তিস্তাচুক্তি ও ভারতে বিজেপির ক্ষনগণনা

 

তিস্তাচুক্তি ও ভারতে বিজেপির ক্ষনগণনা

(সিডনীর কথকথা-২)

রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

যতদুর আবাস পাওয়া যায়, শীঘ্রই বাংলাদেশ ও ভারতের মধে ̈ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তিস্তাচুক্তি সম্পাদিত হতে চলেছে । এমন বার্তাই না কি বয়ে এনেছিলেন, ভারতের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জী। শুনা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এমন বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এরই প্রেক্ষাপটে শীঘ্রই বাংরাদেশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আট সদস্যর এক প্রতিনিধি দল বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য দিল্লী ও কলকাতা সফরে যাচ্ছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেল।

খবরটি সত্য হলে অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হবে। তিস্তার জল যদি উপযুক্ত পরিমাণে বাংলাদেশ পায়, এদেশের কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার, নৌ-যোগাযোগের ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিস্তর উন্নতি সাধিত হবে। সুতরাং ঐ প্রতিনিধিদলেরর প্রস্তাবিত ভারত সফরের অগ্রিম সাফল্য কামনা করি।
কিন্তু এর পরেও পুরোপুরি নিশ্চিতও হওয়ার সময় বোধ করি এখনও আসে নি। কারণ ভারতের সাবেক প্রধান মন্ত্রী মন মোহন সিংহের ঢাকা সফর কালে দীর্ঘকাল আগেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার সুনিশ্চিত সম্ভাবনা যাঁর কারণে বাতিল হয়ে গিয়েছিল সেই পশ্চিম বাংলার মুখ্য মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কি তাঁর মতের পরিবর্তন সাধন করেছেন? দিল্লীতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার তো বহুআগে থেকেই সম্মত কিন্তু মমতার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত না জেনে বাংলাদেশর জনগণ নিশ্চয়ই চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন না। বাংলাদেশ সরকারও নিশ্চয়ই মমতা ব্যানার্জির সুস্পষ্ট মতামত অবহিত না হওয়া পর্যন্ত তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন না।। তাই এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু এখনই বলার সুযোগ নেই।

তবে প্রণব মুখার্জির সফর এবং তাঁর কথিত বক্তব্যকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। জানা যায় ইতোমধ্যে জনতার পর্য্যায়ে ভারতের সকল অঞ্চলের মানুষই ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে চিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করুক-সর্বসম্মীতভাবে এমনটি চাইছেন। জনমতের এই চাপ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে পড়ছে বি.জে.পি এবং তৃণমূল উভয় মহলে। এই পরিস্থির সাথে বছর খানেকের মধ্যে ভারতের লোকসভা নির্বাচনাও বিবেচ্য। ফলে মোদির সরকার ভালভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চান মমতা ব্যানার্জির এ ব্যাপারে আপত্তির কারণ। জানা যায়, মমতা বলেছেন, শুকনা মওসুমে তিস্তার জল বাংলাদেশ যেমন পায় না – তেমনই পশ্চিমা বাংলাও তা পায় না। এমতাবস্থায় পশ্চিম বাংলার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তিস্তার জল যদি বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। সুতরাং তিনি পশ্চিম বাংলার জন্য ও শুকনা মওসুমে প্রয়োজন মাফিক তিস্তায় জল পাওয়ার নিশ্চিয়তা চান এবং তা পেলে তাঁর কোন আপত্তি থাাকবে না। তিস্তা স্বাক্ষরে একথাও জানিয়ে দেন।

মমতা আরও অভিযোগ করেছেন, সিকিম তিস্তা নদীর উপর বিগত বছরগুলিতে বিস্তর বাঁধ নির্মাণ করায় এবং বেশ কয়েকটি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করায় তিস্তার জল পশ্চিম বঙ্গ ও বাংলাদেশ পাচ্ছে না। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত সিকিমের সাথে বিষয়টি ফয়সালা করা।
কেন্দ্রীয় সরকার এই তথ্য পেয়ে তা যাচাই করে তথ্যের সত্যতা পেয়ে সিকিমকে অত জল না নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে পশ্চিমবাংলা ও বাংরাদেশের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জল সরবরাহের ব্যবস্থা না কি প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছেন। এই পরিস্থিতিতেই মোদির অনুরোধ করে প্রণব মুখার্জীকে তাঁর ঢাকা সফর কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তা অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি ঐ শুভ বার্তা বহনে রাজী হন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে ভারতের রাজনীতিতে নতুন করে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছেন। বছর খানেক পরেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ঐ নির্বাচনে বি.জে.পি. পুনরায় নির্বাচিত হয়ে দিল্লীর সিংহাসন দখল করতে পারবে কি না প্রাসমিক লক্ষণগুলি দেখে তা নিয়ে বি.জে.পি ও তার মিত্র মহলগুলিতে রীতিমত সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

লক্ষণগুলি হলো গুজরাতে অনুষ্ঠিত বিধান সভার সাম্প্রতিক নির্বাচনে বি.জে.পি ও কংগ্রেস সম-সখ্যক আসনে জয়ী হওয়া এবং অতি কষ্টে ঐ রাজ্যে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়াতে বি.জে.পির নিজের ঘরেই তার জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার প্রমাণ মিললো। এমনটিই প্রায় ঘটেছে আরও একটি রাজ্যে। অথচ এর আগের বারের নির্বাচনে গুজরাতের প্রায় সবগুলি আসনেই বি.জে.পি বিপুল ভোটাধিক্যে জিতেছিল।

অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে মধ্য প্রদেশের ১৯ টি পৌরসভার নির্বাচন। এত বি.জে. পি. কোন ক্রমে মাত্র নয়টি (ইতি পূর্বেকার সবকটি পৌরসভায়) পৌরসভা ধরে রাখতে পেরেছে-বাকী নয়টিতে জিতেছে কংগ্রেস। ফলে কগ্রেস যেখানে ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য গুলি প্রায় পূরোপূরি হারিয়েছিল-তার জনপ্রিয়তা যেমন শূণ্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল-সেখান থেকে আজ ভারত জুড়ে কংগ্রেসের পালে নতুন করে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে দ্রুত বেগে।
আসন্ন বিধান সভা ও পৌর নির্বাচনগুলির নির্বাচনেও যদি একই হাওয়া বইতে দেখা যায় তবে নিশ্চিতই বলা যাবে আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জন্য খরব আছে।
̄স্বভাবত:ই বিজেপি উদ্বিগ্ন এবং সে কারণে দলটিকে জনপ্রিয় ইস্যু গুলি দ্রুত জনতার চাহিদা মোতাবেক পূরণ করার তাগিদ সৃষ্টি হচ্ছে। তেমনতি আজ ভারতে একটি জনপ্রিয় আকাংখা হলো ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে দ্রুত চিস্তা চুক্তি সম্পাদন করুক। এটি আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও সিকিম তিস্তার জল টেনে নেওয়ার বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় তুলনা মূলকভাবে অনেক বেশী জল পাওয়ার সম্ভাবনার সৃষ্টি হওয়ার ফলেই তিস্তা চুক্তি সম্পাদন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিষয়টি অবশ্য স্পষ্ট করে জানা যাবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের ভারত সফরের পরিণতি দেখে। তবে এখন পর্য্যন্ত ইতিবাচক প্রবণতা বা লক্ষণ সমূহই বেশী। তদুপরি উভয় দেশেই সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। ভারতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই ইস্যুটি সমাধানের আগ্রহ যেমন সে দেশের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তেমনই আবার তা সমভাবে প্রযোজ্য বাংলাদেশের ক্ষমতাশীন সরকারেরও। কারণ তিস্তা চুক্তি বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সম্পাদিত হলে আসন্ন নির্বাচনে তা আওয়ামী লীগের অনুকূলে ব্যাপকভাবে কাজ করবে সন্দেহ নেই। তাই দুই সরকারেই আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ব্যপারে।

কামনা করবো এই সম্ভাবনা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আলোচনার মুখ দেখুক। কারণ তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার বিরাজমান সুসম্পর্ক নতুন উচ্চতার উন্নীত হওয়ার সমূই সম্ভাবনা। এই দুই ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্রমে উন্নয়নের লক্ষ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন করে প্রসারিত হতে পারবে-পারস্পারিক স্বার্থে লিপ্তে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য ভারত বাংলাদেশে এক অনুকূল পরিস্থিতি পেয়ে যাবে বাংলাদেশের বেকারত্ব হ্রাসের ক্ষেত্রে ঐ শিল্প কারখানা গুলিতে
বাংলাদেশী শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

এই দুই নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্টেধর মধ্যেকার সম্পর্ক যত বেশী উন্নত হবে ততই উভয় রাষ্ট্রের বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ও উন্নয়ন ঘটায় সম্ভাবনা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও দুটি দেশেই ক্রমান্বয়ে কমে আসার সম্ভাবনাও প্রবল। কারণ অতীতে বহুবার দেখা গেছে যখনই দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে উগ্র সাম্প্রদায়িক হানাহানি তখন বৃুদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি তাই দুদেশের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্নয়ন নয়-অবনতিই কামনা করে থাকে সর্বক্ষণ।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত রোগীরা প্রয়োজনে ভারতে যাওয়ার বা ক্ষেত্রে বিশেষে চিকিৎসক বিনিময় ও নতুন নতুন হাসপাতাল গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ভারত বাংলাদেশেকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা দান করতে পারে।

ক্রীড়া-বিশেষ করে হাল আমলের অতিশয় জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরী ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ভারতের কোচ নিয়োগ বাংলাদেশের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পাবে। উভয় দেশের মধ্যে ক্রিকেট প্রতিযোগিত বৃদ্ধির দ্বারাও দু’দেশই উপকৃত হতে পারে।

উভয় প্রতিবোশীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের অধিকতর বিনিয়ম দুদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন পথ উন্মোচন করতে পারে।

প্রতিশেষে বলতে চাই, হয়তো এই নিবন্ধে অতি মাত্রায় প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। অনেকাংশে তা স্বীকার করে নিতেও দ্বিধা নেই। তবে একথাটি মানতেই হবে যে দু’দেশের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ এবং সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে পারস্পারিক সম্পর্কের যে উন্নয়ন ঘটেছে-তার আরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তি নিয়ে অত্যাধিক বিলম্ব ঘটায় তা বিঘ্নিতও হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে। সুতরাং এই চু৩ি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের বহুমাত্রিক অগ্রগতি যে কোন সুষ্ট চেতনা সম্পন্ন মানুষেরই প্রত্যাশা।


 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

 

কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!