অ-মানব ও এক বিন্দু রহস্য ( চতুর্থ পর্ব )

অ-মানব ও এক বিন্দু রহস্য ( চতুর্থ পর্ব )
– সেলিনা জাহান প্রিয়া

দারগা মনে মনে ভাবছে মানুষটা কি যাদু জানে ? আমি এত বছর ধরে পুলিশে চাকুরী করে আসছি । কত চোর ডাকাত সন্ত্রাস উকিল কে সাইজ করেছি আর একটা পাগলের কাছে হেরে গেলে আমার দারগা গিরি করে কি লাভ ?
অ-মানব মনের সুখে সিগারেট টানছে । দুই পা নাড়াচ্ছে । কুকুর গুলো তার চার চার পাশে বসে আছে । অ-মানব বলল
—- দারগা সাব মানুষ আজ কাল চাহিদার গোলাম হয়ে গেছে । মানুষ কে যদি এই মহাকাশ দেয়া হয় তবে তার তৃষ্ণা শেষ হবে না। এই যে আপনি আজ ভাবছেন আপনার মেয়ে আমি কেন কথা বলছি । ঠিক কি না ? আমি জগতের অন্য কিছু না বলে আপনার মেয়ে নিয়ে কথা বলছি । কেন বলছি জানেন । আমারা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না। মা থাকতে মায়ের মর্ম , বাবা থাকতে বাবার মর্ম । একটা ছোট গল্প বলব দয়া করে কি শুনবেন ।।
—– কি গল্প তা শুনে আমার কি কোন লাভ হবে ?
—– দেখুন দারগা সাব আমাদের স্বভাব কি জানেন আমারা সব কিছুতেই লাভ খুজি । আর সব লাভ রেখে চলে যাই । শ্যালা কিছুই নিয়ে যেতে পারি না। কিন্তু গল্প টা আপনার জীবনের ।
—– আমার জীবনের গল্প । আপনি কি করে জানবেন ? আর আমার কোন গল্প নেই ।
—- যদি না শুনেন তবে গল্প টা বলব কি ভাবে ?
—- আচ্ছা বলেন । দারগা একটু ভাব নিয়ে বলল । আর মনে মনে বলে দেখি পাগলে কি বলে ?
—- অ-মানব বলতে লাগলো , দারগা সাব আপনার বাবা আপনাকে টাকার জন্য লেখা পড়া করাতে পারে নাই । সেই সময় আপনার মামার শ্যালক আপনাকে লেখা পড়া শিখাতে তার বাড়িতে নিয়ে যায় । তার কোন পুত্র ছিল না । তার দুই মেয়ে দুই জনেই কালো । আপনে তাঁদের বাড়িতে পাঁচ বছর ছিলেন ।
তার পর একদিন সেই লোক আপনাকে পুলিশের চাকুরী ব্যবস্তা করে দেয় । আপনি যখন জানলেন যে কোন এক বোন কে বিয়ে করতে হবে তার পর কিন্তু আপনি ঐ বাড়িতে আর কোন দিন যান নাই । এমন কি আজ পর্যন্ত যান নাই ।
আপনি কি মনে করেছেন আপনার মতো জামাই তারা পাবে না। তারা জামাই আপনার চেয়ে ভাল পেয়েছে । তারা এখন কিন্তু দুই বোন সরকারী স্কুলের মাস্টার । তাঁদের দুই বোনের এক মেয়ে রংপুর মেডিক্যালে কলেজে পড়ে ।
————- দারগা আপনি এত কিছু কি করে জানেন ? আসলে আপনি কে ?
————- বললাম তো আমি অ-মানব । কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে হলে সেই বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয় । জ্ঞান মানুষের সম্পদ । যা বিক্রি করলে শেষ হয় না। আর সব কিছু বিক্রি করলে শেষ হয়ে যায় । আপনি যদি কোন দেশ যুদ্ধ করে জয় করতে চান তাহলে সেই দেশের ইতিহাস মানচিত্র শিক্ষা ভাষা আর তাঁদের সত্রু মিত্র কে জানতে হবে । আমি তো আপনার সাথে একটা জুদ্ধেই নেমেছি । তবে তা মনোতান্ত্রিক যুদ্ধ ।
দারগা একে বারে চুপ হয়ে যায় অ-মানবের কথা শুনে । মনে মনে ভাবছে না তার পিছু লাগলে বরং আমার দেয়া কথা রাখতে হবে । নিজ মেয়ের ব্যাপার যদি মানুষ জানে তাহলে খুবেই খারাপ । আমার মান ইজ্জৎ চলে যাবে । বরং অন্য কিছু করি ।
এমন সময় অ-মানব দারগার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল স্যার আজ ভোর বেলায় তবারক খাওয়াবে ঐ যে বাউল জ্ঞান হচ্ছে ঐ খানে । আপনি তো আর ডিউটি রেখে যাবেন না। আর গ্রামের যে রাস্তা আপনাদের পুলিশের লক্কড় যক্কর গাড়ী যাবে না। গাড়ী গেলে আপনাকে দাওয়াত দিতাম । আসি স্যার আমার বিষয়টা চিন্তা করবেন । ঐ ছেলেটার জাবিন কিন্তু আসা করি ডিসেম্বর মাসের শেষে কোর্ট খুললে জাবিন হয়ে যাবে । আসি স্যার ।
দারগা চাতক পাখির মতো অ-মানবের কথা শুনে চুপ হয়ে গেল । রাতের ট্রেনের লাইট দেখা যাচ্ছে । অল্প সময়ে স্টেশনে আসবে , ট্রেনের লাইট অনেক দুর থেকে যায় । এখন কুয়াশা কম ।
কুকুর গুলো দিকে তাকিয়ে দারগা আরও অবাক কাউকে কিছুই বলা লাগে নাই । সবাই শরীর যারা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ।
অ-মানব তার হাত দুটা পকেটে ভরে দারগার দিকে চেয়ে একটা হাসি দিল । দারগা উঠে দাঁড়ালো । কুকুর গুলো ঠিক অ-মানবের আগে হেঁটে যেতে লাগলো । কোন শব্দ নাই । অ-মাবের সাথে দুইটা কুকুর ঠিক পাহারা দারের মতো আগে পিছনে হাঁটতে লাগলো । এত শীত লোকটার শরীরের শীতের কোন জামা কাপড় নেই । আর্মির কম্যান্ডো ট্রেনিং দেয়া কি না আল্লায় জানে দারগা মনে মনে বলল ।
না আজ আর ট্রেন থামে নাই ।
দারগা চেয়ে দেখে বেঞ্চের উপরে একটা ম্যাচ পড়ে আছে । হাতে ম্যাচ টা নিয়ে দেখে মাত্র পাঁচটা কাঠি । একটা কাঠি হাতে নিয়ে বলে হায়রে কাঠি তোর দাম এক টাকাও না । আজ সব সমস্যা তকে নিয়েই হচ্ছে । পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সুখ টান দিল ।
সাথের পুলিশরা ফিরে এসে বলল স্যার সরি শীতের গাড়ীর ব্যাটারির বসে গিয়েছিল । সেলফে কাজ হচ্ছিল না। পড়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে গাড়ী চালু করতে হল । এখন আর সমস্যা নেই । দারগা বলল চলুন কাজের সময় আর আপনাদের পাওয়া যাবে না।
দারগা সাব রাতের নাইট করে এসে ঘুমাচ্ছে । রেখা বেগম সকালের নাস্তা শেষ করে হাতে চা নিয়ে উঠানে এসে মুড়াতে বসছে । কুকুরটা তার পাশে এসে একটা ছালার মধ্যে চোপ করে শুয়ে পড়লো ।
পাশের বাড়ি থেকে এক ভাবী আসছে । তাকে বসতে দিল অন্য একটা মুড়ায় । এই ভাবির কে সবাই উকিল ভাবী বলে ডাকে । ঝগড়া করতে খুব পারে । যার সাথে ভাব তার সাথে পক্ষ নিয়ে সে ঝগড়ায় খুব বাহাদুর নারী । তার সাথে সহজে কেউ ঝগড়া করে না। এলাকার ছেলেরাও ভয় পায় ।
উকিল ভাবী বলতে লাগলো রেখা ভাবী একটা একটা কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো । আপনাকে জিজ্ঞাসা করব করব করেও করি না। যদি আপনি কিছু মনে করেন ।
—– না উকিল ভাবী কি মনে নিব । আপনি কি বলতে চান বলুন ।
এমন সময় উকিল ভাবী বলল বিষয়টা আপনার মেয়ে বিন্দুর ।
এমন সময় কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কামড়াতে চলে আসে উকিল ভাবে কে? উকিল ভাবী যত দুর দুর করে কুকুর তত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে । রেখা বেগম বলল আরে থাম মেহেমান । কুকুর তো থামেই না।
উকিলের ভাবির কাপড়ে কামড় দিয়ে ধরে গেইটের বাহিরে দিকে নিয়ে যায় । উকিল ভাবে ভয়ে পারে না দৌরে পালায় । কোন মতে ভয়ে দারগার বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে উঠে । একজন জিজ্ঞাসা করে কি উকিল ভাবী কুকুর খ্যাপলো কেন ? উকিল ভাবী বলল – আরে আর বলবেন না দারগার বাড়ি কুকুর দারগাই হয় ।
কুকুরের চীৎকারে দারগা সাবের ঘুম ভেঙে যায় । পরনের লঙ্গি ঠিক করে বাহিরে এসে বলে কুকুর এত জুড়ে চীৎকার করে কেন ? এই হারামজাতা কুকুর আর এর মালিক আমার জীবন টা নষ্ট করে দিল । রেখা বেগম বলল – কুকুর ঠিক করেছে আজ । উকিল ভাবী আছে না। এই বাড়ির কথা ঐ বাড়ি বলে বেড়ায় আর ঝগড়া লাগায় । আজ আমার মেয়ে বিন্দু কে নিয়ে কি জানি বলতে চাইছিল । অমনেই তো কুকুর তাঁরে কামড় দিতে গেল চীৎকার দিয়ে । বোবা প্রাণী কুকুর কিন্তু আমার মেয়ের নাম নিতেই ঐ মহিলারে যে দৌড়ান দিয়েছে মনে হয় ভুলেও আর এই বাড়িতে আসবে না। দারগা কুকুরের দিকে তাকাতেই কুকুর ও দারগার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায় । রেখা বেগম এক বার স্বামীর মুখ আর এক বার কুকুরের মুখ দেখে । কুকুর আবার সেই ছালার উপর যেয়ে শুয়ে পরে । লেজ নাড়াতে থাকে । দারগা রেখা বেগম কে বলে একটু চা দাও । রেখা বেগম হাসতে হাসতে রান্না ঘরের দিকে চলে যায় ।
চা হাতে দারগার সামনে আসে । দারগা – কি ব্যাপার এত হাসি কেন রেখা বেগম ? মনে হয় তোমার মনে রঙ লাগছে ।
————— রেখা বেগম বলল- কুকুরের কাজ দেখে আজ হাসি পাচ্ছে । উকিল বেটি আজ পান টা মুখে দিতে পারে নাই । যে শিক্ষা হয়েছে মনে হয় আমার মেয়ে নিয়ে আর কোন কথা বলবে না।
—————— দারগা এই কুকুর যার সে থাকলে মনে হয় মহিলার জানাজা পড়াতে হত ।
—————— এই কথা বললা কেন গো ? মেয়েটা কি ঐ ব্যাটার নাকি ? তোমার মেয়ে । তোমার কি কোন দরদ নাই ।
—————– দরদ আছে কিন্তু আসল কথা শুনলে তুমি কুকুর আর ঐ কুকুর ওয়ালা বেটা কে বটি দিয়ে দৌড়া বে ?
—————- বল কি ? কি হয়েছে ? খুলে বল ?
—————– ঐ বেটার নাম অ-মানব । তার সাথে কথায় পারা যায় না। কেমন জানি প্যাচ মেরে কথা বলে । কথার সাথে যুক্তি থাকে খুব শক্ত । সে চায় তোমার মেয়েকে যেন ঐ ব্যাটারির দোকানে ব্যাটারি মিস্ত্রির সাথে বিয়ে দিয়ে দেই ।
—————- বল কি ? তুমি না বললে ঐ ঝামেলা শেষ । আরে আমি তো শেষ করেই দিয়েছিলাম ।
কিন্তু বাজী ধরে সব উল্টা পাল্টা করে ফেলেছি । আমি হেরে গেছি বাজিতে । বাজী ধরার আগে সে আলম , সোহাগ মুখলেছ কে সাক্ষী রেখেছে ।
—————- তুমি পুলিশ মানুষ হয়ে বাজী ধর ।
————— আরে বাজী যে বিষয় নিয়ে ধরেছে সেটা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু অ-মানব তাই করে দেখিয়েছে ?
————— বল কি ? এমন কি বাজী ধরেছ ।
————— কুকুর নিয়ে বাজী ধরেছি । বলেছি এই শীতে যদি কুকুর কে পানিতে নামাতে পারেন তাহলে আপনি যা চাইবেন । তাই দিব যদি সাধ্য থাকে ।
————— ওগো তার পর ।
—————– তার পর এই বদমাইশ কুকুর কে কি জানি বলল আর এই কুকুর এক দৌড়ে পানিতে গিয়ে লাফ দেয় ।
——————- এখন কি হবে গো ?
——————- কি হবে তাই ভাবছি ?
——————- কোন মামলা দিয়ে ওরে জেলে দিয়ে দাও ।
—————— মামলা তো মুখের কথা । শুন মূর্খ আর গরীব মানুষ কে সহজে মামলা সেয়া যায় ।
লোকটা জামা কাপড় চেহারা কথা বলা আর সাহস দেখলে ই ভয় লাগে । সে পুলিশ কে মানুষেই মনে করে না। আমার বাপ দাদা তোমার বাপ দাদা কে কি করত সে এক মিনিটেই বলে দিতে পারে ।
————— কি বলছ গো । আমার তো ভয় ভয় লাগছে ।
ঠিক এমন সময় ভাবী সালাম নিবেন । আমি অ-মানব স্যার আমার ম্যাচ টা স্টেশন থেকে না বলে নিয়ে আসছে । আমি আমার ম্যাচটা নিতে আসছি । এই কথা বলে উঠান থেকে বারান্দায় চলে আসে । দারগা অ-মানবের দিকে বোকার মতো চেয়ে আছে । রেখা বেগম অ-মানব কে ভয়ে ভয়ে বলল ভাই আপনার দারগা ভাই যা বলছে তা কি সত্য ।
অ-মানব একটা হাসি দিয়ে বলে ভাবী আপনাদের বিয়ের সাত বছর একটা মেয়ে হয়েছে । মেয়েকে তো আপনি কোন ঘুষ খোরের কাছে বিয়ে দিতে পারেন না । আমি তাই একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি মাত্র ।
দারগা সাব আমার ম্যাচ টা দেন । দারগা পকেট আলনার উপর থেকে প্যান্টা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পকেট থেকে ম্যাচ টা বের করে তার হাতেদিল । অ-মানব ম্যাচ খুলে দেখে দুটা কাঠি । দারগা সাব কারো জিনিস নিলে তা যতন করে রাখতে হয় । আপনারা পুলিশ মানুষ অবশ্য অন্য রকম মরা লাশ থেকে টাকা নিতে পারেন । পুলিশ সব পারে- শুধু পারে না পাগল আর কুকুর সামাল দিতে ।।
———————————————— চলমান ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!