উজ্জ্বল, অমলিন, প্রাণোচ্ছল বিজয় দিবসের অপেক্ষায়

সিডনীর কথামালা-৫৭

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)

সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

E-mail:raneshmaitra@gmail.com

 

৪৫টি বিজয় দিবস পোরিয়ে আমরা আমাদের স্বপ্নের, আমাদের কল্পনার , আমাদের লড়াই-সংগ্রমের, উত্থান-পতনের মাধমে অর্জিত বিজয় দিবসের ৪৬ তম বছরে পদার্পনের শুভ লগ্নে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত মিলিয়ে হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। প্রশ্নের জবাব খুঁজছি। হৃদয়-মথিত. বহুজনের ব্যথায় ব্যথিতচিত্ত, আঘাত-তাড়িত মলের বেদনার্ত সেই প্রশ্ন। সেই পুরাতন প্রশ্ন।
স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে (নিশ্চয়ই অনেকের মতই) মনে প্রশ্নগুলি যেন বারংবার আছড়ে বেড়াচ্ছে। এ এক নিরন্তর প্রশ্নোর এবং উত্তরহন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি যেন।
সবাই বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল নায় মাস ধরে। ১৯৭১ এর নয় মাস। শুরু হয়েছিল ঐ বছরের ২৬ মার্চে-আর শেষ হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
হ্যাঁ, ঐ নয়মাস বাঙালি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিল-অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান বাধ্য করেছিল অস্ত্র হাতে তুলে নিতে। তারা সুদীর্ঘ নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের চূড়ান্ত নির্বাচনী ফলাফল (১৯৭০) মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর – তথা বাঙালির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৬ মার্চের আগেই-বলা চলে ৭ মার্চেরও আগে থেকে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতিকে গোটা পূর্ব-বাংলা জুড়ে সাধারণ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে-পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেই দলই গঠন করবে। ঐ নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের সামরিক সরকার নিদ্বির্ধায় মেনে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে শান্তিপূর্ণভাবে।
সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো-তাতে অংশ নিলো আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী মোজাফ্ফর), পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য কতিপয় ছোট ছোট দল।
সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধনি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টের মোট আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। ফলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ববাংলার প্রাদেশিক সরকার গঠনের বৈধ অধিকার অর্জন করলো আওয়ামী লীগ। এছাড়া, একই ভাবে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পার্লামেন্টও প্রাদেশিক আসনে সর্বাধিক সংখ্যা আসনে জয়ী হয়ে সরকার (নিজ নিজ প্রাদেশে) গঠনের অধিকার অর্জন করলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে বিজয়ী হলো জুলফিকার আলী ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি।
কিন্তু বগুড়া দিলো ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি। নির্বাচনী ফলাফলে তারা পার্লামেন্টে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হওয়াতে তাদেরই প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পার্লামেন্টে আসন গ্রহণের কথা থাকলেও তারা দাবী করলো ক্ষমতার আশীদার করতে হবে নতুবা নির্বাচনী ফলাফল তারা মেনে নেবে না। সামরিক বাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকলো ভুট্টোর প্রতি।
অপর পক্ষে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (যারা বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে বিপুল সংখ্যক পার্লামেন্টারী ও প্রাদেশীক আসনে বিজয়ী হয়েছিল) পূর্ণ সমর্থন জানালো আওয়ামী লীগের প্রতি। ফলে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে তিনটি প্রদেশেরে নির্বাচিত এম.পি.রাই বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা এককভাবে হস্তান্তরের দাবী জানলেন-সমর্থন দিলে।
এতৎ সত্ত্বেও পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকেও একতরফাভাবে তা বাতিল করে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করা হয় ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে। ফলে ফুঁসে ওঠে জনগণ।
ইয়াহিয়া প্রস্তাবে সম্মতি হন বঙ্গবন্ধু আলাপ-আলোচনায়। ঢাকাতে বৈঠকে যোগ দেন ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধু, অধ্যাপক মোজাফ্ফর এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভুট্টো ও ওয়ালী খান প্রমুখ। ভুট্টো নাছোড়বান্দা ক্ষমতার অংশীদারীত্বের ব্যাপারে।
এই অচলাবস্থা সৃষ্টির পেছনে সেনাবাহিনী। তারা সংলাপের নামে সময় পেয়ে পূর্ববাংলার সামনে সৈন্য, সমরাস্ত্র প্রভৃতি পাঠাতে থাকে এবং ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ও পীলখানায় তদানীন্তন ই.পি. আর (বর্তমান বিজিবি) হেডকোয়ার্টারে বোমা ও শেলনিক্ষেপ করে। আতর্কিতে বহু প্রাণ ঝরিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার ফলে বাঙালী তরুণ-তরুণীরা প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়ে।
প্রতিরোধ যুদ্ধে পাবনা সহ বহু জেলার বাঙালীর অসাধারণ বিজয় অর্জন, আকাশ-বানী, বিবিসি সহ আর্ন্তাতিক গণমাধ্যমগুলির বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে (সচিত্র), ২৬ মার্চে গ্রেফতারের পূর্বমুহুর্তে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দ্বিতীয় দফা স্বাধীনতা ঘোষণা (প্রথম দফা ৭ মার্চের ভাষনেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন)- ইত্যাদি মিলিয়ে তরুণেরা সশস্ত্র-যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপাতির সন্ধানে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিতে সুরু করেন।
অপরদিকে পাক-বাহিনী বাঙালি নির্য্যাতন সুরু করে ভয়াবহভাবে। বিশেষ করে ধর্মীয় হয়ে ওঠে। এ কাজে তাদের মূল সহযোগির ভূমিকায় ছিল শান্তি মমিটি ও রাজাকার বাহিনী যা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ইসলাম-পন্থী দলের সহায়তা।
পরিণতি দাঁড়ালো প্রায় এক কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (মূলত: হিন্দু সম্প্রদায়ের) মানুষদের বাধ্যতামূলক দেশত্যাগ। চাপ পড়লো ভারত সরকারের উপর তাদের আশ্রয়, আহার প্রভৃতির ব্যবস্থায়।
প্রায় তিন লক্ষ যুবক-যুবতী ও দেশত্যাগী করলো-আশ্রয় নিল ভারতে। তাদের দাবী তারা অস্ত্র চায়-প্রশিক্ষণ চায়। দেশে গিয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করতে চায়।
ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক ইন্দিরাগান্ধীর সুদক্ষ পরিচালনাধীন ভারত সরকার অত্যন্ত মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ নতন মাত্রা অর্জন করে। বাঙালি জাতির মনে গভীর আত্মবিশ্বাসেরও সৃষ্টি হয়।
আত্মবিশ্বাস অনেকাংশে বহু আগেই সমগ্র বাঙালি জাতীর মনে সৃষ্টি হয়েছিলো। পাকিস্তান তার বিষাক্ত দ্বিজাতিতত্বের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে জন্ম নিলেও বাঙালি শীঘ্রই তা প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করে ১৯৪৮ ও বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। পৃথক নির্বাচন প্রথা সংবিধানে এসে ঐ শাসক চক্র সাম্প্রদায়িকতাকে স্থায়ীরূপ দিতে চাইলেও বাঙালি আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করে।
অত:পর জেল, জুলুম , হাজারো নির্য্যাতনেরও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালির মনোবল ভাঙতে পারে নি বরং ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীর মনোবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে-তেমনি জতীয় ঐক্য হয়েছে মজবুত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সেই ঐক্যকে এক অপরাজেয় উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছিল।
একাত্তরের মার্চ-এপ্রিল-মেতে যেভাবে সংখ্যালঘু বিতাড়ন করা হয়-সেদিনের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা খালি হাতে প্রতিরোধ করতে পারেন নি বটে কিন্তু দেশত্যাগের সময়ে হিন্দুদের তো হাঁটাপথে দিনের পর দিন চলতে হয়েছে। সেই অবস্থায় রাতের আশ্রয় মুসলিমরাই দিয়েছেন, পাথ চিনিয়ে তাঁরাই দিয়েছেন-কোলের শিশুর জন্য বিনামূল্যে দুধ তাঁরাই সরবরাহ করেছেন এভাবে তাঁদের সহযোগিতা না পেলে সীমান্ত পর্য্যন্ত পৌঁছানো আদৌ হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব হতো না। তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না।
অত:পর মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো ১৬ ডিসেম্বর গোধুলি লগ্নে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ এর ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর পরিচালনাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ বাহাত্তরের সংবিধান বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার (কার্য্যত সর্ব সম্মতিক্রমে) অনুমোদনের মধ্য দিয়ে। ঐ সংবিধানে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত থাকলো বাংলাদেশের চার মৌলনীতির কথা যেমন-গণতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
এই পর্বে এসে বাঙালি জাতির মনে গভীর আশাবাদের সৃষ্টি হয় এই মর্মে যে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন, নিয়মতানন্ত্রিক লড়াই, জেল-জুলুম, এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ত্যাগ, ৩০ লক্ষ বাঙালীর অকাতরে আত্মদান এবং ঐতিহাসিক বিজয় ও বিশ্বের ইতিহাস ক্যাত বাহাত্তরের সংবিধান প্রনয়ন ও চার মৌলনীতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চা ও তার বিকাশ ঘটিয়ে যেতে থাকবে, একটি প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে, দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল হবে এবং আইনের শাসন যথার্থই প্রতিফলিত হবে-আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষ সমান বলে যথার্থই বিবেচিত হবে। যেমনটি লেখা ছিল ঐ সংবিধানে।
এই ধারণার বসবর্তী হয়ে যেন এক ধরণের আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে শুরু করেন দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সামরিক শক্তিগুলি। ধারণা জন্মালো বাংলাদেশের এই মৌলিক চরিত্রের বদল ঘটবে না আর কখনও।
কিন্তু ১৫ আগষ্ট্রে নির্মম হত্যালীলা, জিয়াউর রহমানের বে-আইনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” আমদানী সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে “ সামাজিক ন্যায় বিচার সংযোজন” এবং সব শেষে স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” সংবিধানে স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুতগতি অর্জন করে।
জিয়া-এরশাদের সাময়িক শাসন এবং সামরিক একনায়কত্ব-বিরোধী সুদীর্ঘ আন্দোলনে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক ও বাম শক্তিগুলি জনগণের কাছে পুনরায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে সামরিক স্বৈরাচারীদের পতন ঘটিয়ে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় এলে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুন: স্থাপন করা হবে-জিয়ার “বিসমিল্লহ” “জামায়াত ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি বৈধকরণ” এবং এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটলো-নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে পাঁচ বছর পর পর কিন্তু সংবিধান? জিয়া এরশাদের অবৈধ সংশোধনী? যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌল চরিত্র উধাও হলো-তার ব্যাপারে আর কোন হদিস নেই।
বছর পাঁচেক আগে একটি রীটের নিষ্পত্তি কালে সুপ্রিম কোর্টে রায় দিল জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ এবং সংবিধান-বিরোধী তাই জিয়ার মৃত্যু ঘটে থাকলেও এরশাদের এ কারণে রাষ্ট্রদ্রোহীতার উল্লেখ করা হলো ১৯৭২ এর সংবিধানই বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সংবিধান তাই জিয়ার পঞ্চদশ ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই“বিসমিল্লাহ” প্রবর্তন, জামায়াত ও ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধকরণ এবং এরশাদের রাষ্ট্রধার্ম বে-আইনী ও সংবিধান বিরোধী।
এই রায় ঐতিহাসিক। বাহবা পেলো সুধীজনদের কাছে। কিন্তু মূল যে রাজনৈতিক নৈতিক দল ৭২ এর সংবিধান অবিকৃত রাখতে ও পঞ্চম-অষ্টম সংশোধনী বাতিল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল তারা কিন্তু যে প্রতিশ্রুতির ধারে কাছেও আর থাকলেন না। তড়িঘড়ি করে তাঁরা সংসদ অধিবেশনে বসে সংবিধানের কুখ্যাত পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করলেন “বিসমিল্লাহ” “জামায়াত ও ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকে বৈধতা প্রদান ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে ২০১২ সালে।
বঙ্গবন্ধুর সংবিধান উধাও হলো-জিয়া এরশাদের অবৈধ ঘোষিত আদর্শ দিব্যি বহাল তবিয়েতে পুন: স্থাপিত হলো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দলটির দ্বারাই। পাকিস্তানীরকরণ প্রক্রিয়াও পাকপোক্ত হলো।
সংবিধানের এই সংশোধনী দ্বারা প্রতিক্রিয়া মুখীনতা, পশ্চাৎমুখীনতা, রাজনীতির পাকিস্তানী করণে নিশ্চয়তা বিধান করলো-সকল প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি যাদের উত্থান নব উদ্যমে ঘটতে শুরু করেছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধু হত্যালীলার মাধ্যমে জিয়ার পঞ্চম এরশাদের অষ্ট সংশোধনীর মাধ্যমে ।
১৯৯১ তে জামায়াতের হাত ধরে বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষমতারোহন, পরবর্তীতে জামায়তের সাথে হাত মিলিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের পাঁচ দফা চুক্তি এবম্বিধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানীকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতে থাকে। খালেদা জিয়া তাঁর পরবর্তী দফায় নিজামী দুইজামায়ত নেতাকে মন্ত্রীও বানালেন।
২০০১ সালের ভয়াবহ হাজার হাজার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা, ২০১২ থেকে আজ অবধি প্রতি বছর অসখ্য হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে চুরমার করা বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া অজ¯্র মূর্তি ভাঙচুর করা, হিন্দু বসকতি আক্রমণ, ফেইসবুকে ইসলাম বিরোধী পোষ্ট দেওয়ার মিথ্যা জিগির তুলে বৌদ্ধ মন্দির এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সহ হিন্দুদের মন্দির ও বাড়ীঘর রামুতে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া, পাবনার বনগ্রামে, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের চিরিবন্দর ইত্যাদি হয়ে ২০১৬ তে নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জে হিন্দু ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জমি জিরাত দখল করা পাহাড়ী আদিবাসীদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেও তার প্রধান ধারগুলি কার্য্যকর না করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর্য্যায় এনেছে। ঐ সহিংসতার দায়ে আজও কারও বিচার হয় নি।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হাজারে হাজারে নির্বিবাদে নিয়ত ঘটে চললেও দিব্যি বলা হচ্ছে “বাংলাদেশ সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশঃ এভাবে উপহাস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতে দেখা যায় না। কর্তা ব্যক্তিদেরকে।
পাকিস্তান আমলে এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ছিলেন মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগ, আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৫ বছর অতিক্রম কালে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ ভাগ। এই প্রক্রিয়ার অবমান ঘটানোর বিন্দুমাত্র রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই।
ফলে একাত্তরের বিজয় আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে যেন।
তাই স্বাধীনতার নতুন বিজয় আনতে মুক্তিযুদ্ধের নিরন্তর অগ্রগতি সাধন এবারের বিজয় দিবসে বিজয়ের মাসে এবং বারোমাস ৩৬৫ দিন ধরেই অবিরাম চালানোর প্রত্যয় ঘোষনার বিকল্প নেই।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোন অবস্থাতেই উপেক্ষনীয় নন। সেই আদর্শ সেই চেতনার অবলুপ্তি ঘটাতে যারাই সচেষ্ট ছিলেন, আছেন ও থাকবেন – তাদের সাথে বিন্দুমাত্র অক্টোবরের সামান্যতম জায়গা নেই।
বাঙালি জাতি সেই উজ্জ্বল, অমলিন, প্রাণোচ্ছল বিজয় দিবসের অপেক্ষায় তাকে ছিনিয়ে আনবার প্রতীক্ষায়।

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!