মুক্তিযুদ্ধে পাবনা-যেমনটি মনে পড়ে (এক)

সিডনীর কথামালা-৫৮

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com

 

সারা বাংলাদেশেরে মতই পাবনার অকুতোভয় তরুণেরা বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সর্বাত্মক সাড়া দিয়ে ঐ কর্মসূচীকে সফল করে তুলেছিলেন। বস্তুত: সকাল ১০টা ১১টা থেকে শুরু করে প্রতিদিন সকালে এক দফা আবার বিকেল ৫টা থেকে আর এক দফা মিছিল-সভা-সমাবেশ নেতা-কর্মী-সাধারণ মানুষের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণে এক অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনছিল অসহযোগ আন্দোলনে। সবার দাবীই ছিল নির্বাচনী ফলাফল কার্যকর কর বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দাও। এ দাবীতে নাছোরবান্দা হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র বাঙালী জাতি ঐ দাবীতে এক সুকঠিন সুদৃঢ় গণ-ঐক্য গড়ে তুলে।

পাবনাতে ভিন্ন এক কারণে এই অসহযোগ আন্দোলন নতুন মাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো। পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক, সি এম পি অফিসার নূরুল কাদের খান এই অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে পাবনা কালেক্টারেটের সকল কর্মকর্তা- কর্মচারী নিয়ে ঐ আন্দোলনের অংশ গ্রহণ করেন। ফলে বাদ-বাকী সরকারী বেসরকারী অফিসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অনুরূপ ভূমিকা পালনে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরাও অসহযোগ আন্দোলনে অংশীদার হন।

এরই প্রতিফলন পড়তে দেখা যাচ্ছিল পাবনার রাজপথে। নিত্যদিন। প্রতিদিন। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ওয়ালি-মোজাফ্ফর), ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, শ্রমিক সংগঠন সমূহ কখনও একত্রে কখনও বা পৃথক পৃথক ভাবে মিছিল সমাবেশ করে ঐ একই দাবী উত্থাপন করতো।

ব্যাংক-ইন্সিউরেন্স ও অপরাপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিতেও চলছিল বঙ্গবন্ধুর দৈনন্দিন দেওয়া নির্দেশাবলী মোতাবেক। শুধু ব্যাংক ইন্সিওরেন্স বা অফিস আদালত নয়-গোটা দেশের সকল কিছুই চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলী অনুযায়ী। এক মুকুটহীন রাজা যেন। কল-কারখানা বড় বড়  দোকানপাট সবই।

ফলে পাকিস্তান সরকার পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হলো বাঙালিদের দ্বারা।

এই অসহযোগ আন্দোলন চলতে চলতে অন্যান্য অনেক জেলার মত পাবনা শহরেও ২৫ মার্চ গভীর রাতে প্রায় ২০০ শত পাক সেনা ট্রাক যোগে ঢুকে পড়ে। তারা প্রথমে দখল নেয় ওয়াপদা ভবনে(সার্কিট হাউসের কাছাকাছি)। ঐ ট্রাকে তারা তাদের পাবনার হেডকোয়ার্টারে পরিণত করে। সেখানেই টর্চার সেলও তৈরী করে এক বা একাধিক কক্ষে।

ঐ রাতেই তারা দখল নেয় পাবনার পুরাতন টেলিফোন একচেঞ্চ ভবন। দখল নিয়েই তারা সরকারী বেসরকারী অফিস-আদালত-বাসভবন সমূহের তাবৎ টেলিফোন সংযোগ ভিছিন্ন করে দেয়। ঐ আমলে মোবাইল ফোন আবিস্কৃত হয় নি-তাই যোগাযোগের একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বস্ত লোক মারফত চিঠি বা মুখে মুখে।

২৫ মার্চে অন্যান্যদের মত সারাদিন মিছিল-মিটিং করে ঘুমিয়ে পড়ি ক্লান্ত দেহে। ফলে উঠতে বিলম্ব হয়। যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেটা সহরতলী বলা যায় শহরের প্রাণ কেন্দ্রে নয়। ফলে আমি আমার বা ঢাকাতে ঐ রাতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলীর কোন কিছুই জানতে পারি নি।

ভোরে এসে কড়া নাড়লেন পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা কছিম উদ্দিন আহমেদ। তিনি পরে শহীদ হন। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে চোখ ডলতে ডলতে উঠে দরজা খুলে দেখি বাসার ভেতরে সাইকেলে হাত রেখে মওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে। তাড়াহুড়া করে চেয়ার টেনে দিলাম কিন্তু তিনি বসলেন না। শুধু বললেন, গভীর রাতে সেনাবাহিনী এসে গেছে শহরের কারফিউ ঘোষণা করেছে। তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও আশ্রয় নাও-বাসায় থাকা তোমার পক্ষে
নিরাপদ হবে না।

আবারও তাঁকে বসতে বললে পুনরায় অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বললেন, আমি অনেক জায়গায় যাব কারণ অনেকেই খবরটা জানেন না। সকলকে খবর পৌঁছাব – বলেই চলে গেলেন সাইকেল চালিয়ে।

চিন্ত-ভাবনা করে সকালের নাস্তার পর সামান্য কয়েকটা জামা-কাপড় নিয়ে রাস্তার অপর ধারে পূরবীর (আমার সহধর্মিনী) এ বান্ধবীর বাসায় গিয়ে উঠলাম। তাঁরা দোতলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন ২৬ মার্চ সকাল।

বাসা বদলের সামান্য আাগে প্রতিবেশী এক দারোয়ান এসে জিজ্ঞেস করলেন, রেডিওতে সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবিলম্বে কাজে যোগদানের কথা বারবার নির্দেশ আকারে প্রচার করছে। এমতাবস্থায় অসহযোগ আন্দোলনেই থাকবো না কি কাজে যোগ দেব জিজ্ঞেস করতেই তাঁকে বললাম-খবরদার কাজে যাবেন না-অসহযোগে থাকুন তবে সপরিবারে বাসাটা অস্থায়ীভাবে বদল করুন।

রেডিও খুলে আকশবানীতে শুনলাম “আমার সোনার বাংলা” গানটি-যা বারবার প্রচার করা হচ্ছে আকাশবানী থেকে। খবরে বলল-হাকরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলি, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স ও পিলখানায় ই,পি,আর হেড কোয়ার্টার্স অতর্কিত বোমা ও গুলিবর্ষণ করে পাক-সেনারা গুড়িয়ে দিয়েছে। গভীর রাতের এই আকস্মিক হামলায় হতাহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে না জানা গেলেও অসংখ্যা হতাহত হয়েছেন ঘুমন্ত অবস্থায় বলে জানা গোছে।

এরপর পাবনা শহরের ঘটনাবলী দ্রুত এগুতে থাকে। ছাত্র নেতারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বৈধ অবৈধ অস্ত্র মালিকদের কাছে চেয়ে নিতে শুরু করেন-তাঁরাও বিনাবাক্য ব্যয়ে অস্ত্রগুলি দিয়ে দেন। গোলাগুলি সমেত।

ওদিকে ঐদনিই সন্ধ্যাপর গ্রেফতার হয়ে যান পাবনা সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদ এম.পি.এ আমিন উদ্দিন, ভাষানী ন্যাপের সভাপতি জনপ্রিয় দন্তচিকিৎসক অমলেন্দু দাক্ষী, পরিবহন ব্যবসায়ী আবু সাঈদ তালুকদার সহ অনেকেই। এঁদেরকে নিজ নিজ বাড়ী থেকেই তুলে নিয়ে যায়। তবে বাদ-বাকীরা বাসায় থাকেন নি। পথে ঘাটেও গ্রেফতার শুরু হয়ে যায়।

অপরদিকে সামরিক কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসকের বাংলোতে গিয়ে তাঁকে সামরিক অভিযানের সাথে সহযোগিতা করতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে আছি। পুলিশ সুপারও সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান।

অত:পর জেলা প্রশাসক রাতের অন্ধকারে তাঁর পরিবার সহ চলে যান পদ্মার চরে। ধীরে ধীরে সেখানে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতৃবৃন্দ ও কাতপিয় ছাত্র নেতাও উপস্থিত হন। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম.এন.এ আমজাদ হোসেনকে আহ্বায়ক জেলা প্রশাসক নূরুল জাদেরকে সম্পাদক, আব্দুর রব বগামিয়া, আমিনুল ইসলাম বাদশা, রণেশ মৈত্র, ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম প্রমুখ সহ একটি জেলা হাইকান্ড গঠিত হয় চরে বসেই যাতে দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাক-বাহিনী পুলিশকে নিরস্ত্র করে কাজে যোগ দেওয়াতে বাধ্য করতে পারে এমন একটি খবরের প্রেক্ষিতে পাবনা পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে যথা-জেলখানা, প্রধান ডাকঘর, জজকোর্টে, আইনজীবীদের বার লাইব্রেরী, রেজিষ্ট্রেশন অফিস প্রভৃতির ছাদে অস্ত্র সজ্জিত তরুণের দল, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি সার্কিট হাউসের দিক থেকে আসার প্রধান সড়কের দিকে বন্দুক তাক করে শুয়ে থাকেন। এলিং করার মত।

খবরটা সত্যে পরিণত হলো।

মাগরিবের নামায শেষ হতে না হতেই নানাবিধ আধুনিক অস্ত্র তাক করে ট্রাক বোঝাই পাক-সেনা তাদের হেড কোয়াটার থেকে (পানি উনড়বয়ন বোর্ড কার্যালয়) পুলিশ লাইনের দিকে আসতেই উপর থেকে নানা ছাদে অপেক্ষমান প্রতিরোধ যোদ্ধারা ঐ ট্রাক বহর লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করায় দ্রুত তারা ট্রাক ঘুরিয়ে সৈন্যরা ফেরত চলে যায়, ট্রাকে কিছু আহত-নিহত সেনাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। গুলি উভয় পক্ষই চালায় ফলে সরারটি শহর কেঁপে ওঠে।

অচিরেই জানাজানি হয় পাক সেনারা পালিয়েছে পাবনাবাসীর প্রথম বিজয় সূচিত হলো।

পরদিন ২৮ মার্চ পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে দিয়ে যুব সমাজের মধ্যে তা বিলি করা হয় এবং একই পদ্ধতিতে আক্রমন করা হয় পুরাতন টেলিফোন একসচেঞ্জ ভবনকে। সকাল ১০টার পর দিকে প্রতিরোধ বাহিনী পাশ্ববর্তী সকল ছাদ থেকে গুলিবর্ষন শুরু করে বেলা ১১- ৩০টার ১২টার মধ্যে ঐ ভবনে (একতলা) অবস্থানরত প্রায় ৩২ জন পাক সেনার সকলকে হত্যা করে দ্বিতীয় বিজয় অর্জিত হয়। সৈন্যদের কাছে থাকা চাইনিজ রাইফেল থেকে শুরু করে যাবতীয় অস্ত্র হস্তগত হয় আমাদের অকুতোভয় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের।

অপরদিকে শহরের পূর্ব প্রান্তে এক বিশাল মাঠের মধ্যে কৃষি ক্ষেতে সেচের পানি সরবরাহের পাম্প হাউসের (সাদা ছোট দালান) অভ্যন্তরে ৪ জন সেনা অস্ত্রসহ অবস্থান করছিল পাবনা নগরবাড়ি রোডে যাতায়াত/গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। ওখানে আক্রমন চালালে অকস্মাৎ সবাই একসাথে খুড়মুড় করে রেরিয়ে অজানা উদ্দেশ্যে দৌড়ে এক গ্রামে গিয়ে দুপুরবেলায় ক্লান্ত দেহে পানি চাইলে গ্রামবাসী খাওয়ায় এবং আতর্কিতে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের সকলকেই আক্রমন করে হত্যা করে।

এটিকে তৃতীয় বিজয় বলা যায়- এবং ২৮ মার্চের দ্বিতীয় বিজয়।

পরদিন ২৯ মার্চ এ অধ্যায়ের সমাপ্তি সূচিত হয়। সেদিন হঠাৎ করে আকাশে একটি বিমান পাবনা শহরের উপর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চক্কর দিতে থাকে। প্রতিরোধ যোদ্ধারা বিমানটির দিক তাক করে অনবরত গুলি ছুঁড়লেও একটিও ঐ উড়ন্ত বিমানের গায়ে লাগেনি। বিমান থেকে অনবরত গোলাবর্ষন হচ্ছিল। কিন্তু কেন এমন হলো হঠাৎ?

পাক-বাহিনীর পাবনাস্থ হেড কোয়ার্টারেরে কথা আগেই বলেছি। সেদিন ঐ ওয়াপদা বিল্ডিংস ছাড়া আর কোথাও একজন পাক-সেনাও অবশিষ্ট ছিলো না। আর ঐ হেড কোয়ার্টার্স ছিল চরের হাজার হাজার কৃষক দ্বারা ঘেরাও হয়ে। যতই ঐ ঘেরাও করা মানুষগুলি “জয়বাংলা” শ্লোগান দিচ্ছিল ততই ওয়াপদার ভেতরে অবস্থারত পাক-সেনারা আতংকে কেঁপে উঠছিল।

ওদিকে বিমান থেকে গোলাবর্ষনের ফলে ঘেরাও করা কিষানেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। অপরদিক থেকে কয়েকটি ট্রাক সাদা পোষাকধারী কিছু যাত্রী নিয়ে কণ্ঠে “জয়াবাংলা” শ্লোগান দিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে ঐ আর্মি হেডকোয়ার্টরের সাদা পতাকা উড়িয়ে ঐ আর্মি হেডকোয়র্টারের সামনে এসে থামলে সাথে সাথেই ভেতর থেকে সেনারা দৌড়ে এসে তাতে উঠে পড়বার সাথে সাথে ট্রাকগুলি পেছন দিকে ঘুরিয়ে তাদের গন্তব্যের পথে ছুটতে থাকে।

ট্রাকে ওঠায় পূর্বমুহুর্তে তারা ২৬মার্চ ও পরবর্তীতে আটককৃতদের মধ্য থেকে এডভোকেট আমিন উদ্দিন আমলেন্দু দাক্ষী, সাঈদ তালুকদার সহ কয়েকজনকে হত্যা করে বাকীদেরকে আটক রেখে চলে যায়। আসলে বিমানটি air-coverage আর সাদা পতাকা “জয় বাংলা” শ্লোগান বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দিচ্ছিলো।

কিন্তু দ্রুত ট্রাকগুলি যখন ঐ পক্ষেই সৈন্যদেরকে নিয়ে রওনা হয়-তখন দেখে পথে পথে ব্যারিকেড আর এদিক সেদিক থেকে হতে থাকে গুলিবর্ষন উভয় তরফ থেকে গুলিবর্ষনের ফলে হতাহত হয় উভয় তরফেই। এ ভাবেই, বিশেষ করে নির্মিত ব্যরিকেডগুলির কারণে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখতে হয়। আর পুরো সময়টা জুড়েই গুলি খেতে খেতে মরতে মরতে নাটোরের গোপালপুরে গিয়ে শেষ সেনাটি সদস্যও নিহত হয়।

এভাবেই ২৫ মার্চ রাতে পাবনাতে আনা ২০০ পাক-সেনারা সকলেরই নিধন পক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। সূচিত হয় পাবনার ঐতিহাসকি বিজয়। তাই অনেকেই মত পোষণ করেন ২৯ মার্চেই হলো পাবনা মুক্ত দিবস।

বিজয়ানন্দে একদিকে মানুষ যেমন হয়ে ওঠে মাতোয়ারা তেমনি নেতৃবৃন্দ তথা হাইকমান্ড ভাবতে বসেন, দ্বিতীয় দফা-আক্রমন হবে ভয়াবহ যা প্রতিরোধ করার মত সামরিক শক্তি হতে নেই। যে অস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধা যুবক , পুলিশ আনসারদের হাতে আছে তা দিয়ে দ্বিতীয় দফার সম্ভাব্য/সুনিশ্চিত রোধ করা অসম্ভব। অপরদিকে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধান, বাজারে প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করণ প্রভৃতিও বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

সবদিক চিন্তা করে শহরবাসীকে গ্রামে যার যেখানে সম্ভব নারী-শিশু-পুরুষ সহ চলে যাওয়া এবং শহরের নিরাপত্তা বিধান সর্বাগ্র গণ্য হয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ গ্রামের দিকে শ্রোতের মত ছুটতে থাকেন। পথে পথে অপূর্ব দৃশ্য। কৃষকেরা দুধ, কলা, মুড়ি, মুরকি, চিড়া নিয়ে রাস্তার ধারে বসে আছেন-যার প্রয়োজন তাকেই দিচ্ছেন বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র দামে। কেউ জানতেও চাইছে না কার কি নাম- কে হিন্দু, কে মুসলমান। গ্রামাঞ্চলে সকল সচ্ছল বাড়ীতে আশ্রয় হলো ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে। সে এক অপূর্ব দৃশ্যই বটে। যা আজ আর চোখে পড়ে না হাজারো বিপদেও।

প্রতিরোধ যোদ্ধারা শহর পাহাড়া দায়িত্বে। শহরের বা গ্রামে কোথাও চুরি, ডাকাতিঅপহরণ ধর্ষণ কোন কিছুই ঘটছে না। আশ্রয়দাতাদের বাড়ীতে ভাত-তরকারী-ডাল-রুটি রান্না হচ্ছে দফায় দফায়-আশ্রিতেরা খাচ্ছেন আর জিপে করে পাঠানো হচ্ছে শহরে প্রতিরোধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে।

এই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে মানুষের ভালবাসা, ত্যাগ, আদর-আপ্যায়ন ছিল তুলনাহীন-যা আজ কল্পনাতেও আনা কঠিন।

অপরদিকে পাকিস্তানী নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে স্বাধীন পাবনা প্রশাসনের তরফ থেকে। জেলা প্রশাসক বিশেষ সীলমোহর তৈরী করে কাগজে সেই সীল ও স্বাক্ষর দিয়ে নোট নিয়ে বাজারে ছাড়লেন-যা সহজেই বিনিময় যোগ্য স্বাধীন পাবনার বৈধ currency তে পরিণত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশাসন তথ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এই পর্যায়ে জেলা হাই কম্যান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারত থেকে কিছু ভারী অস্ত্র শস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষক এনে পাবনার হাজার হাজার যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যাতে দ্বিতীয় দফার আক্রমন প্রতিরোধ করা সম্ভাব হয়।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত এডভোকেট আমজাদ হোসেন এবং ন্যাপ নেতা এডভোকেট রণেশ মৈত্রকে কলকাতা পাঠানো হয়। এই দায়িত্ব নিয়ে আমরা পহেলা এপ্রিল জীপযোগে ভোরে রওনা হয়ে ভেড়ামারা পৌঁছাই পরদিন ২ এপ্রিল কলকাতা। সেখানে ভারতের কমিউনিষ্ট পাটির্পর তৎকালীন পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য সম্পাদক কমরেড বিশ্বনাথ মুখার্জি, কমরেড ইলামিত্রের স্বামী প্রমুখের সহায়তায় মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর সাথে সাক্ষাত করি। এ পর্যন্ত এগুতে ৭ এপ্রিল পর্য্যন্ত লেগে যায়।

মুখ্য মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভূক্ত। তবে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানীয় হামলা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মাত্র ৩/৪ দিন আগে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করায় ঐ দিন পর্যন্ত দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী সাথে তাঁর হটলাইন সংযোগ স্থগিত হয়নি। হলেই তিনি বিষয়টি নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করে আমাদের জানাবেন। রেখে দিলেন আমাদের ঠিকানা ও ফোন নং।

আমরা চলে এলাম ফিরে কালীঘাটের আমার খুড়তুতো ভাই পরিমল মৈত্রের বাসায়। ওখানেই উঠেছিলাম দুজনই কলকাতা পৌঁছে ২ এপ্রিল তারিখে।

ইতোমধ্যে আকাশবানীর খবরে জানলাম ১০ এপ্রিল পাবনার পতন ঘটেছে। নগরবাড়ী ঘাট দিয়ে সুসজ্জিত পাক সেনাদের বিশাল বাহিনী দুই ধারে বারুদ ও গান পাউডার ছিটিয়ে হাজার হাজার ঘরবাড়ী পুড়িয়ে ছাই করতে করতে এবং একই সাথে নিরীহ লোকজনকে গুলি করে হত্যা করতে করতে পাবনা শহরে এসে শহর পুর্নদখল করেছে।

অপরাপক্ষে সিন্ধান্ত মোতাবেক আমরা উভয়েই আমাদের পরিবার পরিজনকে গ্রামে রেখে “মুক্তিযুদ্ধের কাজে যাচ্ছি ৩/৪ দিন পরেই ফিরবো” বলে চলে গিয়েছিলাম কোথায় যাচ্ছি সেই গন্তব্যস্থল গোপন রেখে।

এর পরের কাহিনী ব্যক্তিগত ভাবে অনেকটাই অজানা কারণ দেশে ফিরেছি ২৫ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনেরও দিন দশেক পর। অভ্যন্তরের ঘটনাবলী অনেকাংশেই অজানা। তবে যতটুকু সম্ভব-পরবর্তী অধ্যায়ে তা প্রকাশ করবো।

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব কাগজ২৪এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!