শামিম আল মাহমুদ এর ছোট গল্প-তবে তাই হোক

তবে তাই হোক

—————-শামিম আল মাহমুদ

 

সনেট আর সরল অন্তরঙ্গ বন্ধু হলেও তাদের স্বভাবে তেমন একটা মিল পাওয়া অত্যন্ত বিরল। কিন্তু তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব কী ভাবে হল কে জানে? তারা দুই জন দুই বিপরীত মেরু কিংবা দুই নদীর ধারার মত হলেও মোহনার কাছাকাছি মিলে গেছে। সনেট হাসিখুশি, সুদর্শন, বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। অপরদিকে সরল জীবন সম্বন্ধে উদাসীন, কাঠখোট্টা, হাড্ডিসার, পুরো সংসারের ভারে নুয়ে পড়া, অবিন্যস্ত চুল- অনেকটা কলুর বলদের মত। তাদের মতেরও অনেক অমিল। সনেট এর কাছে জীবন এনজয়েবল কিন্তু সরল মনে করে তা কতগুলো দু:খময় সেকেন্ডের বৃহৎ সমষ্টি।

গ্রাম থেকে আসার পর সরল সনেটের কাছ থেকে অনেক সাহায্য সহানুভূতি পেয়েছিল তাই হয়তো তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাও আবার যেন তেন বন্ধুত্ব নয় একেবারে দহরম মহরম। তারা একই সঙ্গে বসে ক্লাস করে আবার একই সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকের অবসর সময় পার করে।

তাদের মধ্যে অনেকগুলো অমিলের মধ্যে একটি আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে তাদের কণ্ঠ প্রায় একইরকম। সনেট ও সরল দুজনেরই নামের প্রথম অক্ষর ঝ. তাই তারা দুজনেই তাদের সাংকেতিক নাম হিসেবে ব্যবহার করে Ƨঝ চিহ্নটি। এটা অবশ্য সরলের আবিষ্কার।

তো ক্যাম্পাসের বার্ষিক মুখপত্র তৈরির সময় সরল একটি চমৎকার কবিতা পাঠায় যা সবার কাছেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়।  কিন্তু কিছু কিছু লোক নেপথ্যের আড়ালে থাকতে পছন্দ করে সরলও তাদের মধ্যে একজন। তাই সে লেখকের নামের জায়গায় Ƨঝ ব্যবহার করে।

কিন্তু সনেট এর কিছুই জানত না। সনেট তখন ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে মিলিকে নিয়ে স্বপ্নজাল বুনতে এতই ব্যস্ত ছিল যে তখন তাকে একটা জড়বৎ মনে হওয়াই স্বাভাবিক যাকে কোন বাঘ আস্ত চিবিয়ে খেলেও বুঝতেই পারবে না অথবা গন্ডারের মত অনেকক্ষণ পর বুঝবে। তাই সরল যখন তাকে আলতো চাপড় মেরে বলল “চল যাই।” তখন সে বুঝতেই পারলো না। কিন্তু একটু জোরে ঝাঁকুনি দিতেই সনেট তন্দ্রা ভেঙ্গে বাস্তবে প্রবেশ করে এবং বলে “বন্ধু, আমাকে একটি সুন্দর মেসেজ লিখে দে”। তখন সরল তার সদ্য প্রকাশিত কবিতার কয়েক লাইন লিখে দিল। তারপর তারা নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেল।

এদিকে সনেট বাড়ী গিয়ে মিলির এক বান্ধবীকে পেটপুরে বার্গার খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নেয়া মিলির ম্যাজিক্যাল নাম্বারটিতে সেই কবিতার লাইনগুলো পাঠিয়ে দেয়। ঠিক জায়গায়ই গবংংধমব পৌঁছে। বলাই বাহুল্য শেষে লেখা ছিল Ƨঝ চিহ্নটি।

তো মিলি গবংংধমব পেয়ে তাকে ঐ সুন্দর কবিতাটির জন্য অভিনন্দন জানালো আরেকটি গধংংধমব এর মাধ্যমে। সনেট খুব খুশি হল। সে ভাবল যে সরলের দেয়া গবংংধমব এর বদৌলতেই আজ তার কপাল খুলল। কেননা এর আগে সে অনেকবার অন্যকে দিয়ে তার মনের কথা বলিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখায়নি। সবমেয়ে যেখানে সনেটকে যেচে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে প্রস্তাব করে সেখানে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেলেও সে কেমন নিস্পৃহ ছিল।

যাক আজ সে অনেক খুশি। সে ঠিক করল উচ্চ কল রেটের তোয়াক্কা না করে কালকেই সরলকে দিয়ে তার পরিচয়ে কথা বলাবে কারণ ওর কথা শুনলে সবাই কেমন যেন একটু নরম হয়ে যায়। ও যেন অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে সকলের মনের খবর নিয়ে তা সুললিত কণ্ঠে নির্দ্বিধায় বলে দেয়। এজন্য ওকে সবাই সমীহ করলেও সবাই ভিতরে ভিতরে শ্রদ্ধা করে।

পরদিন এক নির্জন ঝোপঝাড়যুক্ত জায়গায় গিয়ে সরলকে সনেট সব কথা খুলে বলল এবং তার কাজে সাহায্য করতে বলল। কিন্তু সরল অসম্মতি জানিয়ে বলল যে “এসব ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া একেবারে অনুচিত।” কিন্তু অত্যধিক জোরাজুরিতে সে কথা বলতে কল দেয়।

ওপাশে রিং হতেই নজরুলের ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতা আবৃত্তি শোনা যেতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সরল তার স্বভাব সুলভ রূক্ষ স্বরে হ্যালো বলে জবাব দিল। এরপর সে প্রশ্ন করল তাকে চিনতে পেরেছে কিনা? ও পাশ থেকে উত্তর আসলো “অবশ্যই”।

এরপর মিলি তাকে তার কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল। এর পর তার সম্পর্কে বিশ্লেষণ করল। এসব সরলের ভাল লাগছিল না। কেননা পৃথিবীতে এমনও কিছু মানুষ আছে যারা বাতির নিচের অন্ধকারকেই বেশি পছন্দ করে। তবু সে চুপচাপ শুনল কারণ মেয়েটি যার সম্বন্ধে মন্তব্য করছে ঐ ব্যক্তি সে নয় তার বন্ধু। নিজের কবিতার জন্য অন্য কেউ সম্মান পাচ্ছে দেখেও সে আপন বন্ধুর জন্য অবলীলায় আত্মত্যাগ করল।

পরবর্তীতে কিছু সাধারণ কথাবার্তার পর সরাসরি ভালবাসার প্রস্তাব দিল এবং মিলি তাকে আশ্বাস দিল যে সে তাকে অনেক আগেই ভালবাসতো। কিন্তু নারীরা অবলা বলে মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে নি। এরপর সে কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা বলল যা সরল শুনতে চাইল না বলে সনেটকে ফোনটা দিয়ে দিল। একটু পরে ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।

এরপর প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হলো। মাঝে মাঝে সরল সনেট হয়ে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত মিলির সাথে কথা বলতো। একদিন সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল যে মিলি তাকে দেখে কেমন যেন লজ্জা বোধ করে। তার সঙ্গে কথা বলার সময় তার গন্ডদেশে রক্তিম আভা ধরে। কিন্তু সে এর অর্থ বুঝলো না কিংবা বুঝতে চাইল না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে সে আর মিলির সাথে কথা বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল। সনেটের শত সাধাসাধিতেও সে প্রতিজ্ঞায় অটল রইল।

তারপর সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস নিজ গতিতেই এগিয়ে চলল। পরীক্ষা এসে দরজায় কড়া নাড়লো। তাই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল পড়াশোনা নিয়ে। ক্লাসের সবাই ভীষণ ব্যস্ত, কোন দিকে তাকানোর ফুসরত নেই কারো। কোন কিছু আরম্ভ হলে তা আজ হোক কাল হোক একদিন শেষ হবেই। পরীক্ষাও মহামারীর মত ত্রাস সঞ্চার করে এসে ঠিকই পরিশেষ হল। এরপর সবার অখন্ড অবসর।

এমন সময়ে মিলির বাড়ীর সামনের রাস্তার পিচ আর পাড়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চ সনেটের সরব উপস্থিতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকল। সরল একটা দোকানে পার্ট টাইম জব হিসেবে সেলসম্যানের কাজ নেওয়ায় সঙ্গী হতে পারত না। কিন্তু কাজ না থাকলেও হয়তো সে তার সঙ্গী হত না কারণ এসব ব্যাপার সরল খুব একটা পছন্দ করে না। এ ভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। এখন সরল আর সনেটের দেখা খুব একটা হয় না। কারণ সনেট ব্যস্ত থাকে ফোন আর ঘোরাঘুরি নিয়ে আর সরল তার সবে ধন নীলমণি চাকরি নিয়ে।

একদিন সকালে সনেট সরলকে বলল যে কাল তার সঙ্গে রমনা পার্কে যেতে হবে। সরল কিছুই বুঝল না। সে বলল ‘কেন?’ সনেট বলল কোন ওজর আপত্তি খাটবে না কাল যেতেই হবে আর কারণ যেতে যেতে বলবে। তারপর যেমন মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ উদয় হয়েছিল তেমনি হঠাৎ বাইকটা ঘুরিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল।

সরলের উপর এখন অনেক চাপ। দোকানের মালিক ওকে খুব বিশ্বাস করে বলে কাল একটা চালান আনার জন্য ওকে যেতে বলেছে। কিন্তু কি আর করা। তার অসুবিধার কথা মালিককে বুঝিয়ে বললে হয়তো সে না করবে না। হলোও তাই। দোকানদার তার কাজে অনেক সন্তুষ্ট। তার উপস্থিতিতে দোকানের বিক্রী ভালই হচ্ছিল। তাই সে অমত করলো না।

আর দশটা দিনের মতই ১৩ তারিখ সকালটা শুরু হল। পাখির কলতানে সনেট ঘুমে থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সরলের আবাসে ঢুঁ মারলো। সরল প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে তার বাইকের পিছনে চড়ে বসল। তারপর সরল জিজ্ঞেস করল  “কারণটা বল”।

সে কেমন যেন আবেগহীন কণ্ঠে বলতে লাগল “আজ মিলি আসছে রমনা পার্কে আমার সঙ্গে দেখা করতে।” বলেই সে তার একটা প্রিয় গানের লাইন আওড়ে গেল। কিন্তু সরলের কাছে কেমন যেন খাপছাড়া লাগল।

একটু পর সনেট বলল “আজ আমার জীবনের দারুণ তাৎপর্যময় একটি দিন। আজ ওকে সামনাসামনি পেয়ে কি যে বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। হয়তো আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হবে না।”

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মোড়ের কাছে আসতেই সরল চিৎকার করে বলল, “বাইক ডানে ঘোরা জলদি।”

রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল বলে সনেট খুব জোরে বাইক চালাচ্ছিল। কিন্তু মোড়ের ওপাশ থেকে একটা ট্রাক প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে আসতে দেখে সনেট একটু ভড়কে গেল। তারপর যথাসাধ্য চেষ্টা করল বাইক ঘোরাতে। কিন্তু ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট। ট্রাকের প্রচন্ড আঘাতে ওদের বাইকটা ছিটকে পড়ল।

বামপাশের অস্থিগুলোতে একটা ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে সরল কোন মতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো। “মনে হয় না কোন সন্ধি ভেঙ্গেছে” বলে সে বাম দিকে চেয়ে দেখল অনেক জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার সে ডান দিকে তাকিয়ে যা দেখল তা সে কল্পনাও করতে পারে নি। সনেটের মাথা থেকে গলগল করে রক্তপাত হচ্ছে। একটা অস্ফুট চিৎকার তার মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এল। সে জনতার উদ্দেশ্যে বলল “আপনারা কেউ একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করুন দ্রুত। ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।” তারপর একজন একটা ট্যাক্সি নিয়ে এল এবং সনেটকে শুইয়ে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।

সরল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কারণ রমানপার্কে মিলি এসে  অপেক্ষা করবে কিন্তু সরল মিলির কোন ফোন নাম্বার জানে না আর সনেটের ফোন কোথায় পড়ে গেছে কে জানে। তাই সে সেদিকে রওনা দিতে উদ্যত হল এমন সময় ডাক্তার বলল “কোথায় যাচ্ছেন? আপনার অবস্থাও বেশি ভাল না, ট্রিটমেন্ট লাগবে।”

সরল বলল “ আগে ওর ব্যবস্থা করুন।”

সরল পার্কে গিয়ে দেখল নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট পরও মিলি নির্ধারিত স্থানে পায়চারি করছে। আজ সে নীল শাড়ি পরেছে, কপালে একটা ছোট কাল টিপ আর হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ- সব মিলিয়ে ভালবাসার দেবীর মূর্ত প্রতীক মনে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু সরলের তার সৌন্দর্য অবলোকনের অবস্থা ছিল না। সে তাড়াতাড়ি মিলির সামনে আসল এবং বলল “ তুমি যার জন্য অপেক্ষা করছো সে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আর যার জন্য অপেক্ষা করছ না সে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

মিলির হাত থেকে ফুলগুলো মাটির বুকে আশ্রয় নিল। সে  দেখল সরলের শার্টের বাম হাতায় রক্তের ছোপ, প্যান্টের বাম পাশে একটা ফুটো। মিলি ছুটে এসে তার হাত ধরে বলল “তুমি কি জান আমি কার জন্য অপেক্ষা করছি?”

সরল লজ্জিতভাবে বলল “হ্যাঁ, তুমি সনেটের জন্য অপেক্ষা করছ।”

মিলি তখন বলল “কিংবা এর উল্টোটা।”

সরল বলল “তার মানে?” মিলি বলল “মানে খুবই সোজা। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। কেন সনেট তোমাকে বলে নি? না বললে ও তো ব্যাপক বিশ্বাসঘাতক।”

এতক্ষণে সরল আজকের নাটকীয়তার অর্থ স্পষ্ট বুঝতে পারলো। সরল সরোষে চিৎকার করে উঠল “চুপ কর।” তার চিৎকারে গাছ থেকে কতগুলো পাখি উড়ে গেল। মিলি হতভম্ব হয়ে পড়ল।

হঠাৎ সরলের মনে হতে থাকে তার চারপাশে সব ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই, সব শূণ্য স্তব্ধ, তার খুলির ভিতর দিয়ে জোরালো বাতাস প্রবাহিত হয়ে বাঁশির মত শব্দ করছে, তার দেহ বাতাসে ভেসে রয়েছে। তার মনে হল সে পড়ে যাবে। কিন্তু সে পড়ল না বরং চরম ইচ্ছাশক্তির বলে হঠাৎ সে যন্ত্রচালিতের মত ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর হন হন করে হাসপাতালের দিকে চলতে শুরু করল। মিলি বলল “যেও না, প্লিজ শুনে যাও।” কিন্তু তার কথা সরলের কানে পৌঁছল কি না কে জানে।

অবশেষে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে সে হাসপাতালে ফিরে এল। সে সনেটের শিয়রে বসলো। ততক্ষণে সনেটের জ্ঞান ফিরে এসেছে। সনেট সরলের ডান হাতটা কাঁপা হাতে ধরে নিষ্প্্রাণ শুষ্ক হাসি হেসে বলতে লাগল “তোর জন্যই এখনো বেঁচে আছি। মিলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল নিশ্চয়ই। ও তোকে অনেক ভালবাসে। তুই ওর মন ভেঙ্গে দিস না। ও প্রথম দিন থেকেই তোকে চিনেছিল। এরপর আবার ওর এক বান্ধবী তোকে দেখেছিল, ভেবেছিল তোর ফোন নেই বলে আমারটা থেকে ফোন করেছিস। আর আমি যে কয়দিন আলাপ করেছি সেসব দিন তোকে মনে করেই কথা বলতো। একদিন একটু সন্দেহ প্রকাশ করার পর আমি তাকে সব খুলে বলি। আমার বিশ্বাস ছিল ও আমাকে ফিরিয়ে দেবে না। কিন্তু কি আশ্চর্য! ও বলল যে ও তোকে ভালবাসে। তারপর তোকে নিয়ে অনেকদিন আলাপ হয়েছে। সত্যিই সব মেয়ে আমাকে চায় কিন্তু আমি পাত্তা দেই না কিন্তু ওকে আমি চাই তবু ও আমাকে ফিরিয়ে দিল। যা হোক সময় মনে হয় ঘনিয়ে আসছে। তুই ওকে গ্রহণ করিস। তবেই আমি ওপাড়ে গিয়েও তোদের জুটি দেখে সুখী হব। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বন্ধু। বি….দা…….” কথাটা ভাল ভাবে শেষ হলো না তার আগেই সরলের হাত ধরা হাতটা বিছানায় লুটিয়ে পড়লো।

সরল আর থাকতে পারল না। কোনমতে কান্না সংবরণ করে বাইরে বেরিয়ে পিচঢালা রাজপথে হাঁটতে লাগলো। সে ভাবতে চাইল আজ সনেটের কিছুই হয় নি। কিন্তু আজকের বাতাসে যেন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি, ফুসফুস যেন তা ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারছে না, গলাটা যেন চেপে আসছে, কেমন যেন লাগছে। তার মস্তিষ্কে চলছে ভাবনার ঝড়।

এক অসহায় মেয়ে তার সঙ্গপ্রার্থী তাকে গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু তার নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁইই অনিশ্চিত অপরকে এই অনিশ্চয়তায় জড়াবে কীভাবে? আবার এটা ছিল সনেটেরও শেষ ইচ্ছা। আবার এতে বন্ধুত্বেরও চরম অবমাননা করা হয়। কারণ সনেট মনে প্রাণে ভালবাসতো মিলিকে। সে আজ হয়তো নেই কিন্তু তাতে কী আসে যায়? সে তো সরলের প্রতিটি রক্তবিন্দু অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। তার প্রিয় জিনিসের প্রতি সে কোন মুখে হাত বাড়াবে। এটা যে বন্ধুর অগোচরে তার পিঠে খুর মারার মত ঘটনা হবে।

অস্বস্তি লাগার পরিমাণটা বেড়েই চলছে। সরল হঠাৎ ভাবল “হ্যাঁ, তাই ভাল। এ যন্ত্রণাকাতর বিশ্রী কুৎসিত ভাবনার ঘুণে কুরে কুরে খাওয়ার চেয়ে নিষ্ঠুর নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করা ঢের ভাল। তবে তাই হোক।”

দেহ যেন বেঁচে থাকার দুর্বহ ভার সহ্য করতে পারছে না। মৃত্যু বা ঐ জাতীয় কিছু তার দায়ভার সাগ্রহে নিতে চাচ্ছে। ব্যস্ততার বেড়াজালে জর্জরিত অনেকেই দেখল একজন যুবক হাঁটু মুড়ে মাটির নিবিড় স্পর্শের অদৃশ্য টানে পতিত হচ্ছে। হচ্ছে হোক, এভাবে তো কতজনই ভূপাতিত হচ্ছে প্রতিদিন তাদের খবর কে রাখে। তাই যে যার গন্তব্যে চলতে লাগল। কিন্তু কেউ দেখল না তার সাথে তার সকল আশা, আকাঙ্খা, চিন্তা, চেতানাও ধূলিস্মাৎ হল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!