ডোনাল্ড ট্রাম্প: সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিশ্বায়ন

ডোনাল্ড ট্রাম্প: সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিশ্বায়ন
সিডনীর কথামালা:৭০
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mil:raneshmaitra@gmail.com

ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে আমেরিকার বিতর্কিত নির্বাচনে ২০১৬ সালের শেষ দিকে নির্বাচিত হয়ে মাত্র ২০ জানুয়ারী, ২০১৭ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নির্বাচনী নির্বাচনী প্রচারণার মূলকথা ছিলঃ “We well make American great again” যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো “আমরা আমেরিকাকে আবারও মহান দেশ বানাবো।

এই মহান দেশটির মহত্ব কেমন হবে সংক্ষেপে তাও তিনি বলেছিলেন, তিনি মুসলিম শরনার্থীদেরকে আমেরিকায় প্রবেশাধিক্যর দেবেন না। তিনি কৃষাঙ্গদের ঠাঁই দেবেন না। তদুপরি তিনি নারীদের অবমাননা সূচক বক্তব্যও প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে বলতে দ্বিধা করেন নি।

এক কথায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে স্বপ্ন মার্কিনীদেরকে দেখালেন তার অর্থ সেই দেশ থেকে বহুত্ববাদের অবসান অর্থাৎ সাদাদের জন্যই আমেরিকা এবং আপ্রকাশ্যে বলা হলো দেশটি হবে শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টানদের। নারীর অমর্য্যাদার পথেও আমেরিকাকে তাঁর স্বপ্ন অনুযায়ী মহান বানানোর কল্পচিত্র।

অথচ গোটা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয়ে যায় ট্রাম্প-বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ মিছিল-সভা-সমাবেশ নির্বাচনের পূর্ব থেকেই। যখনই তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে নেমে পড়েন তখন থেকেই। বিশেষ করে নারীদের মিছিল তাঁদের বহন করা ব্যানার-প্ল্যাকার্ডগুলির ভাষা।

এমন কি, একের পর এক যুবতী নারী মিডিয়ার সামনে এসে জানাতে থাকলেন ট্রাম্পের নৈতিক চরিত্রহীনতার কথা-তাঁদেরকে নানা মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার কথা। এ কথাও প্রচারিত হলো ট্যাম্পের পত্নী বিয়ের আগে ছিলেন একজন দেহব্যবসায়ী। ট্রাম্প পত্নীর নগ্ন বা অর্ধনগ্নাদেহের ছবিও আসতে লাগলো সেখানকার পত্র পত্রিকায়-টিভি ও অপরাপর প্রচার মাধ্যমে দেখা গেল।

এ ছাড়া, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় সর্বাধিক প্রাধান্য পায় মুসলিম-বিরোধী ও কালো আদমী বিরোধী বক্তব্য। তিনি সকল সমালোচনার মুখেও তাঁর প্রচারণাতে এই বিষয়গুলিকে শেষ দিন পর্য্যন্তও প্রাধান্য যা মার্কিনী নির্বাচনী প্রচারণার অতীতে এক বারের জন্যও ঘটেছে বলে জানা যায় নি।

এ ছাড়াও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর প্রচারণায় বিদ্যমান বৈষম্যকে তীব্রতর করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিব্যি দিয়ে যেতে লাগলেন। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের বিজ্ঞ-মাতব্বর মার্কিন মুল্লুকে ধনী-গরীবের অত্যন্ত তীব্র। তিনি যে যে অর্থনৈতিক দাওয়াই-বাতলালেন-তাতে ঐ বৈষম্য আরও তীব্রতর হবে। যেমন শ্রমিকদের মজুরী হ্রাস, পণ্য মূল্য বৃদ্ধি, গরীবের চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি, বেতন-বৈষম্য বৃদ্ধি প্রভৃতি।

এই সব কিছু মিলিয়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচার অভিযান যে কোন বিশ্লেষনেই ছিলো উগ্র সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী, বঙ্গত্ববাদ-বিরোধী এবং সামগ্রিক অর্থে জনস্বার্থ বিরোধী। এতৎ সত্বেও নির্দ্বিধায় এমন আপত্তিকর ধরণের নির্বাচনী প্রচার অভিযান বিপুল অর্থব্যয় করে সমগ্র আমেরিকা জুড়ে অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যেতে লাগলেন ট্যাম্প ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা।

তখন থেকেই ভাবছিলাম, এমন ধরণের কদর্য্য প্রচারণা কিভাবে সে দেশের নির্বাচন পরিচালনা কর্তৃপক্ষ (নির্বাচন কমিশন বা এ জাতীয় সংস্থা) চালাতে দিলেন। যতদূর জানি বা বুঝি তাতে ডোনাল্ড ট্যাম্পের ঐ নির্বাচনী প্রচারের বক্তব্যগুলি যেহেতু নানাবিধ বৈষম্যের অনুকূলে সে কারণে তা সে দেশের সহবিধান ও মানবধিকার বিরোধীও। তাঁর প্রার্থীপদ বহাল থাকার কথা নয় বলেও মনে হতো।

এতৎ সত্ত্বেও কোন আইনগত হস্তক্ষেপ বা হুঁশিয়ারী, মানবধিকার সংগঠনগুলির কোন বক্তব্য এ বিষয়ে আমার চোখে পড়ে নি। এগুলি তো আমাদের দেশেও সংবিধান এবং নির্বাচন কমিশিন প্রকাশিত নির্বাচনী প্রচারের নীতিমালা বিরোধী ডোনাল্ড ট্রাম্প দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দিতা করেই রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন নিয়েছিলেন। ঐ দলের তখন তিনি ব্যাপক সমর্থনও পেয়েছিলেন যদিও নির্বাচনে নামার আগে তিনি রিপাবলিকান দলের বা ঐ দেশের কোন রাজনৈতক দলেরই প্রাথমিক সদস্য ছিলেন না। তিনি শ্রেফ একজন ব্যবসায়ী এবং বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের মালিক।

কিন্তু যখন নির্বাচনী প্রচারণা তিনি চালাতে লাগলেন তখন দেখা গেল রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরেও তাঁর বক্তব্যের তীব্র বিরোধীতা কারও কারও মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল। রিপাবলিকান পার্টি অনেকটা বিভক্তও হয়ে পড়েছিল বলে খবর বেরিয়েছিল। সব মিলিয়ে ধারণা করা যাচ্ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী বৈতরণী শেষ পর্য্যন্ত হয়তো পার হতে পারবেন না।

কিন্তু সে ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে শেষ পর্য্যন্ত আমেরিকার নির্বাচনী পদ্ধতির সুবাদে poplar vote (জনগণের ভোট) দু‘লক্ষাধিক কম পেয়েও নির্বাচিত হলেন-এক বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করলেন। বিগত ২০ জানুযারী (আমেরিকার রেওয়াজ হলো ২০ জানুয়ারীতেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে), ২০১৭ তারিখে ডোনাল্ড ট্রাম্প তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে বিশাল আয়োজনে নজিরবিহীন পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র প্রহরাধীনে শপথও গ্রহণ করলেন।

শপথ গ্রহনকালেও বিশ্বব্যাপী-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষের বিক্ষোভ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নির্বাচনোত্তর শপথ অনুষ্ঠান এক অভূত পূর্ব অনুষ্ঠানেই পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সব কিছু দেখে এবং জেনেশুনেও যথারীতি আমেরিকার সংবিধান সংরক্ষণ, দেশটির বহু-সংস্কৃতির চরিত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বর্ণবৈষম্য বিরোধী ভূমিকা মেনে চলার শপথও নিলেন শপথ নিলেন সার্বিক নিরপেক্ষতারও।

বিশ্বব্যাপী আমরা যারা বামপন্থী সার্কসীয় আদর্শের অনুসারী এবং যাঁরাই অপরের প্রভূত্ব ও চাপমুক্ত স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশ এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিষ্ঠাবান – তারা সবাই আমেরিকান সরকারের প্রকৃতি রূপ সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং ঐ দেশটির শাসকদের ভূমিকা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে মোহমুক্ত। সবাই জানি মার্কিন পুঁজিবাদী সরকার পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল এবং নিজেদের স্বার্থে এই মোড়লগিরি রক্ষায় গণন্ত্রের নামে পৃথিবীর সর্বত্র তাদের আধিপত্য ও শোষণ বজায় রাখার স্বার্থে যে কোন হীন কাজ করতে তারা অভ্যন্ত। তাদের প্রকৃত চেহারা বাঙালীদের কাছেও স্পষ্ট হয়। ৭১ সালে।

অতীতের শাসকদের, ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে ট্রাম্পের এই সামান্য সময় কালের শাসন তার চাইতে বহুশুনে জঘন্য এবং বর্বর, মনুষ্যত্ব, মানবতা ও গণতন্ত্র বিরোধী এক শাসক-চরিত্র তিনি তুলে ধরে জনমনে একটি প্রশ্ন জাগ্রত। করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রশ্নটি হলো আমেরিকা কি তাহলে সত্যই একটি সভ্য দেশ?

জানি, এ প্রশ্নটির উত্তর নানাজন নানাভাবে দেবেন বা না দিলেও নানাভাবে ভাববেন। কারণ আমরা কেই পছন্দ করি বা না করি, আমেরিকা নামক দেশটির ভক্তও পৃথিবীজোড়া কম নয় বরং সম্ভবত: সংখ্যায় বিপরীত চিন্তার মানুষদের চাইতে অনেক বেশী এবং তার অনেকগুলি কারণও আছে।
আমি এটুকু মানি, বিজ্ঞানের বহু সাখার আমেরিকান বৈজ্ঞানিকদের বিপুল অবদান রয়েছে এবং তার সুবিধাও বিশ্বব্যাপী মতাদর্শ নির্বিশেষে সকল মানুষ ভোগ করছেন। তেমনি আবার এ কথাও সত্য,তাবৎ বৈজ্ঞানিক অবদানকেই মার্কিন শাসকগোষ্ঠী ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করতে আদৌ দ্বিধাবোধ করেন নি।

এবারে আসি শপথোত্তর ট্রাম্পের তিন সপ্তাহের ভূমিকা প্রসঙ্গে।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল-ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচন পূর্বকালে তাঁর দীর্ঘ ও ব্যস্ততম প্রচারাভিযানে যা যা প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন-এখনও পর্য্যন্ত তিনি সেগুলি থেকে বিচ্যুত হন নি বরং এই স্বল্প সময় কালে গৃহীত তাঁর পদক্ষেপ সমূহ দ্বারা তিনি তাঁরা প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষার লক্ষনই ফুটিয়ে তুলেছেন।

যেমন প্রথমেই নির্বাহী আদেশে তিনি বাতিল করলেন তাঁর পূর্বসূরীর জারীকৃত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি জনকল্যাণ মূলক ব্যবস্থা-যার নাম বারাক ও বামা। এই পদক্ষেপের ফলে আমেরিকার দরিদ্র মুনুষগুলির সন্তানদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাবে।

অত:পর তিনি অপর একটি নির্বাহী আদেশে পৃথিবীর সাতটি মুসলিম দেশের অভিবাসীদের আমেরিকায় হমিপ্রেশন স্থগিত করলেন ঢালাওভাবে। সঙ্গে সঙ্গে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণপ্রতিবাদ অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই উত্থিত হতে থাকলো। কারণ স্পষ্টত:তাঁর আদেশে যদিও সাম্প্রদায়িকতার উল্লেখ নেই তবুও কার্য্যত: এটা যে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক পদক্ষে তা অত্যন্ত স্পষ্ট।

এ বিষয়টি আমেরিকার সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তা প্রত্যাহার করা উচিত এমন বক্তব্য রক্ষার সাথে সাথে তিনি এটর্নী জেনারেলকে বরখাস্ত করে তাঁর মতের সাথে মিল সম্পনান বশংবদ এক নতুরন এটর্নী জেনারেল নিয়োগ দিয়ে তাঁর ক্ষমতার জোর দেখালেন।

অপরদিকে, নানা রাজ্য থেকে উচ্চ আদালতে ঐ সাত দেশের অভিবাসী আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মোকর্দমা দায়ের হলে একাধিক রাজ্যের হাই কোর্ট ঐ নির্বাহী আদেশ স্থগিত ঘোষণা করায় সমগ্র আমেরিকা ব্যাপী স্থগিত আদেশ জারী হয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবারে প্রকাশ্যে বিচারকদেরকে আক্রমণ করতে দ্বিধা না করে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করলেন। আমেরিকান ফেডারেল কোর্ট কয়েকদিন ব্যাপী উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনার পর সরাসরি প্রশ্ন উত্থাপন করে বসলেন, “এই আদেশ কি মুসলমানদের বিরুদ্ধে?” প্রশ্নটি বিশদভাবে বিবেচনার পর প্রদত্ত আদেশে ফেডারেল কোর্টের বিচারক মন্ডলী নিম্ন আদালতগুলির প্রদত্ত আদেশকেই বহাল রেখে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশকে স্থগিত ঘোষণা করেছেন। ফলে সকল দেশের অভিবাসীরাই আমেরিকায় পূর্বের মতই প্রবেশাধিকার ফিরে পেলেন।

কিন্তু ট্রাম্প একদিকে যেমন বলে ফেলেছেন বিচারকেরা তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গীকেই তাঁদের রায়ের মাধ্যমেতুলে ধরেছেন অপরদিকে আমেরিকার ভিসা ও নাগরিকত্বলাভ সংক্রান্ত আইন কঠিণতর করার প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়ে ভিন্ন পন্থায় তাঁর রাজনৈতিক ও উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ ঘটানোর প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছেন।

তাঁর মুসলিম-বিরোধী মনোভাব দেখে যাঁরা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যের পুলকিত বোধ করে আসছিলেন তাঁদের নিজ নিজ দেশের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে হয় ধর্ম বিশ্বাসের অজুহাতে নয়তো গাত্র বর্ণ কালো-এই অজুহাতে আমেরিকার অভিবাসী হওয়ার সুযোগ যে হারাতে চলেছে তা তলিয়ে দেখেছেন কি না জানি না।

তবে ট্রাম্প সত্যই সফল সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বায়ন ঘটাতে – সারা পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িক উগ্রতাকে তীব্রতর করে তুলতে। কিন্তু তাতে তাঁরা প্রতি……


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব কাগজ২৪এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!