“মসজিদের গায়ে লেখা প্রভুকে প্রনাম কর!” মসজিদটি পরিচালনাকারী একটি হিন্দু পরিবার

 

 

অনলাইন ডেস্ক  কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

বড়ই অদ্ভুত এই পৃথিবী তারচেয়েও অদ্ভুত এই জগতের মানুষ। আর এই বিচিত্র জগতের মানুষদের ভিরে বোস বাবুদের মতো মানুষ যদি একটি করে প্রতিটি সমাজে থাকতো তবে এই সমাজের রুপ কতই না সুন্দর হত তা এই লেখাটি না পড়লে কেও জানবেই না, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার একটি ছোট শহর বারাসাত। শহরের কাছেই ছোট একটি মসজিদ সবাই চেনে ‘বোসবাড়ির মসজিদ’ হিসেবেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। সেসময় কেনা জমিতে থাকা ভাঙাচোড়া এই মসজিদ এখন চকচকে করেছে এই বোস পরিবার। আর এতটাই মিশে গেছেন যে, রমজান মাসে নিয়মিত রোজাও রাখছে এই পরিবারটি।

এখন এই মসজিদের তদারকি করেন পরিবারের ছেলে পার্থ সারথি বোস। ৪০ বছর বয়সী পার্থ সারথিকে বন্ধুরা মজা করে ডাকে ‘মো. পার্থসারথি বসু’। তাতে কী? যায় আসে না তার। মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে ঘড়ির সময় দেখে মসজিদে বসে ইফতার সাড়েন পার্থ সারথি।

তাদের বাড়ির আশপাশে মুসলিম পরিবারের বাস নেই। কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকে আসে রোজাদাররা। তাদের জন্যও ইফতারের আয়োজন করেন পার্থ সারথি। এই আয়োজনে সহযোগিতা করেন মসজিদের আশপাশের হিন্দু পরিবারগুলোই। কেউ বোতল ভরে পানি দিয়ে যান। চলামন অসহযোগ-সহিংসতা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। মসজিদের পাশেই গড়ে আম-লিচুর মস্ত বাগান! সেখানেই আয়োজন হচ্ছে দুর্গাপূজার। জুম্মার জমায়েত, মসজিদের ছাদের ইফতার, রমজানের তারাবির নামাজ বা কোরান তেলাওয়াতে কখনও কোনো সমস্যা হয়নি।

partho-sarothi

বারাসাতে পশ্চিম ইছাপুরের নবপল্লীতে ২০ থেকে ২৫ বিঘা জমি জুড়ে বোসেদের বিষয়-আশয়। বাড়ির বুড়ো দীপক বসু কালীপুজোয় বাড়িতে উপোস করেন। কিন্তু এই ৬৭ বছর বয়সেও রোজ সকাল-বিকাল মসজিদে হাজির হন। সকাল ৭টায় নিজের হাতে মসজিদের মেঝে ঝাড়পোঁছ করলেই মেলে তার শান্তি। এই বয়সে নিজে রোজা রাখতে পারেন না। কিন্তু তার ছেলে পার্থ সারথি ওরফে ‘বাপ্পা’র ফাঁকির জো নেই।

‘ওরা সারা দিন জলস্পর্শ না-করে আছে, আমি কী করে খাই!’ ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর হল পার্থও রোজা রাখতে শুরু করেছেন। স্বামীর ইচ্ছাকে সম্মান করে সেহরির আগে চা-রুটি করে দিতে রাত ২টায় ঘুম থেকে ওঠেন পার্থর স্ত্রী পাপিয়া। গত বছর রমজানে ব্যবসার কাজে হিন্দুদের তীর্থ ‘হৃষিকেশে’ অবস্থান করছিলেন পার্থ। সেখানেও নিয়মিত রোজা রেখেছেন তিনি। খুলনার এই বসু পরিবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে যাওয়ার সময়ও ভাবেনওনি, তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে একটি মসজিদ।

দীপক বসুর বাবা নীরদকৃষ্ণ বসু খুলনার ফুলতলার আলকাগ্রামের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের গেজেটেড অফিসার। তিনি তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাতে ‘খিদমত-ই-পাকিস্তান’ খেতাবও পেয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে টানা ১১ দিন দফায় দফায় পুকুরে ডুব দিয়ে মুখটুকু তুলে লুকিয়ে ছিলেন এ বাড়ির ছেলে মৃণালকান্তি। নীরদকৃষ্ণের সেজো ছেলে নারায়ণকৃষ্ণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। তাকে মারার পর রাজাকাররা ফের নির্যাতন করবে ভেবে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তার স্ত্রী গৌরী। নীরদকৃষ্ণ ও তার ভাই বিনোদবিহারীর সন্তানেরা এর পরেই বারাসতের ওয়াজুদ্দিন মোড়লের বিশাল সম্পত্তি পালটাপালটি করে ওপারে চলে যান।

ওপারে যাওয়ার পর যে জমির মালিকানা মিলেছে, তাতেই ছিল ওই ভাঙাচোড়া মসজিদটা। প্রথম দিকে কেউ খেয়ালই করেনি। জমির পরচাতেও তেমন কিছু লেখা ছিল না। মেরেকেটে তিন কাঠা জায়গা। এটা আসলে কতদিন থেকে মসজিদটা ওই জমিতে আছে তাও কেউ বলতে পারেনি। সাপখোপের ভয়ে কেউ ভেতরেও ঢুকত না তখন। ‘ও রাখা না-রাখা সমান’ বলে মাথা ঘামাতেই চাননি সাবেক মুসলিম মালিকরা। কিন্তু বাদামগাছের ধারের মসজিদে ভক্তি ভরে বাতি জ্বেলে নীরদকৃষ্ণের স্ত্রী লীলাবতীর মনটাই অন্য রকম হয়ে গেল। তারপরই ছেলেদের বলে গেছেন, ‘এ মসজিদে বাতিধূপের যেন অভাব না হয় বাবা’।

‘গুটিকয়েক রাজাকারের অত্যাচারের জন্য একটা গোটা ধর্ম ও তার মানুষদের দোষ দিতে পারব না। কিছু মানুষের বিশ্বাসের স্মারক ধর্মস্থানের অমর্যাদা হতে দেওয়াও তো সম্ভব নয়!’- এটাই ছিল নীরদকৃষ্ণের জীবনদর্শন। বোসেদের হাতে মসজিদ তাই নতুন প্রাণ পেল। নিজেরা কখনও ধর্ম পালটানোর কথা ভাবেননি। বিশ্বাসী হিন্দু পরিবার নিজের ধর্মাচরণ বজায় রেখেছে। শুধু ঝেড়ে ফেলেছেন মনের ‘ক্ষুদ্রতাটাকে’।

দীপক বসুর কথায়, ‘লোক দেখানো বাড়াবাড়ি মানি না। এটুকু বুঝি, একসঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় সমস্যা নেই!’

মসজিদের গায়ে বড় হরফে লেখা, ‘প্রভুকে প্রণাম করো’! তার পাশে, ‘আমানতি মসজিদ’। এই বসু পরিবার আবার চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের ভক্তির পীরবাবা আমানত আলি শাহের মুরিদ। পীরের নামে ‘হুজুরঘর’ও গড়ে উঠেছে। বসুদের পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গেও ক্রমশ একাকার এ মসজিদ।

“এ বাড়ির কেউ মারা গেলে, একবারের জন্য হলেও আনা হয় মসজিদের বারান্দায়। শ্মশানে শেষযাত্রার আগে আজান দেন ইমামসাহেব। বিয়ের পরে নতুন বউকেও প্রথম বার শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে প্রণাম করেন মসজিদে। আর নবজাতক কেউ জন্ম নিলে অন্নপ্রাশনের বদলে মসজিদে ইমামসাহেবের হাতে একটু পায়েসই সই। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের উসকানির কাছে হার না-মানা পারিবারিক মূল্যবোধেরও আমানত এই মসজিদ-প্রাঙ্গণ।”

আড়াই দশক আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন তোলপাড় গোটা দেশ। নিঃশব্দে উলটো পথে হাঁটছিল, এই মফসসলি মহল্লা। টালির চাল, বাঁশে ঘেরা মসজিদ ফের চাঙ্গা করে তুলতেই নতুন করে ইটের গাঁথনি বসছিল তখনই। পার্থ সারথি, তার চাচাতো ভাইয়েরা মিলে রাতের বেলা দল বেঁধে মসজিদ পাহারা দিতেন। বাপ-চাচাদের কড়া আদেশ, তাদের এই ‘পারিবারিক মসজিদ’টিতে যাতে কোনো আঁচড়ও না পড়ে। পড়েওনি, কারণ পাড়াপড়শি সবার বিশ্বাস- এই মসজিদই তাদের রক্ষা করে। রাজনীতির ঝড়বাদলের কোনও অভিঘাত এখানে ছাপ ফেলতে পারেনি। দীপকবাবু কেরোসিনের ডিলার। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যৎসামান্য টাকা রেখে এখনও বারো আনাই উজাড় হয় মসজিদের যত্নে। এই বোসবাড়িরই ছেলে বম্বের প্রয়াত ফিল্ম ডিরেক্টর দিলীপকুমার বসু। মাসতুতো ভাইরা মিলে ভাগাভাগি করে মসজিদের চেহারা ফিরিয়েছেন। ইমাম, মুয়াজ্জিনদের ডেকে এনে বসানো হয়েছে। সঙ্কটে-সমস্যায় হিন্দুরাও আসেন। কিন্তু কবচ-তাবিজ বিক্রির কোনও প্রশ্ন নেই।

‘বিশ্বাস বিশ্বাসের জায়গায় থাকুক! ধর্মব্যবসা কিন্তু হতে দেব না,’ জোর গলায় বলেন দীপক বসু। অনেক বছর আগে তাবিজ-কবজ বিক্রির দোষে এক ইমামকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ইফতারের আয়োজনেও রাজনীতির ছোঁয়া লাগার জো নেই। কোনও নেতানেত্রীকে ডাকা হয় না। ‘ইফতার-পার্টি’ শব্দটাতেই ঘোর অ্যালার্জি পার্থর। ‘ইফতারের আবার পার্টি কী? এখানকার রোজাদারদেরও জাঁকজমক ভরা মোচ্ছব এড়িয়ে চলতেই অনুরোধ করা হয়!’
কেউ যাতে আঙুল তুলতে না-পারে, তাই এ মসজিদে নগদ অনুদান গ্রহণেরও নিয়ম নেই। একবার এক প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে এই মসজিদের দায়ভার কাঁধে নেয়ার প্রস্তাব এসেছিল। সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এই প্রাণের মসজিদ কী করে ছেড়ে থাকব’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!