শৃংঙ্খলিত শৈশব

 

শৃংঙ্খলিত শৈশব
———————- শামীম হাসান

মা নাছোরবান্দা। ডাকাডাকি করছে তো করছেই। অগ্যতা মাহিরকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই হল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম যাচ্ছে না। মা ওকে টানতে টানতে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমের কাজ সেরে হালকা কিছু মুখে দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হল। তারপর একগাদা বই পিঠে চাপিয়ে মায়ের সাথে স্কুলের পথে রওয়ানা হল। সে এবার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। এবার তাকে বোর্ড পরীক্ষা মানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিতে হবে। তাই এ বছর নাকি তাকে পড়াশুনায় খুব সিরিয়াস হতে হবে। এত তাড়াতাড়ি করলো, তারপরও স্কুলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে গেল। এসেম্বলী ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তাকে এসেম্বলীতে অংশগ্রহণ করতে দিল না। এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। দেরীতে আসার জন্য এটা তার শাস্তি। বন্ধুদের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে তার খুব লজ্জা করতে লাগলো।

আধা ঘন্টার টিফিন বিরতি বাদে একটানা আটটি ক্লাশ করার পর ক্লান্ত অবসন্ন দেহে দুপুরে মাহির বাসায় ফিরলো। বেশিক্ষন আরাম করা যাবে না। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। কারন যোহরের নামাজের পর হুজুর আরবী পড়াতে আসবে। হুজুর যাওয়ার পর প্রায় দুই ঘন্টা সে স্বাধীন। এ সময়টাই মাহিরের সবচেয়ে আনন্দের সময়। মাও এ সময়টা ঘুমিয়ে পড়ে। সে ইচ্ছামতো টিভিতে কার্টুন দেখতে পারে। কম্পিউটারে গেম খেলতে পারে। বিকেলে আবার কোচিং এ যেতে হবে। কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটা বেজে যায়। একটু বসতে না বসতে আবার হাউস টিউটর চলে আসে। সে অংক ও ইংরেজী পড়ায়। বাবা বলেছে অংক-ইংরেজীতে ভাল না করলে কোন মূল্য নেই। হাউজ টিউটর যাওয়ার পর রাতের খাবারের আগে বা পরে মা তাকে নিয়ে বসবে। সারাদিনের পড়া ঠিকমত হয়েছে কি না তা সে নিশ্চিত করবে। মা বলে, গোল্ডেন জিপিএ পেতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

দশ-এগারো বছরের একজন শিশুর দৈনন্দিন হালচিত্র এটা। একগাদা বইয়ের চাপ, পড়াশুনার চাপ, সময় মেইনটেইন করার চাপ, বাবা-মা’র প্রত্যাশার চাপ। তার চারদিকে শুধু চাপ আর চাপ। একজন পূর্নবয়স্ক কর্মজীবি মানুষের চেয়েও সে বেশী ব্যস্ত। শিশু সুলভ নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া বা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ নেই তার। তার প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয় রুটিনের চক্রে। এ তো গেল স্কুল পড়–য়া শিশুর কথা। চারপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখুন। কত শিশু-কিশোর প্রতিদিন কিভাবে দিন অতিবাহিত করছে। কেউ কল-কারখানায়, কেউ গার্মেন্টসে, কেউ লেদ মেশিন-গ্রীল কারখানা, ঝি-চাকর, কেউবা দিনমজুর। তাদের শৈশব এখনো কাটেনি অথচ তারা এক একজন পূর্নবয়স্ক মানুষ। কখন-কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের দিনের প্রথম প্রহরের হাসিমাখা সকাল, সোনালী বিকেল, রোদেলা নিঃশব্দ দুপুর, তা তারা টেরই পাচ্ছে না। তাদের শৈশব তো শৃংঙ্খলিত, কারারুদ্ধ।

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল, উদার হতে ভাইরে।

কর্মী হওয়ার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে ………………..,

চাঁদ আমায় শেখায় …………….,

এই কবিতাটি হয়তো বড়দের অনেকেরই মনে আছে। আমরা সুকৌশলে এই কবিতাটি লুকিয়ে রেখেছি। কারন আমরা আমাদের শিশুদের ঔই কবিতার পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। শিশুরা শুধু পাঠ্যবই নয়, প্রকৃত শিক্ষা তো পায় পরিবেশ থেকেই। আকাশ থেকে উদারতার শিক্ষা কিভাবে নিবে, আজকের শিশুদের বিশেষ করে ঢাকা শহরের শিশুদের আকাশ তো মাত্র কয়েক বর্গমিটার বা বড়জোড় কয়েক বর্গকিলোমিটার। তার তো আকাশই দেখা হয় না। বাযুর কাছ থেকে মন্ত্র শুনার সময় কোথায় তার? সে তো ব্যস্ত। চাঁদের হাসিমাখা মুখ দেখে হাসতে শিখবে সে সময় কোথায়? সে তো তখন ক্লান্ত। একটি গাছের চারার উপর ইট চাপা বা ঢাকনা দিলে তা কিছুদিনের মধ্যে সাদা লিকলিকে দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি খোলা-মেলা পরিবেশে বড় হওয়া গাছ কেমন সবুজ সতেজ হয়ে উঠে। আমরা তো আমাদের শিশুদের বিভিন্ন অদৃশ্য চাপে চাপা দিয়ে রেখেছি। তারা সবুজ সতেজ হবে কিভাবে?

শহরের স্কুলে নেই খেলার মাঠ। থাকলেও নাম মাত্র। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে একটা বিল্ডিংই হচ্ছে তার শিক্ষাঙ্গন। অথচ চিরায়ত দৃশ্য হচ্ছে স্কুলের সামনেই বিশাল খেলার মাঠ। খেলার মাঠে বিভিন্ন পরিবার থেকে ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা শিশু-কিশোরদের সম্মিলন ঘটে। এতে পরস্পরের পারিবারিক সংস্কৃতি চেনা-জানা হয়। বন্ধন হয় বন্ধুত্বের। পরস্পরকে জানার বা বুঝার ফলে তারা পারস্পারিক সহযোগিতা, সমঝোতা, সহমর্মিতা শেখে। অন্যের সাথে মিলে-মিশে বড় ৃহওয়ার কারনে অন্যের দুঃখ বুঝে। অন্যের দুঃখ লাঘবে এগিয়ে আসার মানসিকতার জন্ম হয়। ত্যাগের শিক্ষা শিখে। প্রাপ্তিতে শুধু নয় ত্যাগেও যে সুখ আছে তা জানতে শিখে। আসলে একজন শিশুর শিক্ষাস্থান শুধু বিদ্যালয় বা পরিবার নয়। পরিবেশও তার শিক্ষার উপযুক্ত স্থান। পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষাই একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তুলে। কিন্তু বর্তমানে শিশুর জন্য সে পরিবেশ কোথায়? খেলার মাঠ যদিও বা কারো ভাগ্যে জোটে, তার খেলার সময় কোথায়? নিরাপত্তা কোথায়?

বর্তমানে একজন শিশু একটু বুদ্ধি হওয়ার পরই দেখে চারিদিকে শুধু প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই স্কুলে ভর্তিযুদ্ধ নামক যুদ্ধে অংশগ্রহন করে তার মতই কোমলমতি অন্য শিশুকে পরাজিত করে যুদ্ধ জয়ের নিষ্ঠুর আনন্দের স্বাদ নিতে হয়। আর পরাজিত শিশু পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে জীবনের শুরুতেই হোঁচট খায়। দেখে দুনিয়াটা কত নিমর্ম। আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তার বয়সের চেয়েও দ্বিগুন বইয়ের ভারে সে পিষ্ঠ হতে থাকে। কয় বছর যেতে না যেতেই শুরু হয় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা নামের মহাযুদ্ধ। এ মহাযুদ্ধ তো প্রতিটি শিশুর জন্য একটা আতঙ্ক।

একজন শিশুর বিকাশের জন্য, মানুষ হওয়ার জন্য কি এতো বইয়ের প্রয়োজন? প্রয়োজন থাকলেই কি এত চাপ নেয়ার ক্ষমতা তার হয়েছে? এত অল্প বয়সেই কি এত বিশাল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মানসিকতা রয়েছে? চতুর্মূখী চাপে বা বড়দের প্রত্যাশার চাপে তার মনোজগৎ কি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না? তারা কি হারিয়ে ফেলছে না তাদের শিশুসুলভ স্বকীয়তা? বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কি বাস্তবমূখী? আশা করি এসব প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান দিবেন মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

শিশুরা নিজেরাই এক একটা সুন্দর প্রকৃতি। সময় পেলেই তাদেরকে প্রকৃতির কাছে বেড়াতে নিয়ে যান। খেলাধুলার করার ব্যবস্থা করুন। তাদেরকে সময় ও সঙ্গ দিন। প্রত্যাশার চাপ না দিয়ে স্বপ্নের বীজ বপন করুন। মুক্তভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিন। তা হলেই দেখবেন সতেজ, সবল এবং প্রকৃত শিক্ষিত একজন মানুষের জন্ম হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!