জীবন থেকে নেয়া গল্প

কাশফুলের ইতিহাসে শাহিন একটি নাম
– ইমরান হোসাইন আশু

তখন আমি ঢাকা ওয়ারীর বনগ্রাম একটি মেয়েকে প্রাইভেট পড়াই । মেয়েটার নাম ছিল মনি । মেয়েটা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে । তাদের বাবা বিদেশ থাকে । বিকাল ৫ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত মেয়েটাকে আমি পড়াই ।
আমি তখন কাপ্তান বাজার বি সি সি রোড আমার ছোট মামা বাসায় থাকি । আমার চাকুরী নাই । বেকার মানুষ ।
মনির মা ছিলেন খুবেই বিরক্ত কর একজন মহিলা । আমি যতক্ষণ পড়াব সে আমার পিছনে সোফায় বসে সুই সুতা দিয়ে হাতের কাজ করবে । ভদ্র মহিলা খুবেই আধুনিক । তবে গত এক মাসে আমার সাথে কোন বিষয়ে কোন কথা বলে নাই – বাসার কাজের মেয়ে রুটিন করে প্রতিদিন চা বিস্কুত দিয়ে যায় ।
মনি খুবেই আধুনিক মেয়ে ছিল । তার কোন কথা বলার থাকলে বা দুষ্টুমি করার ইচ্ছা থাকলে সে খাতায় লিখে দিত ।
খুব মজার মজার কথা সে লেখত । যেমন লেখত স্যার আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে বিবাহিত । ভাবি কি আপনাকে এত রাত পর্যন্ত পড়ান ? কিছু বলে না স্যার ।
স্যার আপনি আজ দেখতে খুব মিষ্টি কিন্তু জামা কাপড়ের কোন ম্যাচিং নেই । স্যার মধুমিতায় সিনেমা দেখবেন ।
মনির মা লেখা পড়া জানত না। আমি পড়ার টেবিলে আসার পড়ে আগে মা আসবে তার পর মেয়ে ।
আমি তখন অবিবাহিত আর বেকার । ভাল টাকাই পাই । একটা প্রাইভেট দিয়েই মাস চলে যায় ।
আমার সাথে মনির সকল কথা হয় কাগজে কলমে ।।
মনির ছেলে মানুষী আমাকে মুগ্ধ করে ।
একদিন মনি আমাকে লেখলো –
—- স্যার আপনার একেই জামা বার বার পড়েন তা আমার ভাল লাগে না- আপনার জন্য তিনটা সার্ট আর চারটা টি সার্ট অমুক দোকানে কিনে রেখেছি । দয়া করে কাল থেকে ঐ গুলো পড়ে আসবেন । আবার ভাববেন না আপনার প্রেমে পড়েছি ।
আপনাকে আমার ভাল লাগে না । আমার বড় বোন আপনাকে এই গুলো কিনে দিয়েছে । মাকে বলে চাকুরী টা হারাবেন না। টাকা দিয়ে শিক্ষক পাওয়া যায় কিন্তু নায়ক স্যার পাওয়া যায় না। আর আপনাকে বেশী পছন্দ করে আমার বোন সাহিন ।।
আমি সেই দিন জানতে পাড়লাম তার আরো একটা বোন আছে । কারন মনির মা সব সময় পিছনে বসে থাকে ব্যক্তিগত কোন কথা বলা একে বারে নিষেধ ।। মনি কে পড়ার আগে থেকেই মনির মা আমাকে বলে দিয়েছে পড়া ছাড়া অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না। আমি চুপ চাপ থাকি । টাই মনির মা আমাকে মনে হয় কিছুটা বিশ্বাস করে ।
আমি কিন্তু একদিন ও সাহিন কে দেখতে পাই নাই ।। আর সাহিন কে নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই । কারন এত ভাল প্রাইভেট আমি হাত ছাড়া করতে চাই না।
মাস ছয়েক পড়ে কথা – আমি মনির খাতায় একটা কবিতা লেখি কিন্তু ছিরে আনতে মনে নাই ।
কবিতাটা ছিল এমন – অন্ধকারে কেউ রুপ বদলে নয়ন চিরে দেখে –
আমি তার নিশ্বাসে বাদলা দিনের মেঘ হয়ে ঝরে যাই অজান্তে ।
শাহিন খুব কবিতা পছন্দ করে ।
আমি আসলেই মনি বলত স্যার সাহিনের জন্য কবিতা কিন্তু চাই । আমার কবিতা তার খুবেই পছন্দ ।
আমি মাঝে মাঝে তাকে কবিতা লেখে দেই । একদিন মনি খাতায় লিখে দিল অমুক দোকান থেকে আপনি একটা অডিও ক্যাসেট নিয়ে যাবেন । আমি এই প্রথম তার হাতের লেখা দেখলাম । যেন শিল্পীর হাতের ছুয়া । আমি পড়ানো শেষ করে ক্যাসেট নিয়ে বাসায় যাই । সাহিন তার নিজের কণ্ঠে অডিও রেকট করেছে আমার কবিতা দিয়ে ।
আমার যে বিশ্বাস হচ্ছে না।
কিন্তু শাহিন দেখতে কেমন । মনির মতো নাকি অন্য রকম
আমার তার পর থেকেই জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে –
মনির মা আমাকে একদিন কি জানি কি মনে করে বলল – ইমরান আজ রাতে খেয়ে যাবেন । আমি বললাম আন্টি আজ আমার দাওয়াত আছে ।
কোথায় দাওয়াত জানতে চাইলে বললাম আমার আরেক মামা আছেন তার বাসায় । কেমন মামা জানতে চাইলে আমি বলি – ঐ মামা আমাদের গ্রামে বাড়িতেই তাদের বাড়ী ।
মামার নাম গলি আসাদ । ঐ মামার স্ত্রী আমাকে খুব আদর করেন , নিজের ছেলের মতো । মামার কাপ্তান বাজারে দোকান আছে ।
মনির মা বলল তার তো অনেক কয়জন মেয়ে । আমি হেসে বললাম – হ্যা তারা সবাই আমার বোন ।
ও তুমি ঐ বাসায় যাও তাহলে তুমি অনেক ভালছেলে ।। তাদের আমি ভাল করে চিনি ।। এই সাত মাস পর ভদ্র মহিলা আজ প্রথম পড়ার কাছ থেকে উঠে চিলে গেলেন অন্য রুমে ।
চা হাতে আজ অন্য একটা মেয়ে এলো ।
সাদা লাল পারের শাড়ী পরে । আমার হাতে চা তুলে দিয়ে বলল
আমি শাহিন আপনার কবিতা । আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখলাম তার কপালের কালো টিপ ।
আমি সালাম দিয়ে বসতে বললাম কবিতার কি কড়া হয় ?
মেয়েটা বলল চার বার এস এস সি ফেইল । তবে আপনার মতো স্যার পেলে হয়ত একবারেই পাশ করে যেতাম ।
— আচ্ছা আজ আপনার মা চলে গেল যে ।
— কারন আপনি যার পরিচয় দিয়েছেন তাদের মা ভাল করে চিনে । তারা খুবেই ভাল মানুষ । আমি ঝুমার সাথেই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি । আপনি যেহেতু তাদের গোলকি আসাদ আঙ্কেলের বাসায় যান তাহলে আপনি ভাল মানুষ। কারন তারা ভাল মানুষ ।
—- তা আপনি কি লেখা পড়া করবেন না ?
—- না , মা পাত্র দেখছে তবে ভাল পাত্র পেলে বিয়ে দিবে । আমি তো খুব হালকা পাতালা মানুষ । মা চায় আর একটু মোটা হই । আমি সেই চেষ্টা করছি ।
আমি গত এক বছরে তাদের কাছে খুবেই আপন হয়ে গেলাম । সেই বছর শাহিন কে আমি নিয়ে গেলাম শরতের কাশ ফুল দেখাতে । শাহিন সব সময় শাড়ী পড়তো । একটা আলাদা আর্ট ছিল তার শাড়ী পরার মাঝে । আমি কিছুদিন পর প্রাইভেট পড়ানো ছেরে দিলাম । তখন আমি একটা চাকুরিতে জয়েন্ট করেছি ।। মাঝে মাঝে যাই । সাহিনের সাথে দেখা করতে । আমাদের মাঝে বেশী কথা হত গল্পের বই নিয়ে । সাহিনের কারনে আমার অনেক বই পড়া হয়ে গেল । কড়ি দিয়ে কিনলাম আমারা এক সাথে শেষ করেছি পড়ে পড়ে এক টেবিলে ।
একদিন খবর এল শাহিন হাসপাতালে – আমি গেলাম দেখতে । বেশ কিছুদিন যাবত তার জ্বর – আগে মাঝে মাঝে জ্বর হতো । শাহিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে । ছেলে ইতালি থাকে- সামনের মাসে আসলে বিয়ে হবে । বিয়ে হবে তাদের গ্রামে দোহার এ । আমাকে সাথে যেতে হবে ঐ বিয়েতে । আমি হেসে বলাম – তুমি যদি বিয়ের দিন বল ইমরান আমি তোমাকে ভালবাসি তখন কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে পালাতে পারব না। শাহিন হেসে বলে আরে এই কপাল ইমরানের নাই । আমাকে নিয়ে পালতে কিন্তু কপাল লাগে ।। আমি হেসে বললাম অভাগার কপাল আমার , সাহিন বলল না তোমার কপাল আমার চেয়ে অনেক বড় , যদি আর কোন জন্ম থাকে সেই জন্মে আমি তোমাকে চাইব রাখাল বন্ধু হিসাবে তোমাকে । তোমার বাঁশী শুনে আমি কাজল চোখে হিজল গাছের নিচে অপেক্ষা করব ।
আমি আর সাহিন মনের অজান্তেই ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম । তার ভাল লাগা মন্দ লাগা গুলো আমার কাছে খুব সুন্দর করে বলে যেত ।
তখন শরত কাল ছিল । চার দিক কাশ ফুল । শাহিন জ্বরের মধ্যে বলছে ইমরান আমি কাশফুল দেখতে যাব । বনশ্রীতে কাশ ফুল আছে । শাহিনের মা বলল বাবা সাহিন একটু নিয়ে যাও তো । আমি খুবেই অবাক হলাম । অ্যান্টি আমাকে নিয়ে যেতে বলছে । আসলে মানুষের বিশ্বাস জন্ম নিলে সেই বিশ্বাসের সম্মান করতে হয় ।
আমি বিকালে শাহিন কে নিয়ে কাশফুল দেখাতে গেলাম । আফতার নগর আর বনশ্রী চার পাশে কাশফুল বন ।

সাহিন আমাকে বলছে

—ইমরান এই কাশফুল গুলো মেঘেদের বিদায় জানাতে মেঘের রূপে সেজেছে ।

— তাই সাহিন ।

— তোমার কি মনেও হয় ।

— না আমার চিন্তায় আসে না ।

— ইমরান ভালো করে দেখ ঐ দুরের কাশফুল আকাশের পেজা মেঘ যেন আজন্মের বন্ধু তোমার আমার মতো ।

— সাহিন তুমি চমৎকার করে কথা বল । তোমার প্রতিটা কথাই কবিতা ।

— ইমরান তুমি লেখবে আমাকে নিয়ে । আমি তোমার কোন এক গল্পের নায়িকা হব । সেই গল্পে কাশফুল থাকবে । আর গল্পের নায়িকা তার বন্ধু কে ভালবাসবে কিন্তু বন্ধুত্বের সন্মানে কেউ কাউকে বলবে না – ভালবাসার কথা । আচ্ছা ইমরান তুমি কি আমাকে ভাল বাস । মিথ্যা বলবে না।

— সাহিন আমি তোমাকে ভালবাসি দূর আকাশের মতো , ভোরের পাখিদের কলরবের মতো । আর ঘুমন্ত শিশুর পবিত্র মুখের মতো ।

—- ওহ ইমরান এই জন্যই তুমি আমার মনের প্রিয় বন্ধু । তোমাকে ভালবাসি মধ্যে রাত্রের শুখ তারার মতো । যে তারা পথ হারালে নাবিক কে পথ দেখায় । ইমরান আমার বিয়ে গেলে আমি তোমাকে খুব মিস করব । কারন তুমি আমাকে যে একুশটি কবিতা দিয়েছে প্রতিটা কবিতা আমার জন্য বসন্ত । তুমি আমাকে চাইলেও ভুলতে পারবে না। অনেক কথার মাঝে সময় কেটে যায় । পশ্চিমের লাল সূর্য বিদায় নিচ্ছে । কিছু পড়েই এই ধারা অন্ধাকার হবে। ইটপাথরের শহর লাল নীল বাতিতে তার রুপ তুলে ধরবে । সাহিন কে নিয়ে রিক্সায় উঠি বন গ্রাম যাওয়ার জন্য ।

সেই দিন আর আমার অফিস যাওয়া হয় নেই ।

রাতের বেলা শাহিনের পাশে বসে কথা বলছি । আমাকে বলল ঐ ইমরান তোমার বোন বিউটির মতো করে আমার মাথায় তেল দাও একটু আর চুল গুলো আচরে দাও । অনেক কথার মাঝে একদিন বলেছি যে আমার বোনের মাথায় আমি তেল দিয়ে দেই । আমি তাই করলাম । শাহিন বলে ইমরান মেয়েদের মতো এত সুন্দর করে মাথার চুল কি করে আচরে দিস ? আমি বলাম শাহিন আমার মায়ের মাথা ব্যথা হলে আমি তো মায়ের মাথায় তেল দিতাম । সংসারের বড় ছেলে হলে অনেক কিছু জানতে হয় ।। আমাকে বলল ইমরান আমি ইটালি গেলে তোমাকে নিয়ে যাব শুধু মাথায় তেল দিতে ।
আমি বলাম জামাই পাইলে ইমরান ইতিহাস হয়ে যাবে । তখন বলবে হাই ইমরান ভাই ।
শাহিন বলল ইমরান সত্য আমি ইতিহাস হব তোমার গল্পের কবিতার । আমি হেসে বললাম তোমার নাম কোন গল্পে থাকবে না । সাহিন বলল সময় কথা বলবে ।
পরের দিন আমি একটা বিশেষ কাজে সিলেট চলে আসি । সাগর নাল ট্রি স্টেট এ । তিন মাস চা গাবানে কাটিয়ে দেই । ১৯৯৫ সাল খুব শীত । আমি হাতে করে মনি পুরী একটা চাদর শাহিনের জন্য কিনে নিয়ে আসি । শাহিন মানে আমার ভাল বন্ধু । মেয়েরা এত আধুনিক মনের হয় তাকে না দেখলে কোন দিন কাউকে বুঝানো যাবে না। তার বুদ্ধি ব্যবহার মায়া আর আদর্শ আমাকে কখন জানি তার বন্ধু বানিয়ে দিয়েছিল ।
সকাল ১১ টায় শাহিনের বাসায় যাই । আমাকে দেখে মনি একটা চিৎকার দিয়ে বলে ভাইয়া আপু নেই । আমি কিছুই বুঝতে পাড়ি না। সবাই আমাকে দেখে কান্না শুরু করে দেয় ।। অ্যান্টি বলে বাবা ইমরান আমার শাহিন মারা গেছে ।। শাহিন নাই ।। কি বলে অ্যান্টি ? আমার নিজের কানে কি শুনছি।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
সাহিন নাই
সাহিন মারা গেছে
না এ হতে পারে না –
আমি নিজেই কান্না করতে লাগলাম ।।
জানতে পারলাম সাহিনের ক্যন্সার হয়েছিল ।
সাহিন না ফেরা দেশে চলে গেল । সাহিন সত্য ইতিহাস হল ।
মনি বলল সাহিন আপা আপনাকে খুব মিস করেছে । আমাকে বলেছে ইমরান যেন আমার জন্য কবিতা লিখে । তার কোন এক গল্পের নায়িকা হবার ইচ্ছা। যেন কাশফুল থাকে নদী থাকে সেই গল্পে ।

তার পর আর কোন দিন আমি শাহিনের বাসা সেই বনগ্রাম আর যাই না। আমি আজো ঐ পথে যায় না। মনে হয় সাহিন সেই কবিতা রেকট করছে ।
শাহিন যেন ইতিহাস হয়ে গেল আমার মনের মনি কুটিরে ।।
পরপারে ভাল থেক বন্ধু শাহিন ।। আমিও আজো কোন গল্পের নায়িকা বানাতে পারলাম না তোমাকে । কারন তুমি গল্পের চেয়ে বেশী পবিত্র আমার মনে ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!