মুক্তিযুদ্ধ, গণস্বাস্থ্য, ডা. জাফরুল্লাহ ও মাছ চোর

গোলাম মোর্তোজা
সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

পালাক্রমে খেতে কৃষি কাজ করেন। তারা কেউ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, কেউ ইন্টার্নশিপ করছেন। সঙ্গে আছেন প্রতিষ্ঠানের অন্য বিভাগের কর্মীরাও। আছেন প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রতিষ্ঠাতা তিনিও।

শখ করে নয়, কৃষি কাজ তাদের নিয়মিত কাজেরই অংশ। অভিনব এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। ছন, বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।

হাসপাতালটি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোক্তার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম এ মবিন। প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একদল সেবাদানকারী। মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও তাদের একজন।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার সময়, নাম নিয়ে আপত্তি এলো প্রশাসনের থেকে। সেই সময় অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ডা. জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিনের কথোপকথন শোনা যাক ডা. জাফরুল্লাহর মুখ থেকে।

‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল করতে দেওয়া হচ্ছে না,’ জানালেন ডা. জাফরুল্লাহ।

‘বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক কর হাসপাতালের জন্যে,’ বললেন বঙ্গবন্ধু।

অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দুজন বসে যে নামটি ভালো সেই নামে হাসপাতাল হবে।’

তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস?’

ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, ‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র…।’

তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’

জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব ও ডা. লুৎফর রহমান সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্যে। বঙ্গবন্ধু আরও ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরিবর্তিত ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করল ১৯৭২ সালে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার-কর্মী সবাইকে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হয়, কৃষি কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে হয়।

২.

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গণমানুষের প্রতিষ্ঠান। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক কথা হয়। প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী ‘পারে না’ বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথমে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বর্তমানে মোট কর্মী সংখ্যা প্রায় ২,৫০০। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নারী।

চিকিৎসা ‘বাণিজ্য’ নয়, সত্যিকার অর্থেই ‘সেবা’ দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে, সেই সূচনালগ্ন থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ ২ হাজার টাকা। সাভারে আরও কম। সিজারিয়ানের প্যাকেজ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ডাক্তার, ওষুধ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার নামে অন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই। সাধারণ প্রসবকে উৎসাহিত করা হয়। জটিলতা দেখা না দিলে সিজার করা হয় না। অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে সাধারণ প্রসব নেই বললেই চলে। সিজারিয়ানের প্যাকেজ সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে ২ বা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত।

সকল রকম প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার খরচ ঢাকার মাঝারি মানের হাসপাতাল, ক্লিনিকের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।

সন্তান প্রসবের দক্ষ কারিগর ধাত্রীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সূচনালগ্ন থেকে।

ইউএসএআইডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনো বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় ধাত্রীদের হাতে।

১৯৮১ সালে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। অন্য সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে গণস্বাস্থ্য উৎপাদিত ওষুধের দাম প্রায় অর্ধেক। যেমন কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্যে অপরিহার্য ইনজেকশন ‘হ্যাপারিন’। বাজারে দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিতটির দাম ২০০ টাকা। সারা পৃথিবীতে কোলেস্টেরল কমানোর জন্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ ‘অ্যাট্রোভাসটাটিন’। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিত একটি ট্যাবলেটের দাম ৭ টাকা, অন্যদের উৎপাদিতটির দাম ১১ টাকা।

সাভারের পর ১৯৯৫ সালে ঢাকার মিরপুর রোডে চালু হয়েছে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। এছাড়া কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে ৫০টির মতো। সেখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, প্যারামেডিক উপস্থিত থাকেন।

৩.

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটি কিডনিই প্রায় অকেজো। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। ঢাকা শহরসহ সারা দেশে কিডনি ডায়ালাইসিস যে কতটা ব্যয়বহুল এবং দুষ্প্রাপ্য চিকিৎসা, অভিজ্ঞতা না থাকলে অনুধাবন করা কঠিন। সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতাল মিলিয়ে সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন যত কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস হয়, এককভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তার চেয়ে বেশি সংখ্যক রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা দেয়।

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। ভারতেও এত বড় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম।

বাংলাদেশে সাধারণভাবে একবার কিডনি ডায়ালাইসিসের খরচ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার-ওষুধ মিলিয়ে আরও বেশি পড়ে যায়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ জন কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করে থাকে। এর মধ্যে ১০-১২ শতাংশ দরিদ্র রোগীর ডায়ালাইসিস করা হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় ২০ শতাংশ রোগীর থেকে নেওয়া হয় ৮০০ টাকা। ১১০০ টাকা নেওয়া হয় ১৫ শতাংশ রোগীর থেকে। সর্বোচ্চ নেওয়া হয় ২৫০০ টাকা। তবে ২৫০০ টাকা দিয়ে যারা ডায়ালাইসিস করাতে পারেন, তারা গণস্বাস্থ্যে আসেন না। তারা অন্য নামকরা হাসপাতালে ৮ বা ১০ হাজার টাকা খরচ করে ডায়ালাইসিস করান। যদিও অন্য কোথাও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো সেবা পাওয়া যায় না। কিডনি রোগীর অন্য যেকোনো রোগের ডাক্তারি সেবা দেওয়া হয় সার্বক্ষণিক, দক্ষ নার্স তো থাকেনই। এসবের জন্যে আলাদা কোনো ফি নেওয়া হয় না।

৪.

স্বাধীন বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ ছিল বাজারে। কিছু তারা উৎপাদন করতেন, অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতেন।

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায়, চার পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়।

দেশীয় ওষুধ শিল্পের যে বিকাশ, তা সেই বৈপ্লবিক ওষুধ নীতিরই সুফল। এখন ১৬-১৭ কোটি মানুষের চাহিদার ৯৫ শতাংশেরও বেশি ওষুধ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশও।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সমালোচনা করা হয়, সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। সুসম্পর্ক থাকার বিষয়টি অসত্য নয়। সামরিক সরকারের সঙ্গে শুধু ডা. জাফরুল্লাহর সুসম্পর্ক ছিল, আর কারও ছিল না?

এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের জন্যে সামান্যতম কোনো সুবিধা নিয়েছেন, এমন কথা কেউ বলতে পারেন না। দেশের জন্যে, প্রতিষ্ঠানের জন্যে করেছেন অনেক কিছু।

এখন তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন ট্রাস্টি। প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন দশ বছর আগে। সম্প্রতি কোনো কোনো গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মালিকানাধীন’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। সঠিক তথ্যটি হলো, ডা. জাফরুল্লাহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক নন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মালিক কোনো ব্যক্তি নন। মালিক বাংলাদেশের জনগণ। একজন রোগী বা অন্য দশ জন মানুষের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওপর যে অধিকার, ডা. জাফরুল্লাহর অধিকার তার চেয়ে বেশি নয়।

জনগণের প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জায়গা- জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। ভূমিদস্যুরা যে জমি দখল করে নিচ্ছে তা গণস্বাস্থ্য কিনেছে ১৯৯৭ সালে স্টান্ডার্ট চাটার্ড ব্যাংকের কাছ থেকে। মামলা চলেছে, উচ্চ আদালতের রায় আছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষে। যে জমি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিনেছিল ১৯৯৯ সালে। গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক হলরুম, শিক্ষার্থীদের হোস্টেল। যেখানে আগামী ১৫-১৯ নভেম্বর সাড়া পৃথিবীর ১,০০০ অতিথি নিয়ে ‘পিপলস হেলথ অ্যাসেম্বলি’ হওয়ার কথা। সেখানে কটন মিলের সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভাঙচুর করা হচ্ছে। পুলিশ নীরব, মামলাও নিচ্ছে না।

র‍্যাব অভিযান চালিয়ে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। অভিযোগ, অপারেশন থিয়েটারে মেয়াদ উত্তীর্ণ সিল্ক সুতা পাওয়া গেছে, ওষুধের ফ্রিজে পাউরুটি পাওয়া গেছে, অফিস সময়ের পরে ল্যাবরেটরিতে এসি চালু ছিল না। পেনিসিলিন এবং সেফালোস্পরিন এতদিন ল্যাবরেটরিতে এক সঙ্গে উৎপাদন করা হতো। সরকার নিয়ম করেছে আলাদা উৎপাদন করতে হবে। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল আলাদা ভবন নির্মাণ করছে, এখনও শেষ হয়নি।

এসব কারণে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের থেকে নগদ ২৫ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। যদিও গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে নগদ টাকা লেনদেন করে না। দুর্নীতিমুক্ত থাকার জন্যে যখন সাভারে ব্যাংক ছিল না, ধামরাই ব্যাংকের মাধ্যমে সব লেনদেন চলত। র‍্যাবের অভিযান, জরিমানা আদায় বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বক্তব্য রাজনৈতিক কারণে ‘অন্যায্য আচরণ’ করা হয়েছে।

ডা. জাফরুল্লাহ জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে তোলায় সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে র‍্যাবের অভিযানের সম্পর্ক দেখছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা।

৫.

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা দিবস পদক ও পুরস্কার’, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রসিদ্ধ ম্যাগসেসেসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি চকচকে ঝকঝকে করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেননি। ব্যবস্থাপনাও সেই অর্থে অত্যাধুনিক নয়। নামমাত্র মূল্য নিয়ে গরীব মানুষদের সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান পাঁচ তারকা মানের করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, প্রয়োজনও হয়ত নেই।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অসম্ভব পরিশ্রমী, কিন্তু জীবনযাপন, কাজ এবং কথায় অগোছালো একটি ব্যাপার দৃশ্যমানভাবেই বোঝা যায়। সারা জীবনই যা ভালো মনে করেছেন, তা করেছেন- বলেছেন। কখনো পরিণতি চিন্তা করেননি।

দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে কিছুটা হয়ত বোঝা যাবে-

ক. জিয়াউর রহমান মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ডা. জাফরুল্লাহকে বলেছিলেন, ‘আপনি আপনার মতো করে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন, যা করতে চান। আপনাকে ব্ল্যাংক চেক দেব।’

উত্তরে ডা. জাফরুল্লাহ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তা হয় না। যারা ব্ল্যাংক চেক দেয়, তাদের ব্যাংকে টাকা নেই।’

খ. আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন চলছিল। তৎকালীন গভর্নর আযম খান ঢাকা মেডিকেলে আসলেন, কেন ছাত্রদের আন্দোলন করা উচিত নয় তা বোঝানোর জন্যে। গভর্নরের পথ আটকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। হাত ধরে বললেন, আপনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে বলছেন। আর আমাদের ছাত্র সংসদের ভিপি আহমদ জামান ও জিএস বদরুদ্দোজা ওয়ারেন্ট নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা কি আপনি জানেন?’

গভর্নরের হাত ছাড়লেন না কয়েক মিনিট। শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে পালাতে বললেন। তিনি পালাননি। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

গ. মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য- প্রমাণসহ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন।

ঘ. মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে লন্ডনে গঠন করলেন ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’। এপ্রিল মাসে হাইড পার্কের সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ নিজের পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিলেন। হয়ে গেলেন রাষ্ট্রহীন নাগরিক।

ঙ. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত ধূমপান করা যাবে না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তার চাকরির মেয়াদ শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ বাড়ালেন না। ড. ওয়াজেদ মিয়া দেখা করলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। সমস্যা হলো ধূমপান। ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রচুর ধূমপান করতেন। একমাস সময় নিয়ে পরিপূর্ণভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়ে, বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে।

৬.

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সম্প্রতি অসত্য তথ্য উল্লেখ করে কিছু কথা বলেছেন, ভুল বুঝতে পেরে সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখও প্রকাশ করেছেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। তারপর থেকে একের পর এক মামলা হচ্ছে।

তিনি জমি দখল করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন এমন বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে তার নামে। তিনি ফল চুরি করেছেন, মাছ চুরি করেছেন তেমন মামলাও হয়েছে।

লন্ডন থেকে পাউন্ড সংগ্রহ করে এনে যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে আগরতলায় হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। জীবনে বহু অর্থ জোগাড় করেছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় ব্যয় করেছেন। তার চরম শত্রুরাও অসততার অভিযোগ আনতে পারেন না। উচ্চবিত্তের জীবনযাপন করার সকল যোগ্যতা থাকার পরও, সারা জীবন প্রায় শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাপন করছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান যার, সেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এখন ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘ফল চোর’, ‘মাছ চোর’, ‘জমি দখলকারী’, ‘চাঁদাবাজি’ মামলার আসামি!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রহণযোগ্য বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বইটিতে লিখেছেন-

‘২৪ আগস্ট মঙ্গলবার ১৯৭১’

‘…চেনা হয়ে উঠেছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এম এ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিল, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করল, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লির প্লেনে চড়ে বসল, উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিলো সিরিয়া এয়ারলাইন্সের। দামাস্কাসে পাঁচ ঘণ্টা লেট। সব যাত্রী নেমেছে ওরা দুজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামেনি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল ওই দুজন পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার জন্য। প্লেনের মধ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। কারণ প্লেন ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুজনকে জানিয়েছিলো ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘণ্টা লেট। এমনি করে ওরা বিপদের মধ্য দিয়ে মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর-টু রণাঙ্গনে হাজির হয়েছে।’

৭.

যার প্রতিষ্ঠান আছে তেমন কেউ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে, প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী ট্রাস্টি পদ থেকে অবসর নিয়ে সাভার থেকে চলে এসেছেন ২০০৮ সালে। এখন তিনি প্রশাসনিকভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিণতি কী হবে? ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে মতের মিল না হতে পারে, তার বিরোধিতা- সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনস্বার্থেই এমন কিছু প্রত্যাশিত নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!