মহান মে দিবস, শ্রমিকের গাঁথা কথা।

মহান মে দিবস, শ্রমিকের গাঁথা কথা
ভূপেন্দ্র নাথ রায়

সারা পৃথিবী ব্যাপী মে মাসের প্রথম দিনটি পালিত হয় কর্মশ্রেণী মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষা স্মরণ করার জন্য। দিনটিতে শ্রমিকেরা নেচে, গেয়ে, খেয়ে আনন্দে তাদের সময় কাটায় এবং সেই দাসত্বের শ্রম থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুষ্ঠ, সুন্দরও নিরাপদ কর্মপরিবেশের প্রত্যাশায় পালন করে।

শিল্পবিপ্লবের ১৮ – ১৯ শতকের দিকে ইউরোপ এবং আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী কল – কারখানায় ১২/১৪ ঘন্টা এবং কিছু ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশী সময় ধরে দিনে কাজ করত। এরপরও শ্রমিকের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা সহ স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র লেশ ছিল না। শ্রমিকরা দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে নির্যাতন- নিপীড়নের শিকার হয়ে ধনীশ্রেণীর সেবা করে যেত।
কালের পরিক্রমায় ক্ষুদ্র পরিসরে শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা দিনে আট ঘন্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ম্যাককমিক হারভেস্টার কোম্পানীর সামনে র‍্যালি দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভে প্রায় ৬০০০ শ্রমিক অংশগ্রহন করে। শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে শ্লোগান দিলে পুলিশ তাদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে লাঠিচার্জ সহ গুলি বর্ষন করে। শ্রমিক- পুলিশের এ সংঘর্ষে অন্তত ১২ – ১৪ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় সকল শ্রেণীর শ্রমিক ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরবর্তীতে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ১মে প্রাথমিক ভাবে শ্রমিক দিবস ঘোষিত হয় এবং ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের আমস্টার্ডাম শহরে সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মে দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতি ক্রমে গৃহিত হয়। উক্ত সম্মেলনে শ্রমিকদের আটঘন্টা কাজের নির্ধারন ও শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ না করার সিন্ধান্তও গ্রহন হয়। প্রায় তিন যুগ পেরিয়ে ভার্সাই চুক্তির আওতায় ১৯ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এটি জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থার মর্যাদা লাভ করে।

আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিকের ৮ ঘন্টা কাজের দাবী পুরণ হলেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা এখনও পর্যন্ত ১০-১২ ঘন্টা কাজ করে থাকে। শ্রমিকরা আদৌ কি তাদের দাবী পূরনপূর্বক কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা, সম্মান নিশ্চিত করতে পারছে কি? কিছুক্ষেত্রে বয়স ততটা আমলে নেওয়া হচ্ছেনা। ফলে অনেক কল-কারখানায় শিশুশ্রমের ঘটনা ঘটছে। প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

কেস স্টাডি-১ এ কথা হয় বৃহত্তর ঢাকার কয়েকজন শ্রমিকের সাথে। তাদের মধ্যে বিজন (ছদ্মনাম) কাজ করে গাজীপুরের একটি কারখানায়। ৫৩০০ টাকা তার বেতন ধরা হয়েছে। এই বেতনে তাকে প্রতিদিন বাধ্যতামূলকভাবে ওভারটাইম সহ ১০/১২ ঘন্টা পোষাক কারখানায় কাজ করতে হয়। এই দীর্ঘ সময় শ্রমের পর আর কোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়না। এদিকে ১ রুমের একটি বাসা ২৫০০ টাকা দিতে হয়, যেখানে  তার  ৪ জনের সংসার কোনমতে অতিবাহিত হয়। একমাত্র বাধ্য হয়েই তার ১৪ বছরের মেয়েকে কোনাবাড়ির একটি স্পিনিং মিলে কাজ নিতে হয়। সেখানে তার বেতন ৩৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মিলে একদিন হঠাৎ দূর্ঘটনায় মেয়েটি আহত হয়। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার আরও চিকিৎসার ব্যাপারে মিল কতৃপক্ষ কোন খোঁজখবরই নেয়নি।

কেস স্টাডি-২ এ কথা হয় নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডের কয়েকজন নারী শ্রমিকের সাথে। তাদের ভাষ্য, ছুটির দিনেও কাজের টার্গেট পুরণ করতে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। ধর্মীয় পর্বের ছুটির জন্য শুক্রবার বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়। আবার কাজের টার্গেট পূরণ না হলে বকা-ঝকা, অসম্মান সহ্য করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করা হয়।

কেস স্টাডি-৩ এ কৃষিক্ষেত্রের কিছু শ্রমিকের সাথে কথা হয়, তারা বলে এ খাতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতে হয় কিন্তু সময়ের সাথে শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। বছরে মেটামুটি দুই মৌসূমে কাজ চলে, স্থান এবং কৃষি ভেদে তিন মৌসূমের কাজে দুই বা তিন রকম মজুরি হয়ে থাকে। কখনও আবার আহত হলে ক্ষতিপূরণের কোন ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে নিয়মিত কাজের কোন নিশ্চয়তা বিত্তশালী শ্রেণী তাদের নিশ্চিত করতে পারছেনা। এ কারনে তাদের প্রায়ই পেশা পাল্টাতে হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমান সময়ে কৃষিতে পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের হার বেশী। নারীরা কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গার্মেন্টস সেক্টরে বেশীর ভাগ নারী শ্রমিক। বিবিসির এক প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট শ্রমশক্তিতে নারী শ্রমিকের হার ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ(সিপিডি)’র জরিপে দেখা যায়, দেশের শ্রমশক্তিতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহন দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গৃহকর্মের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহন বেড়ে চলেছে যা নি:সন্দেহে কোন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক দিক। কিন্তু অংশ গ্রহনের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন কল-কারখানা, দোকান, কৃষি ও পরিবহন ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজের সময় শিথিল লক্ষ্য করা গেলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের জীবনের নিরাপত্তা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। এ ব্যাপারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেপটিক এ্যান্ড রাইটস সোসাইটি(এসআরএস) এর তথ্যমতে, ২০০৯-১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে শ্রম দূর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় চার হাজার একশো দশ জনের মতো। এর মধ্যে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ ততটা দূর্ঘটনায় শিকার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়নি।

মে দিবসের এ দিনটি শ্রমিকরা তাদের আটঘন্টা পরিশ্রম এবং নিরাপদ কর্ম পরিবেশের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপি জাঁক জমকের সাথে পালিত হচ্ছে। কিন্তু দিনটির তাৎপর্য তখনি সার্থক হতো, যখন শ্রমিকরা তাদের শ্রম ও কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করতো। যেহেতু, বাংলাদেশ আইএলও নীতিমালার একটি স্বাক্ষরকারী দেশ, সেহেতু আইএলও নীতিমালায় সমস্ত মালিক পক্ষ সাধারণ শ্রমিকের কর্মস্বাধীনতার দিকটি ভেবে দেখা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!