এ হত্যালীলার শেষ কোথায়

এ হত্যালীলার শেষ কোথায়
সিডনীর কথকতা-২৯
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

বেশ অনেক দিন থেমে ছিল। অন্তত: এমন ধরণের  হত্যালীলা যা ২০১৫-তে অভিজিত রায়ের নির্মম হত্যালীলা দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং পরপর কয়েকজনকে তাদের ভাষায় “নাস্তিক”-কে কুপিয়ে হত্যা করার খবর বোধ হয় তেমন নাস্তিক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যার কোন খবর আমরা পাব না। দু’বছরের মত তেমনটি না ঘটায় এমন ধারণাই পোষণ করছিলাম মনে মনে।

কিন্তু গতকাল (১২জুন) সকালে ইন্টানেটে দেশের খবর ঢাকার পত্র-পত্রিকাগুলোতে দেখতেই চোখে পড়ে গেল মুন্সীগঞ্জের একজন বিশিষ্ট গুণীব্যক্তি, একটি প্রকাশনার মালিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রখ্যাত কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করে আসছিলেন সেই শাহজাহান বাচ্চুকে অকস্মাৎ ঝড়ের গতিতে এসে তাঁর বাড়ির নিকটে গুলি করে চলে গেল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। ক্ষতিটা কার হলো?

শাহজাহান বাচ্চুকে কোনদিন দেখিনি। আলাপও হয়নি কোনদিন। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনাই তাঁর সাথে যেন গভীর এক আত্মীয়তার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে দিল।

শাহজাহান বাচ্চু একজন প্রকাশকই শুধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুন্সিগঞ্জ জেলার কমিউনিষ্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এদেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষের  অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁর দলের ভূমিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল গৌরবোজ্জ্বল। এই উপমহাদেশের নানা সংগ্রাম, লড়াই, আন্দোলনে তাঁর ও তাঁর দলের ভূমিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিল গৌরবোজ্জ্বল । এই উপমহাদেশের নানা সংগ্রাম লড়াই আন্দোলনে তাঁর ও তাঁর পূর্বসূরীদের ভূমিকাও ছিল ঐতিহাসিক। এমন একজন প্রগতিশীল যোদ্ধাকেও  আমরা হারালাম।

একই দিন অপরাহ্নে একটি টিভি চ্যানেলের প্রচারিত খবরে আরও জানতে পারলাম চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা বলাকা প্রকাশনার মালিক, সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিনকে মোবাইল ফোনে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। যেন মানুষ মারা, মানুষকে হত্যা করা, প্রাণনাশের হুমকি দেয়া ডাল-ভাত মাত্র। এসবই যেন মানুষের গা সহা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

শাজাহান বাচ্চু তাঁর নিজ গ্রাম মুন্সিগঞ্জ জেলার  কাঙ্গালদী গ্রামের মোড়ে এলে অকস্মাৎ দুটি মোটর সাইকেলে ৪ জন ছুটে এসে তাঁর বুকে ঠিকমত তাক করে  গুলি ছুড়ে নিমেষেই উধাও হয়ে যায়। শাজাহান বাচ্চু ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তাঁর মেয়ে দুর্বা জাহান ফেসবুকে তৎক্ষণাৎ একটি পোষ্ট দেন “আমার বাবা শাজাহান  বাচ্চুকে আমাদের গ্রামেই কারা যেন গুলি করে মেরে গেছে।”

তাঁর এক বন্ধু ঐ পোস্ট এ কমেন্ট দিয়ে বলেন, “উনি দোকানে বসে ছিলেন। মোটর সাইকেলে করে দু’জন ফোনে অপিরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে খবরটি জানায় দেয় তাঁর বাবার মৃত্যু সংবাদ। তারপর দুর্বা তার বাবার নম্বরে ফোন  করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফোনটি রিসিভ করেন। এভাবেই জানাজানি হয়।

বাংলাদেশ   জ্ঞান  ও  সৃজনশীল  সমিতির  সাবেক  সভাপতি  আজহারুল    ইসলাম  বলেন , বাংলাবাজারের   প্রকাশনা  সংস্থা  বিপাসা  প্রকাশনা  নিয়মিত  কবিতার বই   প্রকাশ করতো।  প্রকাশনাটি  নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব  সাহার মত  প্রখ্যাত  কবিদের কাব্যগ্রন্থ বের করতো।   প্রকাশক হিসেবে  সজ্জন  ছিলেন বাচ্চু।

বাংলাদেশ জ্ঞান  ও সৃজনশীল সমিতির  সভাপতি ফরিদ আহ্মেদ জানান ,  বিপাসা প্রকাশনী  তাদের সমিতির সদস্য ছিলেন।

তিন বছর আগেকার কথা। ঢাকার জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক  ফয়সাল আরেফিন দীপনকে ও তার প্রকাশনা  কার্যালয়ে  প্রকাশ্য  দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।  সেটা ছিল ২০১৫ সালের  অক্টোবর মাস।

এভাবে এ যাবত দুজন প্রকাশক প্রাণ হারালেন । আজিজ সুপার  মার্কেটে খুন হওয়া  দীপনের অপরাধ ছিল  তিনি প্রখ্যাত মুক্তমনা লেখক  অভিজিত  রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন । ঐ বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে একুশে বই মেলা প্রাঙ্গণে  সন্ধ্যারাতে অসংখ্য  মানুষের   ভীড়ের মধ্যে কুপিয়ে অভিজিত ও তার সমমনা সহযোদ্ধা  সহধর্মীনিকেও  একইভাবেও  কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা  চালানো  হয়।  গুরুতর  আঘাতে  আহত হলেও ঢাকায় ও আমেরিকায়  চিকিৎসা নিয়ে অভিজিতের স্ত্রী মৃত্যুর হাত থেকে  রক্ষা পান।

অভিজিত , অতঃপর দীপন এবং তারপর একে একে ব্লগার হিমাদ্রি নিলয়, অনন্ত  বিজয় দাস ও অনলাইন একটিভিস্ট  ওয়াশিকুর  রহমানকে একই  কায়দায় হত্যা করা  হয়। তারপরেও  ঘটেছে  এমন হত্যাকান্ড।

শাহজাহান  বাচ্চুকে  হত্যাকারীদের  সন্ধান এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে তার সহধর্মীনি  সংশ্লিষ্ট  থানায় চারজন  অভিযুক্তির নাম  উল্লেখ  করে  এজাহার  জমা দিয়েছেন বলে জানা যায়।

পুলিশ  কর্তৃপক্ষ  জানিয়েছেন , তাঁরা  এই মামলার  তদন্ত কাজ  শুরু করেছেন  তবে তাদের সন্দেহ,  জঙ্গীরাই  এই হত্যালীলা ঘটিয়ে  থাকবে ।  জঙ্গীবাহীনি  আনসার-আল- ইসলাম  না কি  অন্য কোন গ্রুপ তা এখনই  সঠিকভাবে  বলা যাচ্ছে না।   অতীতে যে সকল  জঙ্গীরা  ব্লগার বা মুক্তমনা  লেখক  প্রকাশকদের  হত্যা করেছে   তাদের হত্যার ধরন  ছিল   কুপিয়ে হত্যা  -কোন  ধারালো অস্ত্র দ্বারা  । কিন্তু এই  ক্ষেত্রে  ভিন্নতা দেখা যায়-  তারা গুলি করে হত্যা করেছে।  শাহ্জাহান বাচ্চুর এই হত্যা যে পূর্বপরিকল্পিত ও সংগঠিত  তা  দিবালোকের মতই স্পষ্ট  ।  হত্যাকারীরা এসেছে  দুটি মোটর সাইকেল নিয়ে- সংখ্যায় ছিল চারজন  । তারা যাবার আগে বিস্ফোরক  ফুটিয়ে  আতঙ্ক  সৃষ্টি করে চলে যায়। তাদের  টার্গেট  ছিল  বাচ্চু  ।

শাহ্জাহান বাচ্চু ছিলেন  বহু  গুনের অধিকারী ।  তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক, রাজনৈতিক কর্মী ও দেশপ্রেম  ব্যক্তিত্ব। তাদের একটি সংগঠন ছিল শুদ্ধ চর্চার উদ্দেশ্যে। তাতে নিয়মিত আলোচনা হতো ধর্ম নিয়ে। বহু ভক্ত জুটেছিল তাঁর । (মুন্সীগঞ্জের)  শহরে ও গ্রামে তাঁর  জনপ্রিয়তাও  ছিল  প্রচুর। তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার সকল শ্রেনীর মানুষ তাঁর  অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র  তাঁর বাড়িতে  ছুটে আসেন, প্রতিবাদে মুখর হয়  এবং পরদিনই  প্রতিবাদ  সমাবেশে মিলিত হন এবং বের করেন মশাল মিছিল।  এমনটি  সচরাচর চোখে পড়ে  না।

শাহ্জাহান বাচ্চু তিন-চার বছর  আগে থেকেই  প্রাণনাশের  হুমকিতেও ছিলেন ।  কিন্তু তিনি ভয় পান নি। তাঁর মেয়ে দুজন ও স্ত্রী  তেমনটাই জানিয়েছেন সাংবাদিকদেরকে । হুমকি  একবার দু’বার নয় বহুবার দেওয়া  হয়েছে  তাঁকে। জঙ্গীদের একটা হিট লিস্ট পুলিশ জানতে পেরেছিল। সেই তালিকায় বাচ্চুর নাম ছিল ১১ নম্বরে। তালিকায় আরও যাঁদের নাম আছে তা আমার জানা নেই। তবে তাঁদের সকলকে রীতিমত নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পূরোপূরি রাষ্ট্রের।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সর্বশেষ খবরে বলা হয়েছে, শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যার ৩/৪  দিন আগেও হুমকি দেওয়া হয় এবং এই বারে তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করেন। তাঁর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী থাকেন ঢাকায় এবং দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে। বাচ্চুও ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। শেষ হুমকি পাবার পর তিনি পৃথক রুমে না থেকে পাশের যে রুমে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর মেয়েসহ থাকতেন সেখানেই থাকা শুরু করেন। বাইরে চলাফেরাও যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দেন। যারা হত্যাকারী তার ‘ইসলাম জঙ্গী’ বলে পুলিশের সন্দেহ। মুন্সীগঞ্জের মানুষও তাই মনে করেন। কারও সাথেই বাচ্চুর কোন বিরোধ ছিল না। কেউ তাঁর শত্রু ছিল না। পারিবারিক কোন বিরোধের খবর কোনদিন জানা যায়নি। একটি অত্যন্ত ভদ্র এবং মিলমিশ সম্পন্ন পরিবার ছিল তাঁর। পোশাক-আশাক-চলন-বলনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে।

ধর্মের নামে যেকোন প্রকার বাড়াবাড়ি সম্পূর্ণ বিরোধী হওয়ায় জঙ্গীদের বিবেচনায় শাহজাহান বাচ্চু ছিলেন একজন ‘নাস্তিক’। ব্যস, আর যত গুণই থাকুক, ঐ তথাকথিত ইসলাম পন্থীদের টার্গেট হয়ে জীবন তাঁকে দিতেই হলো। ধর্ম, সমাজ, কাব্য, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর বিপুল জ্ঞান, সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তাঁর পরিচিতি, তাঁর নিষ্ঠা, সততা ইত্যাদি কোন কিছুই ঐ পিশাচদের কাছে ন্যুনতম বিবেচ্য ছিল না। তারা সংহারকের ভূমিকায় ঠিকই অবতীর্ণ হলো।

সমাজে দুর্নীতিবাজেরা প্রবল প্রতাপে ঘুরে বেড়ায়, ঘুষখোরেরাও তাই। চোর, ডাকাত, খুনী, ধর্ষক কারো নিরাপত্তার অভাব নেই । কোন প্রকার হুমকিও নেই। ঐ পাষ- ইসলামের নামে ভাঁওতা প্রদানকারী নিষ্ঠুর, বর্বর জঙ্গীদের তরফ থেকে তাদের অস্ত্র তাদের হুমকি সৎ লোকের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি বিরোধী, ঘুষ বিরোধী  চোর, ডাকাত, খুনী , ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কদাপি উদ্যত হয় না, কোন নিন্দাবাদও না।

অজ্্র মৃত্যুর মিছিল আজ আমাদের বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, শত সহ¯্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পীঠস্থান বাংলাদেশে, ভাষা আন্দোলনের  সুমহান ঐতিহ্যম-িত বাংলাদেশে চারিদিকে দেখা যায় শুধু মৃত্যুরই কারবার। রক্তের হোলিখেলা দেখছি নিত্যদিন। বন্দুক যুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যালীলা, সড়ক দুর্ঘটনায় অজস্য প্রাণহানি অজ¯্র খুন, নানা অজুহাতে চলছে অবিরাম। এ মৃত্যু অস্বাভাবিক, অসহনীয় এবং কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

রাষ্ট্রের ও সমাজের দায়িত্ব এই মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার, প্রতিরোধ করার। কিন্তু ব্লগাররা, মুক্তমনারা জ্ঞানী দায়িত্বশীল, শান্তিকামী জনগোষ্ঠী একের পর নিহতই হচ্ছেন রাষ্ট্র যেন তার অসহায় দর্শক, সমাজ যেন নীরব নির্বাক। কোন ব্যবস্থা নেই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। মামলা মোকদ্দমা ঠিকই দায়ের হয়। তদন্ত কাজও শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না তদন্তের। অনন্তকাল ধরে চলে ঐ তদন্ত । তাই বিচার হয় না আদালতে। আইনও সেখানে স্তব্ধ।

আন্দোলন? যুব সমাজ? মনে হয় অতিশয় বিভ্রান্তি। অতিমাত্রায় নিস্পৃহ দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কাজে। অসুন্দরকে পরাজিত করার কাজে। তাই সভ্যতা সংস্কৃতি, শিশু, সঙ্গীত, নৃত্য, কাব্য-সাহিত্য, বিজ্ঞান সবই যেন বিদায় নিতে বসেছে, উধাও হতে চলেছে প্রিয় বাংলাদেশ থেকে।

আমরা কি ভাবতে পারি না আজ জীবন না বাঁচলে চাকুরি কি? কোটা প্রথার থাকাই বা কি-না থাকাই বা কি? জীবন বাঁচানো জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতে, সকলের জন্য বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করতে সকল প্রকার উগ্রতার বিরুদ্ধে এক প্রবল জোয়ার, ঢেউ এর কলরোল, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন, গণআন্দোলনের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। যুব সমাজকেই নিতে হবে সেই জোয়ার গড়ে তোলার দায়িত্ব। ঘটাতে হবে ব্যবস্থার সমাপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!