‘তোষামোদী’ পেশা হিসেবে নাম্বার ওয়ান!

কাজ না থাকলে ঘাস কাটা এবং খই ভাজার কথা প্রবাদে আছে। বাস্তবে কাজ দু’টি মোটেই অকাজ নয়, সহজ তো নয়ই। বাদলা দিনে অন্য কাজ যখন করা যায় না, কৃষাণীরা সাধারণত তখন খই ভাজার আয়োজন করতেন।

কৃষক ঘাস কাটার কাজটি, মূল কাজের বাইরে রাখেন।  সুবিধাজনক সময়ে গো- খাদ্য ঘাস কাটেন। গরু ঘাস সারাদিন খায় না, জাবর কাটে সারাদিন।

বাংলা একাডেমি যা করে, তার চেয়ে অনেক বেশিকিছু করার সামর্থ্য আছে। সামর্থ্যটা তারা মাঝে মধ্যে অকাজের পেছনে ব্যয় করে। ‘ঈদ’ এবং ‘ইদ’ তেমনই একটি অকাজ। কোনও প্রয়োজন ছাড়া বাংলা একাডেমি কাজটি করেছে কয়েক বছর আগে।

বাংলা একাডেমি তাদের একটি অভিধানে যে সব বানান ‘অসঙ্গত’ বলেছে, আরেকটি অভিধানে সে সব বানানকেই ‘সঙ্গত’ বলেছে। বাংলা একাডেমি ‘ঈদ’কে অসঙ্গত বললেও, কেউই মানছেন না। ‘ঈদ’ এভাবেই চলছিল। এখন বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাবর কাটা চলছে।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জাবর কাটছেন এভাবে ‘এই পরিবর্তনে এত মাতামাতি করার কিছু নেই। তবে আমার মনে হচ্ছে, জামায়াত অথবা কোনও উগ্রবাদী মতাদর্শের লোকজনের বিষয়টি নিয়ে বেশ মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।’

যে কোনও ইস্যুতে বিরুদ্ধ মত আসলেই তাকে ‘জামায়াত’ বলা একটা রোগ। শামসুজ্জামান খানও ভালোমতই এই রোগে আক্রান্ত।

০২.
আপনি মন্ত্রী, বাজেট পাসের জন্যে যে মিটিং হয়েছিল সেই মিটিংয়ে আপনিও ছিলেন। কোনও কথা বা আপত্তি তোলেননি। বাজেট পাস করে দিয়েছেন। সেই বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সংসদে।

গণমাধ্যম পুরো বাজেট নয়, সরাসরি জনস্বার্থ উপেক্ষিত দু’একটি বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেছে। সংসদে বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রীর বিষোদগার করা হচ্ছে। তারা এখনও সম্ভবত পুরো বাজেটটি পড়ে দেখেননি। পড়বেন বলেও মনে হয় না।

আপনি যদি পাস করার আগে বাজেট পড়ে দেখতেনও, বড় কোনও আপত্তি তুলতেন না। যে কারণে আপত্তি তুলতেন না, ঠিক একই কারণে অর্থমন্ত্রী বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করেছেন।

আপনি তা জানেন না তা নয়। সরকার প্রধানের না জানা মতে বাজেটে এসব বিষয় রাখা হয় না। এমপিরাও তা জানেন। তারপরও তারা বিষোদগার করছেন অর্থমন্ত্রীকে।

অর্থমন্ত্রী পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদেরও মন্ত্রী ছিলেন। এরশাদের মন্ত্রীদের এসব বিষোদগার হজম করার ক্ষমতা থাকারই কথা। মাহবুবুল আলম হানিফ কেন অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেন, বুঝতে কষ্ট হয় না।

শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করে তখন, যখন ছাত্র রাজনীতির কলঙ্ক পতিত স্বৈরাচারের সহযোগী জিয়াউদ্দিন বাবলু অশালীন ভাষায় অর্থমন্ত্রীর বিষোদগার করেন।

ডাকসুর জিএস থাকাবস্থায় বাবলু স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তার নেতা এরশাদ আদালতের রায়ে প্রমাণিত সাজাপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ। পতনের পর যার বালিশের ভেতরেও ২ কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল।

অর্থমন্ত্রী নিজে মানুষকে অসম্মান করতে পছন্দ করেন। তিনি শিক্ষিত, লেখাপড়া করা রবীন্দ্র ভক্ত মানুষ। তিনি আবার এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, যা পরস্পর বিরোধী।

তিনি বেসিক ব্যাংক ডাকাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চান, পারেন না। ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন ‘পুকুর নয়, সাগর চুরি’ হচ্ছে। সাগর চোর ধরতে পারেন না, ঠেকাতে পারেন না। রাজনীতির কারণে পারেন না, তাও বলেন। কিন্তু পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না।

মাহবুবুল আলম হানিফ প্রশ্ন তোলেন, কেন বেসিক ব্যাংককে ১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে? অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো জালিয়াতি করে কারা অর্থ নিয়ে গেল, এই প্রশ্ন কোনও দিন হানিফ তোলেননি।

গত দুই তিন বছরে এই ব্যাংকগুলোকে যে জনগণের করের ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেওয়া হলো, সেই প্রশ্নও তোলেন নি। ‘সাগর চোর’দের ধরতে না পারার কথা যখন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হানিফসহ আজকের বিষোদগার করা কোনও এমপি অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন করে কথা বলেননি।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বাজেট থেকে কিছু বিষয় বাদ দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রীর বিষোদগারকারীরা প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করবেন। অর্থমন্ত্রী কি এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন, সেই আলোচনা কেউ করবেন না।

০৩.
বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা গণবাহিনী নেতা শাহজাহান খান এখন মন্ত্রী এবং পরিবহন শ্রমিক নেতা। পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সহযোগী মশিউর রহমান রাঙ্গাও শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিমন্ত্রী এবং পরিবহন মালিক নেতা।

ড্রাইভারদের শাস্তির আইন মন্ত্রী সভায় পাস হলো তাদের উপস্থিতিতে। সেখানে কোনও কথা বললেন না। সভা থেকে বের হয়ে এসে ধর্মঘটের হুমকি দিলেন। এতে তাদের মন্ত্রী থাকতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।

০৪.
হাওরে বন্যা হলো, দায় বিএনপির। পাহাড় ধসের দায়ও বিএনপির। মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকা, বর্তমান সময়ে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসেও সর্বোচ্চ।

মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পাহাড় ধসের দায় বিএনপির উপর চাপালেও, অভিনব তত্ত্বটি হাজির করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। পাহাড় ধসের কারণ ‘বজ্রপাত’! কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও, এটাই তাদের অফিসিয়াল বক্তব্য!

হাওর থেকে পাহাড় কোথাও পর্যাপ্ত সহায়তা পৌঁছাতে পারল না সরকার।হঠাৎ করে জানা গেল শ্রীলংকার বন্যার্তদের জন্যে ৪ কোটি টাকা সহায়তা দিল বাংলাদেশ।

তদন্তে জানা গেল, লংগদুর ক্ষতি প্রায় ৭ কোটি টাকার। সেই টাকা দেওয়ার ঘোষণা নেই, শ্রীলংকার মানুষের সাহায্য করার ঘোষণা আছে।

০৫.
সৌদি বাদশাহ ডিগ্রি জারি করে যখন যাকে ইচ্ছে রাজপুত্র হিসেবে  ঘোষণা দেন। রাঙামাটির ডিসিও বলে দিলেন, অর্থ সহায়তা জেলা প্রশাসন মানে তার মাধ্যমেই করতে হবে। অন্য কারও সরাসরি সহায়তা করার সুযোগ নেই।

কোনও আইনেই তিনি একথা বলতে পারেন না। ডিগ্রি জারি করার নিয়মও নেই। পার্বত্য অঞ্চলের তাদের কথাই তো আইন!

০৬.
মির্জা ফখরুলের গাড়ি বহরে হামলা হলো রাঙ্গুনিয়ায়। হামলাকারীরা হামলার আগে- পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেদের পরিচয় পরিস্কার করেছেন। হামলা করে গিয়ে হাছান মাহমুদের সঙ্গে মাটি কাটার ফটোসেশনে অংশ নিয়েছেন।

সরকারের মন্ত্রীরা বলছিলেন তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারপর দেখা হলো, উল্টো মামলা করা হলো মির্জা ফখরুলদের নামে। তদন্ত কেমন হবে, বুঝতে কারোরই কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

০৭.
রামপালে ‘সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’ দিয়ে সব দুষণমুক্ত করা হবে, কত কথা যে বলা হলো! তারপর একদিন প্রকল্পের এমডি বললেন, ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে কিছু পৃথিবীতে নেই।’ অসত্য কথা  দেশী- বিদেশী যে কেউ অবলীলায় বলে দিতে পারেন এদেশে।

সরকার এখনও আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যালের গান গাইছে। প্রকল্পের জন্যে যন্ত্রপাতি আমদানির টেন্ডারে ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ প্রযুক্তির উল্লেখ নেই। কিন্তু পেছন দিয়ে পাহাড় ঠেলা বন্ধ হয়নি সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্টদের।

০৮.
রথযাত্রায় মাইক ব্যবহার করা যাবে না। সব সময় এদেশে নামাজ- রোজা- ঈদ, রথযাত্রা পাশাপাশি চলেছে। ‘এগিয়ে যাওয়া দেশ’- এ তা চলতে পারবে না। ধর্মীয় উগ্রতা ছাড়া এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।

প্রায় সব ক্ষেত্রে অন্যায়- অনিয়ম নিয়মে পরিণত হচ্ছে। কাজ বাদ দিয়ে, অকাজের পেছনে সময় ব্যয় হচ্ছে। সঙ্গতির স্থান দখল করে নিচ্ছে অসঙ্গতি। সবচেয়ে লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছে ‘তোষামোদী’! ‘মোসাহেব’দের জয়জয়কারের বাংলাদেশ!!

গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!