশটার পশ্চাদ্ধাবন ও উগ্র সাম্প্রদায়িকীকরণ পর্ব শুরু হয় এবং দিনে দিনে তা অব্যাহত থাকে, ফুলে পল্লবে বিকশিতও হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার নীতি ও আদর্শমালা মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতাও দিনে দিনে যেন একটি পরিপূর্ণ ও প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে পর্য্যবসিত হতে থাকে। সেই সাথে ১৯৭২ এর ঐতিহাসিক সংবিধানের মর্মবাণী ও মৌলনীতি সমূহকে পর্দার অন্তরালে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হতে থাকে।
রাষ্ট্রের যদি ইসলামীকরণ করা হয় (বা যে কোন ভাবে যে কোন ধর্মের নামে ধর্মীয়করণ করা হয়) তার প্রত্যক্ষ অভিশাপ সরাসরি গিয়ে আঘাত করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির উপর। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।
বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সম্প্রদায়গুলি এমনটি কদাপি আশা করেন নি। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর জন্য তাঁরা গড়ে তোলেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ তৎকালীন আওয়ামী লীগের ইন্ধনে বা সমর্থনে। যদিও এটি একটি অকার্য্যকর পদক্ষেপ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ দেশে যে ব্যাপক সংখ্যক অসাম্প্রদায়িক মুসলিম রয়েছেন এবং তাঁরাও যে রাষ্ট্রের এহেন ইসলামী করণের ঘোর বিরোধী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমূহের ঐ পদক্ষেপ সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সংগ্রামে তাঁদের প্রতি এক ধরণের অনাস্থার বহি: প্রকাশ বলে বিবেচনা করার এক অহেতুক সুযোগ সৃষ্টি হলো যেন।
যা হোক, আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দল হিসেবে মাঠে আন্দোলনে সামিল ছিল ১৫ দলীয় ও পরে ৮ দলীয় এবং ৫ দলীয় জোটের মাধ্যমে। এই জোটগুলির গৃহীত ন্যূনতম কমন কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবন ও “বিসমিল্লাহ্” জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির নিষিদ্ধ করণ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা। এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী দলও ছিল আওয়ামী লীগ।
১৯৯০ তে যখন ১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দলের যৌথ ও যুগপৎ আন্দোলনের তীব্রতা যখন শ্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটালো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তখন এই মর্মে প্রত্যাশার সঞ্চার হলো যে এবারে জিয়ার পঞ্চম ও এরশাদের কুখ্যাত অষ্টম সংশোধনী বাতিল হবে এবং ১৯৭২ এর সংবিধান অবিকৃতভাবে পুন:স্থাপন করা হবে ও দেশটা পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতার পথে অবাধে ও সর্বসম্মতভাবে যাত্রা সুরু করবে।
কিন্তু হা হতোহ্স্মি। ১৯৯০ এর স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের ফলাফলে বিএনপি সর্বাধিক আসনে নির্বাচিত হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ পরিণত হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে। এ কারণে সরকার গঠন সহজ হতে পারতো যদি বিএনপি আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলি সমবায়ে একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হতো। জামায়াতে ইসলামী ঐ নির্বাচনে কিছু আসনে বিজয়ী হলেও তারা সংসদে ও রাজপথে একঘরে হতে পারতো। বামদলগুলি তেমন দাবী নিয়ে অগ্রসর হলেও দুটি বৃহৎ দলই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অত:পর বাম দলগুলির সমর্থনে বি.এন.পি একাই সরকার গঠন করুক জামায়াতে ইসনলামীকে বাদ রেখে এমন প্রস্তাব বামদলগুলি দিলেও বি এন পি তাতে অসম্মত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করলো আন্দোলনের জোটগুলির প্রণীত রূপরেখার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে।
পাকিস্তানী বা সাম্প্রদায়িকীকরণের গতি আরও তীব্র হলো। সাথে সাথে হতাশাগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ ও অব্যাহতভাবে বাড়তে বা চলতে থাকলো। কিন্তু তা প্রতিরোধের ব্যাপারে কোন মহল থেকেই কোন উদ্যোগ নিতে কদাপি দেখা গেল না। সংখ্যালঘুরা এ দেশের ‘নাগরিক’ নন বা ‘অবাঞ্ছিত নাগরিক’- প্রভাবশালী দলগুলির আচরণে তেমনটাই বরাবর পরিলক্ষিত হলো।
ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দিব্যি বেড়ে উঠতে থাকলো বিএনপি’র কল্যাণে। ক্ষমতাসীন হয়ে তারা অর্পিত বা শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করা তো দূরের কথা-বরং তা যেন দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠ পর্য্যায়ে কার্য্যকর হতে থাকলো। জঙ্গীপনার সৃষ্টি হলো। রাজশাহীতে বাংলাভাই এর উত্থান দেশবাসীকে চমকে দিলো।
মন্দির-গীর্জা প্রতিমা ভাংচুর নিয়মিত ঘটনার মতই ঘটতে থাকলো। কিন্তু এ সকল অপরাধের জন্য কোন মামলা পর্য্যন্ত গ্রহণ করা হলো না। আওয়ামী লীগ ও বাম দলগুলি সোচ্চার থাকলো এগুলির বিরুদ্ধে। দাবীও জানাতে থাকলো বাহাত্তরের মূল সংবিধান চালু করার -জিয়ার পঞ্চম সংশোধনী ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করার।
অবশেষে একটানা দীর্ঘ একুশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। ব্যাপক আশাবাদেরও সৃষ্টি হয় জনগণের মনে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমূহ সহ সকল অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও শক্তির নতুন বিজয় সূচিত হলো যেন। দাবী উত্থাপিত হলো ১৯৭২ সালের সংবিধানের অবিকৃত পুনরূজ্জীবনের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ সম্মত থাকলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সংবিধান সংশোধন সম্ভাবপর হলো না এই দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা সত্বেও।
যাহোক, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে পুনরায় দেশব্যাপী ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল বি.এন.পি. পুনরায় নির্বাচিত। অত:পর পুনরায় চলতে থাকলো বাহাত্তর সংবিধানের অবিকল পুনরুজ্জীবনের ও দেশকে অসাম্প্রদায়িকীকরণের আন্দোলন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বামদলগুলির সমন্বয়ে বা একজোট বদ্ধ হয়ে। এবারের ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচারের দাবীও জানালো আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি, জাসদ প্রভৃতি দল পৃথক ও সম্মিলিতভাবে। কিন্তু ঐতিহ্যই এদেশে এমন যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোন বিচার হয় না-এবারও হলো না তবে দাবীটা উত্থাপিত হতে থাকলো।
এই দফা বি এন পি’র পরে ক্ষমতাসীন হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দু’বছর ক্ষমতায় থাকলেও সেনা সমর্থিত এই সরকার জরুরী অবস্থা জারী করে দুর্নীতি-বিরোধী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সাম্প্রদায়িক শক্তি দমনে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। তবে সন্ত্রাস দমন কার্য্যক্রম জোরে সোরে ঐ সরকার চালানোর ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির কার্য্যক্রমে যথেষ্ট ভাটা পড়েছিল।
অত:পর ২০০৮ সালের এবং তার পরবর্তী নির্বাচনে, যার মেয়াদ এখনও চলছে, আওয়ামী লীগ-বিপুল সংখ্যক আসনে (দুই-তৃতীয়ংশের অনেক বেশী) বিজয়ী হয়ে আজতক ক্ষমতাসীন রয়েছে। দেশের বৃহত্তম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হওয়ার কারণে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘকাল এই দলের একছত্র নেতৃত্বে ও প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করায় সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সামনে বিপুল সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু দু:খজনক হলেও শেখ হাসিনা তাঁকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রত্যাশাগুলি পূরণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন ফলে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা আজ মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন।
এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে একটি রীট আবেদনের নিষ্পত্তিকালে মাননীয় হাই কোর্ট জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতা দখল ও তাদের ক্রিয়াকলাপ এবং তৎসহ পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে স্পষ্টভাবে অভিমত দিলেন ঐ দুই সেনাশাসকই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী এবং ঐ অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে সরকার। আপীলে সুপ্রিম কোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখায় বিসমিল্লাহ্ ও জামায়াতে ইসলামী ও রাষ্ট্রধর্ম বে-আইনী ঘোষিত হলে এই সরকারের বাহাত্তরের মূল সংবিধান পুনরুজ্জীবন অপ্রত্যাশিতভাবে সহজ হয়ে পড়ে। প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র একটি গেজেট প্রকাশের। হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের ঐ ঐতিহাসিক রায় দেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হলো। আশাবাদের সৃষ্টি হলো অনতিবিলম্বেই সংবিধান বাহাত্তরের মৌলিকত্ব ফিরে পাবে-ধর্মনিরপেক্ষতার পথে গততন্ত্রের পথে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যভিসারী পথে চলা নতুন করে বাংলাদেশ শুরু করবে।
কিন্তু না। সরকার গেজেট তো করলেনই না-বরং উচ্চ মহল থেকে দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পেশ করা হলো সংসদে এবং কয়েকজন সদস্যের ক্ষীণকণ্ঠ আপত্তি রেকর্ড না করে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নীতি আদর্শ সংরক্ষণের কাজে না লাগিয়ে তা বিসর্জন দেওয়ার কাজে লাগানো হলো। ঐ সংশোধনীতে জিয়ার “বিসমিল্লাহ্” জামায়াত সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দল বৈধকরণ এবং এরশাদের “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” পুন:প্রবর্তন করা হোল-অগ্রাহ্য করা হলো হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত রায়কে।
দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের নীতি-আদর্শ, বাহাত্তরের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি, বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ও গৃহীত নীতি আদর্শ প্রত্যাখ্যান করে জিয়া-এরশাদের সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানী আদর্শমালার সাংবিধানিকীকরণ করে বাংলাদেশের উল্টোপথে যাত্রার সাংবিধানিক ভিত্তি স্থাপন করা হলো। ফলে উৎসাহিত হলো সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ ও জঙ্গীবাদীরা। এ ঘটনা ঘটানো হলো ২০১২ সালে। স্তম্ভিত হলো সকল অসাম্প্রদায়িক শক্তি, সকল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।
স্পষ্টত:ই আওয়ামী লীগ মধ্য বাম ধারা থেকে সরে পুরোদস্তÍর ডানপন্থী পথে কাগজে-কলমে যাত্রা সুরু করলো। সে যাত্রা অবিরাম ক্লান্তিহীনভাবে চলছে অব্যাহতভাবে। যতই বিস্ময়কর বলে বিষয়টা কারও কারও কাছে মনে হোক না কেন-নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো এই যে আওয়ামী লীগ নামক দলটি ক্রমান্বয়ে ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারটি প্রতিক্রিয়ার পথে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই , এই পাঁচটি বছর ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম এই দলটি, মুক্তিযুদ্ধের এবং তার পূর্ববর্তী দশকগুলিতে অসংখ্য ইস্যুতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলির নেতৃত্বদানকারী এই দলটি ক্রমান্বয়েই প্রক্রিয়ার পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে এবং আজ তা দেশের সকল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিকাশের পথ রুদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ক্রমশঃ বাড়ছে। সংখ্যালঘু হত্যায়, তাদের সয়-সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে বিতাড়ন, নারী অপহরণ, ধর্ষণ সবই চলছে বাধাহীন ভাবে। আজতক সংখ্যালঘু নির্য্যাতনের হাজার হাজার ঘটনা ঘটলেও তার একটিরও বিচার হয় নি একজনেরও শাস্তি দেওয়া হয় নি।
অথচ আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভারতে সংঘটিত বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের তিন শীর্ষ নেতাসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিচার অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে ঐ নেতারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারবেন না বলে ভারতের অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি মনে করেন। আর এভাবে আইনের শাসন থাকার ফলেই সে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ কখনও নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন না-দেশত্যাগের কথা মনেও আনেন না। আর আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ?
তদুপরি ঐ সংশোধনীর পর থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গীবাদের ক্রম-প্রসার ঘটতে চলেছে সরকারী দমন প্রক্রিয়া চালু থাকা সত্বেও তা দেশের নানা স্থানে গোপনে ছড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে – পুলিশ-র‌্যাব নিত্য নতুন জঙ্গী ঘাঁটির সন্ধান পাচ্ছে-অভিযান চালিয়ে অনেকাংশে সফল হলেও জঙ্গীদের ঘাঁটি নির্মাণের কাজ দিগি¦দিকে ছড়ানো অব্যাহত রয়েছে।
২০১৩ সালে সরকার উৎখাতের শ্লোগান নিয়ে আকস্মিকভাবে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করে বসলো হেফাজতে ইসলাম নামধারী কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন। আওয়ামী লীঘ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তারা সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবী জানালো রাষ্ট্রের ইসলামীকরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতির ইসলামী করণের। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সরকার ও সকল প্রগতিবাদী মহল তার তীব্র প্রতিবাদ জানালেও ধীরে ধীরে গোপনে সরকার তাদের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকলো-ঐ গোপন উদ্যোগ অবশেষে সফল হলো-২০১৭ সালের শিক্ষা পাঠ্যসূচীতে বিপুল সংখ্যক খ্যাতনামা লেখক কবি সাহিত্যিকের লেখা বাদ দিয়ে তার স্থলে ইসলামীকরণের নামে সাম্প্রদায়িক ভাবধারার কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-ছেপে পাঠ্যপুস্তকের লক্ষ লক্ষ কপি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে বিনামূল্যে বিতরণ করা হলো। আগামী ও বর্তমান প্রজন্মগুলি বাঙালি না হয়ে যাতে লক্ষ লক্ষ গোলাম আযম ও বাংলাভাই পয়দা হয়-তার পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হলো। সকল প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করা হলো। এর পর সরকার আর পিছু ফিরে তাকান নি। অতি সম্প্রতি ভারত-সফর শেষে দেশে ফিরে পরের দিনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করেই বসলেন ৩০০-৩৫০ উগ্রবাদী জঙ্গীবাদী ঘোর সাম্প্রদায়িক হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা শাফির নেতৃত্বাধীন সংগঠনের নেতা-কর্মীর সাথে। নাটকীয়ভাবে তারা দাবী উত্থাপন করলো কওমী মাদ্রাসা সমূহের একটি ডিগ্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার্স ডিগ্রীর সমতুল্য বলে ঘোষণা দিতে হবে। তা তৎক্ষনাৎ এবং মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে ঘোষণা দেওয়া হলো। দুই দিনের মধ্যে পহেলা বৈশাখের ছুটি, শুক্রবারের ছুটি সত্বেও ঐদিন গেজেট আকারে তা প্রকাশও করা হলো। সেক্যুলার শিক্ষার বুকে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া হলো। আজ আর সাধারণ স্কুল-কলেজের স্বকীয়তা থাকলো না সবই যেন মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক্ষের সাথে আলোচনা করা হলো না-মন্ত্রিসভাতেও আলোচিত হলো না-সংসদেও পেশ করা হলো না।
ঐ একই বৈঠকে তারা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে “গ্রীক দেবীর মূর্তি”অপসারণের দাবী তোলার সাথে সাথে তা স্বীকার করে নিয়ে বলা হলো অতিশীঘ্র এ ব্যাপারে প্রধান বিচারকের সাথে আলাপ করা হবে। সে পালাও শেষ। সিদ্ধান্তটি সুষ্পষ্টভাবে জানতে পারি নি। তবে এটুকু জানি ওটা কোন গ্রীক দেবীর মূর্তি নয়-বরং বাঙালি নারীর অবয়বে নির্মিত একটি ভাস্কর্য্য ন্যায় বিচারের প্রতীকী একটি স্মারক। এর অপসারণ অযৌক্তিকই হবে না-তা হবে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির উপর এক নগ্ন আঘাত। ওদের দাবীতেই দলীয় শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখে বের করে নি আওয়ামী লীগ।
আর কত পিছু হটবে মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ?

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!