মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর

 

সেলিনা জাহান প্রিয়া

সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর আথবা ২য় বাহাদুর শাহ তিনি হলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট। সিপাহী বিপ্লবের শেষে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠায়। তার পূর্ণ নাম আবুল মুজাফাফর সিরাজুদ্দীন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ গাজী। তিনি ১৭৭৫ সালের ২৪শে অক্টোবর দিল্লির লালকেল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ এবং সম্রাজ্ঞী লাল বাঈর দ্বিতীয় পুত্র। তার ঊর্ধ্বতন বংশ তালিকা বিশতম স্তরে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবুরের সাথে মিলেছে। পিতার মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ ১৮৩৭ সালে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে পিতামহ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এবং পিতা সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ উভয়ের মতো দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী ছিলেন।

তিনি বার্ষিক ১ লাখ টাকা ভাতা পেতেন। পিতার মতো বাহাদুর শাহ নিজের এবং মুঘল খান্দানের ভরণপোষণে ভাতা বৃদ্ধির জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাদশাহ উপাধি ত্যাগ এবং লালকেল্লার বাইরে সাধারণ নাগরিকের মতো জীবনযাপনের শর্তে তিনি রাজি হননি। তাছাড়া সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন নিয়েও ইংরেজদের সঙ্গে সম্রাটের মনোমালিন্য হয়। সম্রাটের ক্ষমতা এবং মর্যাদা খর্ব করতে নানা উদ্যোগ নেয় কোম্পানি। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং সম্পদ সব কিছু হারিয়ে সম্রাট প্রাসাদের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন। সে সময় অমর্যাদার মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্য তিনি গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন।

জীবনের কষ্ট এবং বিষাদ তার কবিতার মূল বিষয়। বাহাতার কবিতার ছত্রে ছত্রে দু:খ ও বিষাদের সাথে দেশ এবং জাতির পরাধীনতার কথা বিধৃত। একটি কবিতায় আছেঃ উমর দরাজ মাঙ্গকে লায়েথে চার দিন দো আরজুমে কাট গয়ে, দো ইন্তেজার মে। যার অর্থ হলো চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দুটি কাটল প্রত্যাশায় আর দু’টি অপেক্ষায়। বাহাদুর শাহ সিংহাসনে আরোহণের ২০ বছর পর সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের। পলাশী যুদ্ধের পর ১০০ বছর কেটে গেছে তত দিনে। ছলেবলে কৌশলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমগ্র ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছে। দেশবাসীর সাথে সৈন্য বিভাগের লোকদের ওপরও চলছে জুলুম, বঞ্চনা এবং নির্যাতন। একের পর এক দেশীয় রাজ্য ইংরেজ অধিকারে নিয়ে যাওয়া, লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। কারাগারে হিন্দু, মুসলমান সিপাহিদের জন্য একই খাবারের ব্যবস্খা।ঘিয়ের মধ্যে চর্বি এবং আটার মধ্যে হাড়গুড়োর সংমিশ্রণ, গরু এবং শূকরের চর্বি মিশ্রিত কার্তুজ বিতরণ ইত্যাদি ভারতবর্ষের জনমনে কিংবা সৈনিকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ভারতীয় সিপাহিদের মধ্যে ধূমায়িত বিক্ষোভ ও অস্খিরতার প্রথম বহি প্রকাশ ঘটে ১৮৫৭ সালে ২২শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দমদম সেনাছাউনিতে। সিপাহিরা ইংরেজ অফিসারকে জানায়। এনফিল্ড রাইফেলের জন্য যে কার্তুজ তৈরি হয় তাতে গরু এবং শূকরের চর্বি মেশানো থাকে এবং এতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিপাহিদের বুঝিয়ে শান্ত করেন।

কিন্তু খবরটি একে একে বিভিন্ন সেনাছাউনিতে পৌঁছে যায় এবং তা সিপাহিদের মধ্যে বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে পশ্চিমবঙ্গের সহতস বহরমপুর সেনাছাউনিতে ২৫থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি । ১৯ নম্বর পদাতিক বাহিনীর সিপাহিরা কার্তুজ নিতে অস্বীকার করেন। রাতে অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে পুরনো মাসকেট বন্দুক এবং কার্তুজ সংগ্রহ করেন। তারা ভীষণ উত্তেজিত অবস্খায় ছিল। পরিস্খিতি সামাল দিতে সিপাহিদের নিরস্ত্র এবং বরখাস্ত করা হয়। এই সংবাদও দ্রুত পৌঁছে যায় বিভিন্ন সেনানিবাসে। ২৯শে মার্চ রোববার ব্যারাকপুরের দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। মঙ্গল পান্ডে নামের সিপাহি গুলি চালিয়ে ইংরেজ সার্জেন্টকে হত্যা করেন। বিচারে মঙ্গল পান্ডে তাকে সহায়তার অভিযোগে জমাদার ঈশ্বরী পান্ডেকে দোষী সাব্যস্ত হবে। ৮ই এপ্রিল সকাল ১০টায় তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। এর পরিণতিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভারতের উত্তর থেকে মধ্যপ্রদেশ এবং জলপাইগুড়ি থেকে পূর্ববাংলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ৯ই মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন দিল্লির পথে অগ্রসর হন। ১১ই মে সিপাহিরা দিল্লি অধিকার করে বহু ইংরেজকে হত্যা এবং বিতাড়ন করেন। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা সে দিন লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেন।

সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। সে দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মান জানানো হয়। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে সংবাদে কানপুর, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠেন খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি। অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া বাদশার রাজ্য সিপাহির হুকুম। একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ইংরেজরা অতি নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে। হাজার হাজার স্বাধীনতাকামীর রক্তে রঞ্জিত হয় ভারতবর্ষের মাটি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ ছিল। কিন্তু ভারতীয়দের এই সংগ্রাম সফল হতে পারেনি। ইংরেজরা দিল্লি দখল করে নেয় এবং সম্রাট ২১ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। ইংরেজ সৈন্যরা মীর্জা মোগল, মীর্জা খিজির সুলতান, মীর্জা আবু বকরসহ ২৯ জন মুঘল শাহজাদাসহ বহু আমির ওমরাহ, সেনাপতি এবং সৈন্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সম্রাটকে বিচারের নামে প্রহসনের আদালতে দাঁড় করানো হয়। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন ।

দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী। তার শাস্তি চরম অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু তার বার্ধক্যের কথা বিবেচনা করে প্রাণ দণ্ডাদেশ না নিয়ে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। ১৮৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর আর সম্রাজ্ঞী জিনাত মহল, দুই শাহজাদা, শাহজাদী এবং অন্য আত্মীয় ও ভৃত্যদের নিয়ে ইংরেজ গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী দিল্লি ত্যাগ করেন। ৯ই ডিসেম্বর জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের ছোট গ্যারেজে সম্রাট এবং তার পরিবার পরিজনের বন্দিজীবন শুরু হয়। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন। এমন বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ সালের ৭ই নভেম্বর শুক্রবার ভোর ৫টায়। তবে সম্রাটকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে দাফন করা হয়।

কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল যা একসময় নষ্ট হয়ে যাবে ঘাসগুলো গোটা জায়গা আচ্ছাদিত করে ফেলবে। কোথায় সর্বশেষ মুঘল সম্রাট শায়িত আছেন তার চিহ্নিও কেউ খুঁজে পাবে না। ইংরেজরা খুব ভালোভাবে জানত ভারতবর্ষের জনসাধারণের মনে এই সম্রাটের প্রভাব কতখানি। ভারতবর্ষের মানুষ সম্রাটের কবরে ফাতেহা পাঠ করতে রেঙ্গুন যান ১৯০৩ সালে। কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরে তার আসল কবর আবিষ্কৃত এবং সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ সালের জুলাই মাসে।

সম্রাটের পাশেই রয়েছে তার সমাধি। সম্রাট এবং তার প্রিয়জনদের সমাধি হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে দেশপ্রেমিকদের তীর্থ স্খানের মতো। সম্রাটের ইচ্ছা ছিল স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়া। জন্মভূমির প্রতি ছিল প্রচণ্ড অনুরাগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। স্বদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ কিংবা সমাহিত হওয়ার সাধ কোনোটাই তার পূরণ হবে না।

নিদারুণ দুঃখে তিনি লিখেছেন একের পর এক কালোত্তীর্ণ কবিতা। তারই একটি নিম্নরূপঃ

মরনেকে বাদ ইশ্ক্ব মেরা বা আসর হুয়া উড়নে লাগি হ্যায় খাক মেরি ক্যোয়ি ইয়ার মে কিৎনা বদনসিব জাফর দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে,

ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেনঃ
দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে, পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে।
বাংলায় অনুবাদ করলে দাড়ায়ঃ
হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাও নি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম এবং গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে ও থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!