‘মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।‘ কে ছিলেন মালকা বানুর আর মনু মিয়া?

 

সেলিনা জাহান প্রিয়া । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম

মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।/ মালকার বিয়া হইবো, মালকার বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথেরে।‘’গানটি আমাদের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মালকাবানু ও মনুমিয়ার প্রেমের উপাখ্যান। এই প্রেমকাহিনী তখন সারাদেশময় আলোড়ন তুলেছিলো। তাদের প্রেম উপাখ্যান কোনো রূপকথার গল্প নয়, মালকা বানু মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ছিল বাস্তবভিত্তিক প্রেম কাহিনী।

ইতিহাসের কিংবদন্তি মনুমিয়া-মালকা বানুর প্রেম কাহিনী নিয়ে গল্প, নাটক, সিনেমা অনেক হয়েছে। দেশজুড়ে এক সময় দলবেঁধে মানুষ মনুমিয়া-মালকা বানুর গল্পকাহিনী শুনত। ইতিহাসের এ কিংবদন্তি মনু মিয়ার স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার শোলকাটা গ্রামে।

আর মালকা বানুর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল ইউনিয়েনে। এখানে ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে আছে মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘি।

প্রায় তিনশ’ বছর আগে মনুমিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ ছিলেন দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার নবাব শাহ সুজার প্রধান সেনাপতি।পরবর্তীতে আরাকান রাজ্যের অধীন রামুর চাকমা কুলের রাজা ছিলেন এই শেরমস্ত খাঁ। তিনিই আনোয়ারা উপজেলার শোলকাটা গ্রামে বসবাস করতেন। এরই সূত্র ধরে মনুমিয়া-মালকা বানুর বসবাস হয় এ গ্রামে। শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র ছিলেন মনুমিয়া। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজকীয় ফরমান মূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় চট্টগ্রাম। তারও বহু বছর আগে শেরমস্ত খাঁ আরাকান রাজ্যের অধীন সমুদ্র, পাহাড়, লাল-সবুজ টিলা আর পবর্তঘেরা দেয়াঙ রাজ্য তথা বর্তমান আনোয়ারার পশ্চিম শোলকাটা গ্রামে এসে বসতি শুরু করেন। মনু মিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে, রামু থেকে চকরিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া এবং আনোয়ারা পর্যন্ত বিশাল ভূ-সম্পদের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার অধীনে ছিল ছোট ছোট বহু জমিদার।
শেরমস্ত খাঁর তিন সন্তান। তাদের মধ্যে একজন জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনুমিয়া। অপর দু’জন হলেন বুড়াবিবি চৌধুরানী ও কালাবিবি চৌধুরানী। পিতার মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র মনুমিয়া। তবে তাদের জমিদারির সময়কাল সম্পর্কে, সঠিক কোনো তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি।

তবে আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিম শোলকাটা গ্রামে মনুমিয়ার রাজপ্রাসাদ ছিল। এটি প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর আগের ইতিহাস। এখন মনুমিয়ার বিশাল এই বসতভিটায় কোনো রাজপ্রাসাদ নেই। কালের পরিক্রমায় এখানে গড়ে উঠেছে পাকা,কাঁচা-পাকা ছোট-বড় অসংখ্য বসতি। তবে তার এই বসতভিটা এবং বিশাল এলাকাজুড়ে বহু স্মৃতিচিহ্ন আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। বসতভিটার সামনে এবং পেছনে তৎকালীন নির্মিত দীর্ঘ প্রাচীরের অস্তিত্ব আজও বর্তমান। পোড়া মাটির তৈরি বিশেষ ধরনের ইট দিয়ে তৈরি প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ এখনো চোখে পড়ে। এক ইঞ্চি মোটা এবং পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি চওড়া এ ধরনের ইট মোগল আমল কিংবা তারও আগের সময়কার বিভিন্ন স্থাপনায় দেখতে পাওয়া যায়।

মনু মিয়ার বসতভিটার চারপাশে প্রায় দেড় থেকে দুই হাত চওড়া উঁচু প্রাচীরের অস্তিত্ব আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও ছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে মনুমিয়ার বসতভিটা থেকে মাত্র তিনশ’ গজ সামনে রয়েছে ‘মনুমিয়ার দীঘি’ নামে প্রকাণ্ড এক দীঘি। সবুজ বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত বিশাল এই দীঘিটি আজও পর্যটক এবং পথচারীদের নজর কাড়ে।

দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মনুমিয়ার বিখ্যাত মসজিদ। মসজিদটির পরিসর ছোট হলেও এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী এবং পরিবেশ অপূর্ব। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছরের পুরনো এই মসজিদটি আজও সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার হিসেবে পিতা শেরমস্ত খাঁর চেয়েও অধিক প্রভাবশালী ছিলেন মনুমিয়া। তিনি এতই শক্তিধর জমিদার ছিলেন যে যুদ্ধে ব্যবহৃত মোগল আমলের শক্তিশালী কামান পর্যন্ত তার সমরাস্ত্র ভাণ্ডারে মজুদ ছিল। প্রায় তিনশ’ বছর পর এর প্রমাণও মিলেছে।
মনুমিয়ার ঐতিহাসিক রাজবাড়ির সামনে এবং পেছনে দুটি বিশাল পাকা গেট ছিল। দুই গেটে বসানো ছিল মস্ত বড় দুটি কামান। খুব সম্ভবত দেয়াঙ বন্দরে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হামলা এবং বহির্শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
১৯৮০ সালে মনুমিয়ার রাজবাড়ির পেছনের গেটের ধ্বংসস্তূপের নিচে তলিয়ে যাওয়া প্রায় সাত মণ ওজনের একটি কামান উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কামানটি নিয়ে যায়। বর্তমানে কামানটি নৌ-বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে।

মনুমিয়া ও মালকা বানুর প্রেম:-মনুমিয়া জমিদার বংশের পুত্র হলেও মালকা বানু ছিলেন বাঁশখালী থানার সরলা গ্রামের বিখ্যাত এক সওদাগর আমির মোহাম্মদ এর কন্যা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মালকা বানুর পিতা আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা মালকা বানু চৌধুরী। মনুমিয়া একদিন পাইক পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে জমিদারি তদারকিতে বাঁশখালীর সরলা গ্রামের সওদাগর বাড়িতে পৌঁছে সাময়িক বিশ্রাম নেন। এ সময় মনুমিয়ার নজরে পড়ে অনিন্দ সুন্দরী সওদাগর কন্যা মালকা বানু। মালকা তখন কাজির মক্তবে অধ্যয়নরত। ওখানেই মনুমিয়া এবং মালকা বানুর আঁখির মিলন ঘটে। তখন থেকেই মালকা বানুর প্রেমে পড়েন মনুমিয়া। এরপর প্রেমের টানে মনু বারবার ছুটে যেতেন মালকা বানুর বাড়িতে। অবশেষে কাজির মাধ্যমে মালকার বাবার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন মনু। মালকার বাবা সওদাগর রাজি হলেও বিয়েতে মালকা রাজি ছিলেন না। কারণ হিসেবে মালকা মনুকে বলেছিলেন সাম্পানযোগে নদী পার হতে তার ভয় করে। কারণ শঙ্খ নদীর এপারে মনুমিয়ার বাড়ি ওপারে মালকার।মালকা বানু মসজিদ
কাজেই বধূ সেজে মনুমিয়ার বাড়ি যেতে হলে উত্তাল শঙ্খনদী পাড়ি দিতে হবে। মালকার মুখে এ কথা শুনে মনুমিয়া স্থির করলেন শঙ্খের বুকে বাঁধ নির্মাণ করবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মনু মিয়া শঙ্খ নদীর বুকে নির্মাণ করলেন বিশাল এক বাঁধ। তারপর বধূ সাজিয়ে সড়কপথে মনুর রাজপ্রাসাদে এনে তুললেন প্রিয়তমা মালকাকে। জনশ্রুতি আছে মালকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিলো খুব ঝাঁকজমক পূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। আর সেই বিয়েতে বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেছেন। তারমধ্যে ‘’ মালকা বানুর দেশেরে, বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।/ মালকা বানুর সাতও ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই।/ মালকার বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথেরে।‘’ এই গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। এমনকি এখনো গ্রামে গঞ্জে গানটি বেশ লোকপ্রিয়। এ রকম আরো অজস্র কাহিনী রয়েছে মনুমিয়া-মালকা বানুর প্রেম উপ্যাখানে।
আদরের দুলারী মালকা বানুর বিয়ের পর নিঃসঙ্গ পিতা আমির মোহাম্মদ কন্যার স্মরণে বাশখালীর সরলে নির্মান করেন একটি মসজিদ ও দিঘী। যা মালকা বানুর মসজিদ ও দিঘী নামে পরিচিত । মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে। মসজিদটির গায়ে ফার্সী ভাষায় একটি শিলালিপিও রয়েছে।

Giasliton007-1476874866-4a81192_xlarge

তথ্য-উইকিপিডিয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!