খুলনার দক্ষিনের ৩ টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনী হালচাল

 

 

 

বিশেষ প্রতিনিধি  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

খুলনা জেলার দক্ষিনাংশে অবস্থিত ৩ টি সংসদীয় আসন। আওয়ামীলীগের জরিপ ও গোয়েন্দা তথ্য অনুয়ায়ী প্রাপ্ত তথ্যে জানাগেছে এই ৩টি আসেন ক্ষমতাসীন দল প্রার্থী পরিবর্তন করতে চলেছে। কারন এই তিনটি আসনের বর্তমান এমপিদ্বয় ও প্রতিমন্ত্রী এলাকায় খুবই অজনপ্রিয় হয়েছেন। সকল দলের অংশগ্রহনে কোন প্রতিদন্ধিতাপূর্ন নির্বাচন হলে সেখানে এদের পাশ করার কোন সম্ভবনাই নাই। আসন গুলো হচ্ছে বটিয়াঘাটা-দাকোপ নিয়ে গঠিত খুলনা-১, ডুমুরিয়া-ফুলতলা ও খানজাহান আলী থানার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত খুলনা -৫ পাইকগাছা ও কয়রা থানা নিয়ে গঠিত খুলনা -৬ সংসদীয় এলাকা।

সরেজমিন খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে খুলনা ১ সংসদীয় আসনের বর্তমান সাংসদ পন্চানন বিশ্বাস একদা এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেড়ে দেওয়া এই আসনে এলাকার সাবেক সাংসদ ও আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রাথী বর্তমান খুলনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুন উর রশীদের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে হারিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেন। তার পর ২০০১ এর আওয়ামীলীগের দূসময়েও তিনি খুলনা জেলায় একমাত্র দলীয় এমপি নির্বাচিত হন। কিন্ত গত এক যুগ ধরে তার সেচছাচারিতা ও দূর্ব্যবহারের কারনে স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও জনগন উভয়ই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

খুলনার শান্ত জনপদখ্যাত দাকোপ ও বটিয়াঘাটা দুটি উপজেলাতেই আওয়ামীলীগের মধ্যে তার দৃশ্যমান কোন অবস্থান নেই। বটিয়াঘাটা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পদটাও তার চলে গেছে। উপরন্ত তার অনুসারী কোন নেতাকর্মী ইউপি নির্বাচনে ভাল অবস্থান করতে পারেনি। বর্তমান সাংসদ পন্চানন বিশ্বাসের পাশাপাশি এ আসনটিতে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সাবেক সাংসদ ননীগোপাল মন্ডল, সাবেক সাংসদ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুন উর রশীদ, দাকোপ উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল হোসেন, বটিয়াঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খানও তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে এই নেতাদের মধ্যে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে এদের মধ্যে যেকোন একজনকে মনোনয়ন দিলে বাকীরা সকলে আদাজল খেয়ে তার বিপক্ষে অবস্থান করবেন বলে রাজনৈতিক মহলের ধারনা। ফলে সকল দলের অংশ গ্রহনে প্রতিদন্ধিতাপূর্ন কোন নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগ কোন সুবিধা করতে পারবে না এই আসনে।

দক্ষিন খুলনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন ডুমুরিয়া ফুলতলা ও খান জাহান আলী থানার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত খুলনা -৫ নির্বাচনী এলাকা। স্বাধীনতার পূর্ব সময় থেকেই এই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য তৎকালীন এমএনএ নির্বাচিত হতেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর অ্যাডভোকেট সালাহউদ্দীন ইউসুফ। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় তিনি দেশের স্বাস্থমন্ত্রী মনোনীত হন। ২০০০ সালের শেষ দিকে বর্ষিয়ান এই নেতার মৃত্যুতে আসনটি শুন্য হয় এবং উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বর্তমান প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। যদিও ২০০১ এর নির্বাচনে তিনি হেরে যান এবং তার পর থেকে রাজনীতিতে একটু অনুপস্থিত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ২০০৮ এর নির্বাচনে জনজোয়ারে তিনি জয়লাভ করেন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বিনা প্রতিদন্ধিতায় নির্বাচিত হন এবং সরকারের মৎস্য ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।

কিন্ত গত ২০০১ এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর এলাকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তার অনুপস্থিতি ও নেতাকর্মীদের পাশে না দাঁড়ানোর কারনে ও এমপি ও মন্ত্রী থাকার সময় অতিমাত্রায় পরিবার কেন্দ্রীক হয়ে পড়ায় দলের নেতাকর্মী ও সাধারন জনগন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় পদ তার দখলে থাকার কারনে অনেকে পদ হারানো বা সুবিধাবন্চিত হওয়ার ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায়না। তার পর মন্ত্রী ও তার সহযোগীরা ব্যাপক নিয়োগ বানিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ সকলের মুখে মুখে। পুলিশ কন্সটেবল থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষক নিয়োগ সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করেন মন্ত্রীর সিন্ডিকেট। ফলে আওয়ামীলীগের সাধারন নেতাকর্মী ও তার পরিবারের সদস্যরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বন্চিত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই মোটা টাকার বিনিময়ে মন্ত্রীর আনুকুল্য পেয়ে জামাত-বিএনপির সদস্যরাই ভাল ভাল চাকুরী হাতিয়ে নিয়েছে। এই আসনের পরিস্থিতি এখন এমন যে মন্ত্রীর বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কোন সুযোগ পেলেই জনগন ব্যালটে সমস্ত হিসাব চুকিয়ে দিবে।

মন্ত্রী ছাড়াও এই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন বিএমএ’র সাবেক মহাসচিব ডা: কাজী শহীদুল আলম, আওয়ামীলীগের তরুন নেতা অজয় সরকার , খুলনা জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক গাজী আব্দুল হাদী, ফুলতলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন ও অর্থনীতিবিদ ড: মাহবুবুল আলম। তবে মন্ত্রীর বাইরে ৫ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্থনীতিবিদখ্যাত ড: মাহবুব বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এই আসন থেকে একাধিকবার বিএনপি প্রাথী হওয়া অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামের আপন ভাই হওয়ায় তার বিষয়টি দলীয় হাই কমান্ড ভালভাবে দেখছে না প্রধানমন্ত্রীর ধানমন্ডিস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল সুত্র।

আর অপর তিন প্রার্থী ডা: কাজী শহীদুল আলম, গাজী আব্দুল হাদী ও আকরাম হোসেনের নিজস্ব কোন ভোট ব্যাংক নেই। তারা সম্পূর্নরূপে আওয়ামীলীগের দলীয় ভোট ব্যাংকের উপর নির্ভরশীল । এর মধ্যে কাজী শহীদুল আলম ভালো মানুষ হলেও এলাকায় সম্পূর্ন অপরিচিত। ফুলতলায় তার নিজ জন্মস্থানের পাশের গ্রামের লোকেরাও তাকে চেনেননা। গাজী আব্দুল হাদী ইতিপুর্বে নির্বাচনে দাড়িয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ও সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে শোচনীয় পরাজয় বরন করেছেন । যদিও শেখ আকরাম হোসেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তবে সেই নির্বাচন ছিল অনেক প্রশ্ন বিদ্ধ।

এর বাইরেও এই আসনের কিছুটা আন্চলিকতাও কাজ করে। ডুমুরিয়া-ফুলতলা ও খানজাহান আলী থানার   অংশ নিয়ে এই সংসদীয় আসন গঠিত হলেও মোট ভোটের চারভাগের তিনভাগই ডুমুরিয়ার বাসিন্দা। তাই ডুমুরিয়ার জনসাধারন কখনই চাইবে না নেতৃত্ব ফুলতলার মানুষের হাতে চলে যাক। সেই বিবেচনায় শেখ আকরাম হোসেন, ডাক্তার কাজী শহীদুল আলম ও অর্থনৈীতিবিদ ড: মাহবুবকে ডুমুরিয়ার আওয়ামীলীগ তথা সাধারন জনগন ভালবাবে মানতে পারবেনা। অপরদিকে গাজী আব্দুল হাদীর বাডীর ফুলতলা সংলগ্ন শাহপুরে। তারা সব সময় ডুমুরিয়াকে পাশ কাটিয়ে চলেন। দীর্ঘ সময় গুরুত্বপূর্ণ দলীয় ও সরকারী দায়িত্ব পালন করলেও তিনি নিজেকে ডুমুরিয়ার নেতা হিসেবে তুলে ধরতে পারেন নি। আজও তাকে দলীয় নেতাকর্মী থেকে সাধারন মানুষ শাহপুরের নেতা হিসেবে জানে।

এই সকল বিবেচনায় এই আসনে বর্তমান প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দের বিপরীতে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে তরুন আওয়ামীলীগ নেতা অজয় সরকার। বয়সে নবীন হওয়ার সুবাদে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনী পেশা সকল মানুষের কাছে তিনি ব্যাপক গ্রহনযোগ্য জনপ্রিয়। যদিও তার এই গ্রহনযোগ্যতা আওয়ামীলীগের অনেকের কাছে ইর্শনীয়। তাই তারা বিভিন্ন অপপ্রচার করে অজয় সরকারকে বিভিন্নভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্ত ধর্মের কল বাতাসে নড়ার মত সকল বাধাকে অতিক্রম করে অজয় সরকার বার বার ফিরে আসেন জনগনের সামনে। সম্পতি অনু্ষ্ঠিত খুলনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি প্রাথী হয়ে সকলের নজর কাড়েন। যদিও শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তকে মেনে তিনি ভোটের ময়দান ছেড়ে দেন। এলাকার সাধারন জনগন থেকে রাজনৈতিকনেতার অনেকেই এই তরুন নেতাকে নিয়ে এলাকায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। পাশাপাশি হিন্দু অধ্যুষিত এই আসনে নারায়ন চন্দ্রের বিকল্প অজয় সরকার প্রার্থী হলে আওয়ামীলীগের এই রিজার্ভ ভোট ব্যাংক শতভাগই নৌকার অনুকুলে থাকবে।

খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা পাইকগাছা কয়রা নিয়ে গঠিত খুলনা -৬ সংসদীয় এলাকা। এই এলাকার বর্তমান সাংসদ শেখ মোহাম্মদ নুরুল হক খুবই বিতর্কিত। তার কর্মকান্ডের জন্য সারাদেশের মানুষের কাছে তিনি দখলবাজ হিসেবে পরিচিত। বসতবাড়ী , আওয়ামিলীগ অফিস, দোকানপাট, ইটভাটা, মাছের ঘের জায়গাজমি কোন কিছুই তার দখলবাজী থেকে বাদ পড়েনি। পুলিশ সদস্য থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষক নিয়োগ সকল ক্ষেত্রে তিনি সীমাহীন দূর্নীতি করেছেন । সাংসদ ও তার পূত্রদের এ সকল অপকর্ম নিয়ে একাধিক মামলাও হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামীলীগের সাথে তার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তাকে প্রার্থী করলে নির্বাচনী কাজের জন্য কোন কর্মী পাওয়া যাবেনা বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা।

এ আসনে নুরুল হক ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন স্থানীয় সাবেক সাংসদ সোহরাব আলী সানা, খুলনা জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আখতারুজ্জামান বাবু, পাইকগাছা আওয়ামীলীগের সদস্য সচীব রশীদুজ্জামান মোড়ল ও ইন্জিনিয়ার প্রেমকুমার মন্ডল। এদের মধ্যে সোহরাব আলী সানাও তার অতীত কাজের জন্য যথেষ্ট বিতর্কিত। আর বাকী মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তাদের কর্মকান্ডের কারনে সংসদ সদস্য হওয়ার মত কোন অবস্থান এখনও গড়ে তুলতে পারেননি। এদেরমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধ এলাকার মানুষকে চাকরী বা বিভিন্ন প্রকার সুবিধা দেওয়ার নাম করে জনগনের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে এই আসনে এই সকল প্রাথীর বাইরে পাইকগাছার জামাইখ্যাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড: মশিউর রহমান ও ডুমুরিয়ার অজয় সরকারের নামও আলোচিত হচ্ছে। এরমধ্য অজয় সরকারের অবস্থা খুবই আশাব্যঞ্জক। দীর্ঘ দিন ধরে এই ভাটি অন্চলের মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও প্রসাশনিক কর্তা ব্যক্তিদের হাতে। অজয় সরকার গত ৫/৬ বছর যাবত এই এলাকার মানুষকে নি:স্বার্থভাবে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন। কোন অত্যাচারিত মানুষ তার কাছে গেলে তিনি নিরবে সকলকে তার সাধ্যমত সাহায্য সহযোগীতা করে থাকেন। যেকারনে স্থানীয় সাধারন মানুষরাই অজয় সরকারকে চাইছেন তাদের এমপি হিসেবে। তার উপর এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ভোট রয়েছে। যারা অজয় সরকার প্রার্থী হলে ঐক্যবদ্ধভাবেই নৌকার কাজ করবে। সেক্ষেত্রে বহিরাগত হলেও অজয় সরকার এই আসনে নৌকার প্রাথী হলে ভোটের ফল ভাল হবে।


  • কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!